Blog



কথাঃ আবোলতাবোল
বানর কাহিনি
বানরের রূপ ধরে থাকা রাজপুত্র আর তার দুখিনী মায়ের সেই রূপকথার গল্পটা শোনাচ্ছিলাম ছেলেকে। এ গল্প আমার কাছে ওর বহুবার শোনা । তবু এ গল্প আমি বলতেও ভালবাসি,আর ও শুনতেও ভালবাসে। পঞ্চতন্ত্রের সেই বানরের গল্পটা আবার ওর খুব অপছন্দের। যেখানে বানরটার নির্বুদ্ধিতায় প্রাণ দিতে হয়েছিল রাজাকে। বানর নিয়ে ওর শিশুমনে কৌতূহলও অপার।-‘বাবা কত বছর আগে আমরা বানর ছিলাম?’ এমন প্রশ্ন আমাকে অহরহই করে।আজও করল। ‘আমার মা সব জানে’ লিখেছেন অদ্রীশ বর্ধন। শিশুরা হয়ত এমনই ভাবে। এবং শুধু মা নয়। বাবা্র সম্পর্কেও। মানে,’আমার বাবা সব জানে’। কিন্তু সত্যি কি তাই!
তবে এ প্রশ্নটার উত্তর আমার জানা। আগেও বলেছি ওকে। আবার আজ বলতে যাই। কিন্তু বলতে গিয়ে চোখ যায় জানলা দিয়ে।
একটা বানর (মানে হনুমান) উল্টো দিকের ছাদে বসে, খোলা জানলা দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে প্যাট প্যাট করে। খুব ইচ্ছে ঘরে ঢোকার। কিন্তু বাধা আমরা আর জানলার গ্রিল।
হনুমানটাকে দেখে মনে হল। ছেলের এত কৌতূহল;এদের নিয়ে ,একটু চর্চা করলে কেমন হয়!
নরের সঙ্গে বানরের শুধু উচ্চারণগত মিল নেই,চেহারা ও অন্যান্য অনেক বিষয়েই মিল। আর সেজন্য প্রাইমেটস বর্গের অ্যানথ্রোপয়ডি উপবর্গে নরের সঙ্গে তো স্থান পেয়েছে বানরও। কাজেই আত্মীয়তাও রয়েছে। আজকাল আত্মীয়দের কথা আমরা তো ভুলেই গেছি। ব্যক্তি ছেড়ে একেবারে না হয় মানুষ পরিচয় ধরেই এগোনো যাক।
সেকালে এই আত্মীয়দের উপকারও তো আমরা কম পাই নি । রামের পাশে বানরকুল সেদিন না দাঁড়ালে ওই বিদেশ বিভূঁঁয়ে দু ভাই তো সেদিন ভেসে যেতেন। সীতাকে হয়তো এখনও অশোকবনেই চোখের জল ফেলতে হত।
তবে আমরা মানুষ। কেউ উপকার করলে সেটা বেশিদিন মনে রাখা আমাদের ধাতে নেই। তার উপর এদের উপদ্রব। তাই অতীত টতিত এখন চুলোয়। বানর মানেই এখন মূর্তিমান অত্যাচার। যেখানে এরা থাকে সেখানে বাগান তছনছ করা ,ঘরদোরের বাইরের অংশ ভেঙে দেওয়া,পথচারীদের উপর চড়াও হওয়া ইত্যাদি তো নিত্যদিনের চিত্র।
গরু আদৌ বোকা কিনা,না জেনেই বোকা ছেলেদের গরু বলা হয়। কিন্তু দুষ্টু ছেলেদের বানর বলা্ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। এতটাই এদের অত্যাচারের বহর।
তবু আগেই বলেছি আত্মীয়। আমাদের সঙ্গে বর্গের মিল। মিল উপবর্গেরও। তাই একটু খোঁজ নেওয়াই যাক।
ভাগাভাগির ব্যাপারটাতেই আসা যাক প্রথমে। বানরদের সাধারণত দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। একটি ভাগ ক্যাটারাইন বা পুরোনো জগতের বানর। অন্যটি হল প্ল্যাটিরাইন বা নতুন জগতের বানর। এই দুই শ্রেণির বানরের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল নাকের। পুরোনো জগতের বানরদের বেলায় নাকের ফুটো দুটোর মাঝখানের আড়ালটা সরু। আর নতুন জগতের বানরদের ক্ষেত্রে মাঝখানের আড়ালটা মোটা আর ফুটো দুটোও বেশ দূরে দূরে।
