
উনি এবং ইনি
-১৯২১ সালে আমি হরিনাভি স্কুলে। তবে সময়টা তখন সুখের ছিল না মোটেই। বছর দুয়েক আগে গৌরী চলে গেছে। মা-ও গেলেন তোমার এই জন্মের বছরটিতেই। ভাই বোন, সংসারের দায়িত্ব, আমার একেবারে হিমসিম অবস্থা। আর তোমার সঙ্গে যখন আমার দেখা হল, না সরাসরি নয়, আমার বইয়ের মলাট আঁকার মাধ্যমে তখন তো আমার পড়ন্ত বেলা।
-আপনি জন্মেছেন গ্রামে, বড় হয়েছেন গ্রামে। আর আমার সবটাই শহরে। কলকাতায়। তবু দেখুন আপনার সৃষ্টিতেই আমার দৃষ্টি খুলে গেল কেমন। মনে হল বিরাট একটা ঐশ্বর্য হাতের কাছে পেয়ে গেছি, যা হতে পারে আমার স্বপ্নলোকের চাবি।
-তোমার সে বিশ্বনন্দিত ছবি আমার দেখে আসা হয়নি, এই আক্ষেপ এখানে বসে রোজই করি।
– আমারও আক্ষেপ রয়েছে। তবে শুধু ছবিটা আপনাকে দেখানো গেল না, সে কারণে নয়। আপনার কাছে বই থেকে ছবি করার অনুমতি চাইবার আগেই আপনি বিদায় নিলেন। ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর আমি আপনার প্রয়াণের খবর পেয়ে সত্যিই মুষড়ে পড়েছিলাম।
-তোমার তো ওখানে যাওয়া একশো বছর হয়ে গেল। ছেড়ে আসাও উনত্রিশ বছর। তুমি এখনও বঙ্গজীবনে জড়িয়ে আছ। ওদের কথায় কথায় তুমি, তোমার সৃষ্টি। এটা বিরাট ব্যাপার।
– আপনিও কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতোই বাঙালিদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন আজও। সেদিক দিয়ে…
– কে জানে! তবে আমার ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গে তোমার ‘পথের পাঁচালী’র মিল কিন্তু বেশ। ওটা তোমার প্রথম ছবি। প্রথম ছবিতেই সারা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন। আর আমার প্রথম এই লেখাতেই আমি বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের ভালবাসা পেয়ে গিয়েছিলাম। এমনকী রবীন্দ্রনাথেরও প্রশংসা।
– ‘আম আঁটির ভেঁপু’ যখন দিলীপ কুমার গুপ্ত আমাকে মলাট আঁকার জন্য দিয়েছিলেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘পথের পাঁচালী’ আমি পড়েছি কিনা। পড়িনি শুনে রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘পথের পাঁচালী’ না পড়ে থাকলে তোমার শিক্ষা অসম্পূর্ণ। বইটা পড়তে গিয়ে বুঝলাম, কথাটা ভুল কিছু বলেননি তিনি।
– আমি আমার মত করে লিখে গিয়েছিলাম। আর্ট নিয়ে ভাবিনি। হয়ত সেটাই মঙ্গল হয়েছিল। নতুন একটা ফর্ম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর বিদায় নেওয়া তো হাতে থাকে না কারও। এই নিয়ে আমার কোনও আপসোস নেই। আমি দু’চোখ ভরে দেখে এসেছি গ্রাম্য প্রকৃতিকে, মানুষকে। তবু ‘ইছামতী’ সহ আরও কিছু বইয়ের দ্বিতীয় খন্ড লেখার ইচ্ছে অপূর্ণ রেখেই চলে আসতে হল।
-‘আপনার বইয়ের পাতায় শুধু লেখা থাকে না, থাকে ছবি। আর ‘পথের পাঁচালী’ তো বাংলার গ্রামজীবনের বিশ্বকোষ। গ্রাম সম্পর্কে আমার কোনও বস্তুগত অভিজ্ঞতা ছিল না। আপনার এই বই পড়েই গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রাকে বোঝার ইচ্ছে হয়। আর তা বুঝতে গিয়ে দেখি এক আশ্চর্য জগতের দরজা ক্রমেই খুলে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী, আপনার বই আমার চোখে যে মায়া অঞ্জন লাগিয়ে দিয়েছিল তাতে আমি গ্রামজীবনকে ভালবাসতেও শিখেছিলাম। আপনার বই পড়ার পর আর একটা জিনিস আমার উপলব্ধি হয়েছিল, মানুষকে কত নিবিড়ভাবে দেখলে এমন বাস্তবসম্মত সংলাপ লেখা যায়! আপনার বই থেকে যখনই ছবি করেছি, সংলাপের জন্য আমাকে কখনও আলাদা খাটতে হয়নি।