পুরোনো নতুন এই দুই জগতের বানরই রয়েছে পৃথিবী জুড়ে। পুরোনো জগতের বানরদের বেশি দেখা যায় এশিয়ায় আফ্রিকায় আর দক্ষিণ ইউরোপে। আর নতুন জগতের বানরদের বেশি দেখা পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকায়,।
পুরোনো নতুন -দুই জগতেরই মধ্যে রয়েছে নানান প্রজাতি। লাঙ্গুর,কোলোসাস, ম্যাকাকে,বেবুন ইত্যাদি প্রায় ২৮৫টি প্রজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে পুরোনো জগতের বানর পরিবার। অন্যদিকে মারমোসেট,কাপুচিন,গর্জনকারী ইত্যাদি প্রায় ১৫৫টি প্রজাতি রয়েছে নতুন জগতের বানর পরিবারে।
পুরনো জগতের বানরদের মুধ্যে লাঙ্গুর প্রজাতির বানরদের দেখা পাওয়া যায় ভারতে। এরা আকারে এক থেকে তিনফুট। অনেক জায়গায় এদের মুখটা কালো। কালো মুখের বানরদের বলা হয় হনুমান।
বানর,হনুমান এদেশে কম বেশি প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। কয়েকটি জায়গা এদের সংখ্যা ও আচরণের জন্য তো প্রসিদ্ধ। এর মধ্যে প্রথমেই মনে আসে কাশীর কথা। লীলা মজুমদারের লেখায় কাশীর বাঁদরদের (বাঙালি বাঁদর বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে) নানা কীর্তিকাহিনি পাওয়া যায়।
সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’র কিছু অংশ কাশীকেন্দ্রিক। সেখানে বাঁদর বাদ পড়েনি। কলের জল খাওয়া বাঁদরের দাঁতখিঁচানি দেখে ‘দ্যাখো দ্যাখো কাণ্ড দেখেছ’ বলে সর্বজয়ার আর্তনাদ এবং হরিহরের বাইরে বেরিয়ে এসে ‘কাশীর সব ভাল,কিন্তু বাঁদরগুলো…’ বলা সকলেরই মনে পড়বে।
একসময় হগলি জেলার গুপ্তিপাড়া বাঁদরের জন্য বিখ্যাত ছিল। ফরাসী পর্যটক ট্যাভারনিয়ে তাঁর বর্ণনায় এদের কথা লিখেছেন। এখানকার বাঁদরেরা আকারে যেমন বড়,তেমনি উৎপীড়নেও দক্ষ ছিল। অনেক সময় এরা মেয়েদের কাঁখের কলসী পর্যন্ত ভেঙে দিত।
তা,এমন বাঁদরকে সমাদর করতেই হয়। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সারাজীবনে অনেক উদ্ভট কাজ করেছেন। যার মধ্যে সম্ভবত শ্রেষ্ঠ হল,গুপ্তিপাড়ার বাঁদরের সমাদর। তিনি গুপ্তিপাড়া থেকে থেকে বাঁদর বাঁদরী আনিয়ে কৃষ্ণনগরে মহা সমারোহে বিয়ে দিয়েছিলেন। এই বিয়েতে নাকি খরচ হয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। বিভিন্ন জায়গার পন্ডিতেরা এই বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
তবে এতক্ষণ ঘুরিয়েফিরিয়ে শুধু বাঁদরের অত্যাচারের কথাই বলা হল। বাঁদর কিন্তু পোষও মানে। পোষমানা বাঁদর সার্কাসে নানা খেলা দেখিয়ে আমোদও দেয়। সিনেমাতে পোষা বাঁদরের অনেক কীর্তি স্মরণীয় হয়ে আছে।
মহাকাশ গবেষণায় তো প্রথম দিকে বাঁদরকেই কাজে লাগানো হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ মে ‘মাইক’ আর ‘প্যাট’ নামের দুটি বাঁদরকে পাঠানো হয়েছিল বায়ুস্তরের শেষসীমায়। নিরাপদেই ফিরেছিল ওরা।
-‘ওরা কি কলা খায় বাবা?’ কলা খেতে খেতে হঠাৎ ছেলের প্রশ্ন। ওর প্রশ্ন শুনে আবার তাকাই হনুমানটার দিকে। মনে পড়ে যায়,ছেলেবেলায়,হনুমান দেখলেই নিরাপদ দূরত্ব থেকে আমাদের সেই ছড়া কাটা- ‘এই হনুমান কলা খাবি? জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি?’