-আসলে, গ্রামে জন্মেছি, গ্রামের মানুষজনকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। সেটা সম্ভব হয়েছে কিছুটা হয়ত দারিদ্র্যের জন্য। আমাদের তখন অভাবের সংসার, বর্ষায় চাল দিয়ে জল পড়ে, ভাইবোনেরা নিত্য ভোগে, বাবা ঘুরে বেড়ান নানা জায়গায় কাজের খোঁজে। এমন দারিদ্র্য আর অসহায়তার মধ্যে ছিলাম বলেই হয়ত মানুষকে চিনেছিলাম এত নিবিড়ভাবে।
-আপনার ছেলেবেলার সঙ্গে আমার ছেলেবেলার কিন্তু অনেক মিল। আমাকে আড়াই বছরের রেখে বাবা চলে গেলেন। কয়েক বছর পরে আমরা গড়পারের বাড়ি ছেড়ে এসে উঠলাম ভবানীপুরে মামার বাড়িতে। সেখানে আমাকে মানুষ করতে মাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তবু মা হার মানেননি, আমাকে পড়িয়েছেন ভাল স্কুলে। মানুষ করায় কোনও ফাঁকি রাখতে চাননি।
-আমার ছেলেবেলা তোমার বেশ কিছুটা আগে। তুমি আড়াই বছরে বাবাকে হারিয়েছ। আর আমি যখন বনগ্রাম হাইস্কুলে এইটে পড়ি, বাবা আমার উপর বিরাট সংসারের বোঝা চাপিয়ে চলে গেলেন পরপারে। তারপর প্রায় একক সংগ্রাম। মামারা কিছু সাহায্য করতেন। মিলের কথা বলছিলে। কিছু মিল তো আছে সত্যিই।
-বাবার কথা আমার খুব মনে পড়ত না। আড়াই বছর বয়সের স্মৃতি। মনে থাকেও না। তবে দু্টো ঘটনার আবছা ছবি মনে আছে। আমার জন্মের পরেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বায়ু পরিবর্তনের জন্য বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একবার গিরিডি, একবার সোদপুরে গঙ্গার ধারে। আমিও গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে। এই দুই যাত্রার ছবি সামান্য মনে আছে। বিশেষ করে সোদপুরের বাড়ির। বাবা এখানে জানলার ধারে বসে ছবি আঁকতেন। ছবি আঁকতে আঁকতে একদিন বাবা বলে উঠলেন-‘ জাহাজ যাচ্ছে,জাহাজ।’ এটা শুনে আমি বাইরে বেরিয়ে দেখি, ভোঁ বাজিয়ে চলে যাচ্ছে একটা স্টীমার। বড় হয়ে শুনেছি, বাবা আমাকে কোলে নিয়ে নাকি নাচাতেন আর বলতেন-‘ওরে আমার বাঁদর নাচন, আদর-সোনা কোঁৎকারে/ অন্ধবনের গন্ধগোকুল, ওরে আমার হোঁৎকারে…।’ আর তা শুনে আমি নাকি খিলখিলিয়ে হাসতাম।
– বাবারা এমনই হন। এমন স্নেহময়। আমাদের তো অভাবের সংসার। চলেই না প্রায়। তবু তার মধ্যে বাবা আমার অন্নপ্রাশন দিয়েছিলেন ঘটা করে। সারা বারাকপুরে টোপর পরিয়ে পালকিতে চাপিয়ে আমাকে ঘোরানো হয়েছিল। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে বাবা আমার পৈতেতেও অনেক খরচ করেছিলেন।
-আমরা ব্রাহ্ম ছিলাম। কাজেই আমাদের প্রথা আপনাদের থেকে ভিন্ন নানা ব্যাপারে। মনে আছে মাঘোৎসবে গানের লোভে ভিড় জমাতাম। মা ওখানে গান গাইতেন। তবে হই হুল্লোড় হত না। ব্রাহ্ম হলেও কালীপুজো, দুর্গাপুজোয় মাতামাতি করতে আমাদের কিন্তু বাধা ছিল না। বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়াতাম। কালীপুজোয় পটকা ফাটাতাম। একসময় এই কাজে সঙ্গী ছিল ছেদি । গড়পারের বাড়িতে শ্যামা নামে যে কাজের মহিলা থাকতেন, ছেদি তাঁর ছেলে। ছেদি একেবারে দক্ষ ঘুড়িবাজ। শুধু কি ঘুড়ি? তখন ওর মাত্র দশ বারো বছর বয়স ।ওই বয়সেই কত যে কেরামতি করত কালীপুজোর পটকা নিয়ে!
– আমাদের নিস্তরঙ্গ গ্রাম জীবনে এসব ছিল না। তবে চড়ক হত ধুমধাম করে। আর সরস্বতী পুজোয় একটা রিচুয়াল ছিল। বিকেলে দল বেঁধে নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে যাওয়া। আমি বরাবরই নির্জন প্রকৃতির। ভালবাসতাম নির্জন নদীর তীর, লোকালয় থেকে দূরে কোনও নির্জন স্থান। আমার যখন ন’ দশ বছর বয়স, বেরিয়ে পড়তাম সেসব জায়গার উদ্দেশে। হাতে থাকত একটা বাঁকা কঞ্চি।
-একে আপনার অনেকটা পরে আমার ছেলেবেলা, তার উপর শহর। শৈশবের চারপাশটা ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। গড়পারে আমাদের একতালায় ছিল ছাপাখানা। দুপুরে ওখানে ঢুঁ মারা ছিল আমার রোজকার অভ্যেস। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম ‘সন্দেশ’ মুদ্রণের নানা কলাকৌশল। বেশিরভাগই বুঝেতাম না। বোঝার কথাও নয়। তবু ভাল লাগত। ছেলেবেলায় বিলিতি খেলনা দেখেছি, উপহার হিসাবে পেয়েওছি নানা জনের কাছে। একটা রেডিয়োও উপহার পেয়েছিলাম মনে আছে। এই সব অমিলের মধ্যে একটা মিল কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার ছিল। সেটা হল বইয়ের প্রতি টান। ভাবানীপুরের নির্জন দুপুরগুলোয় দশ খন্ডের বুক অফ নলেজ খুলে ছবি দেখা ছিল আমার প্রিয় শখ।
– বাবা এন্ট্রান্স পাশ করতে পারেননি। কিন্তু অসম্ভব পড়ুয়া ছিলেন। উনি গান কথকতা আর পড়া, লেখা এসব নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। বাবার এই স্বভাব আমার মধ্যেও কিছুটা সংক্রামিত হয়েছিল। তবে আসল পড়াশোনার কাছে যাওয়া কিন্তু স্কুলে আর কলেজে পড়াকালীনই। তুঁততলা প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার গগন চন্দ্র পাল যেদিন ‘বঙ্গে শরৎ’ আবৃত্তি করে শোনালেন, সেদিন বিশেষ কিছু না বুঝেও শিশুমনে রোমাঞ্চ এল। কী বলব একে? সারাজীবন যে লেখা-লেখা খেলা নিয়ে থাকলাম তার প্রথম অনুপ্রেরণা? হয়ত। আসলে অনুপ্রেরণা তো সব সময় সরাসরি হয় না। ‘বঙ্গে শরৎ’ আমার জীবনবীণার তারে সেদিন যে ঝঙ্কার তুলেছিল, তার মূল্য কম ছিল না আমার লেখক হওয়ার পিছনে।
-‘রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনেও যাদুকাঠি। মা যখন শান্তিনিকেতনে আমাকে চিত্রাঙ্কনের পাঠ নিতে পাঠালেন, আমি যে খুব রাজি হয়েছিলাম তা নয়। কিন্তু ওখানে গিয়ে নন্দলাল বসুর পায়ের কাছে বসে যা শিখলাম তাতে আমার চিত্রাঙ্কনের ধাঁচটাই পালটে গেল অনেকটা । আর সবচেয়ে যেটা বড় ব্যাপার, ওখানে চলচ্চিত্র সম্পর্কে কিছু বই পড়ে আমার জীবনের অভিমুখটাই নির্দিষ্ট হয়ে গেল ।
– চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমারও আগ্রহ কম ছিল না। কত যে ইংরেজি ছবি দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। আমি গত শতকের ত্রিশের দশকে ‘চিত্রলেখা’ বলে একটা চলচ্চিত্র সাপ্তাহিকের সম্পাদকও ছিলাম। চলচ্চিত্র নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছি ওখানে।
-আপনাকে কাছে পেলে সত্যিই আনন্দিত হতাম, ধনীও…আচ্ছা, আপনাকে বিভূতিবাবু না বলে যদি বিভূতিদা বলতাম, কিছু কি মনে করতেন?
-তুমি আমার চেয়ে বছর সাতাশের ছোট। তবু ভালবাসার ‘বিভূতিদা’ আমার ভালই লাগত। চাইলে ওভাবে এখানেও তুমি ডাকতে পার। কিন্তু আমি কি সত্য…
-না না সত্যজিৎ নয়, মানিক, মানিক বলেই…সবার কাছে সত্যজিৎ শুনতে ইচ্ছে হয় না…