কেমন আছে গ্রামবাংলার বাংলামাধ্যম স্কুল
জয়জিৎ দাস অরফে জিপু ভর্তি হয়েছিল সুপ্রিম স্কুলের ফাইভে। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বেশিমাত্রার শৃঙ্খলা আর অতিমাত্রার ইংরেজি বলার চাপ ফাইভ সি সেকশনের রোলনম্বর এইটিনাইন জিপুকে একেবারে খাদের কিনারায় পৌঁছে দিল। স্কুল হয়ে উঠল ওর কাছে জেলখানা। এসময় জিপুর জীবনে হঠাৎই ঘটল একটা ঘটনা। চাকরি চলে গেল বাবার। এই ঘটনার সূত্রে জিপু ভর্তি হয়ে গেল বাবার ফেলে আসা গ্রামের বাংলা মাধ্যম স্কুলটিতে। এই বাংলা মাধ্যম স্কুলে কড়াকড়ি কম। উপরন্তু ছাত্র শিক্ষক সবার মধ্যেই রয়েছে একটা আন্তরিকতা। এই স্কুলের সংস্পর্শে মাত্র কয়েকটা মাসেই জিপু টের পেল তার মধ্যেও লুকিয়ে আছে অনেক আনন্দের ভান্ডার। আস্তে আস্তে সেইসব ঘুমন্ত উপাদানগুলো জেগে উঠল। পরীক্ষায় মারকাটারি সাফল্য না পেলেও জিপু খুঁজে পেল নিজেকে। এবারের পূজাবার্ষিকী ‘আনন্দমেলা’য় সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘জিপুর যাওয়া আসা’ এভাবেই জিতিয়ে দিয়েছে গ্রামের বাংলা মাধ্যম স্কুলকে। কিন্তু এ তো উপন্যাসে। বাস্তবে প্রতিযোগিতার বাজারে কেমন আছে গ্রামবাংলার বাংলা মাধ্যম স্কুল? মুর্শিদাবাদের যে স্কুলে শিক্ষকতা করি,কয়েক বছর আগেও সেখানে ছাত্রসংখ্যা ছিল কমবেশি সাড়ে তিনহাজার। বর্তমানে সে স্কুলে ছাত্রসংখ্যা নেমে এসেছে দু হাজার সাতশতে। ক্লাস ফাইভে লটারি বছর দুই হল উঠে গেছে। কারণ যত জন ফাইভে ভর্তি হবার আবেদনকারী,তাদের কাউকেই আর ফেরানোর প্রয়োজন পড়ছে না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ,ছাত্রসংখ্যার এই ক্রমহ্রাসমান অবস্থার কারণ এলাকায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে আগে শহরের সম্পন্ন পরিবারের সন্তানেরা পড়ত। এখন গ্রামের দরিদ্র বাবা মাও এইসব স্কুলে ছেলেমেয়েকে পড়াবার জন্য মাসে এক দেড় হাজার টাকা খরচ করতে পিছপা হচ্ছেন না। এরজন্য আর্থিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন তাঁদের হতে হলেও বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছেলেমেয়েকে পাঠাতে তাঁরা রাজি নন।বাংলা মাধ্যম স্কুলে আইন-শৃঙ্খলার ঢিলেঢালা অবস্থা নতুন কিছু নয়। মিড-ডে মিল,আর নানারকম অনুদান কর্মসূচিতে সেটা আরও একটু টাল খেয়েছে ঠিকই, তবে অবস্থাটা গেল গেল পর্যায়ের নয় এখনও। বাইরে থেকে সবকিছু সবাই একটু বেশিই অনুমান করে থাকেন। আর পড়াশোনা? ঠিক সময়ে সিলেবাস শেষ, যথা সময়ে পরীক্ষা গ্রহণ এবং নির্দিষ্ট সময়ে ফলপ্রকাশ আজও প্রায় সব বাংলা মাধ্যম স্কুলেরই দস্তুর। তাহলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ার এত হিড়িক কেন?প্রথম কারণ কিন্তু ওই ইংরেজিই। ইংরেজিতে পড়লে উচ্চ মাধ্যমিকের পর ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিংএ প্রবেশের সর্ব ভারতীয় স্তরের পরীক্ষায় অনেকটাই সুবিধা পাওয়া যায়। তাছাড়া বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছাত্র্দের তুলনায় অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রেরা সেখানকার পরীক্ষা ব্যবস্থার জন্যও কিছুটা এগিয়ে থাকে। আইসিএসই বোর্ডের ধরা যাক। দশম মানের পরীক্ষায় আশি নম্বরের অঙ্কের জন্য সেখানে দেওয়া হয় আড়াই ঘন্টা সময়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা আরও কম। দু ঘন্টা। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের একই নম্বরের পরীক্ষায় কিন্তু ছাত্রেরা পেয়ে থাকে তিন ঘন্টা পনেরো মিনিট সময়। যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কম সময়ে বেশি নম্বরের উত্তর দিতে হয়। আইসিএসই বোর্ডের ছাত্রেরা কিন্তু তাদের পরীক্ষা ব্যবস্থার কারণেই এই ব্যাপারটায় দশম স্তর থেকেই একটু বেশি সড়গড় হয়ে যাবে। অভিভাবক যাঁরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানদের পাঠাচ্ছেন এসব তথ্য তাঁদের অনেকেরই জানা।এ তো গেল ভবিষ্যৎ পড়াশোনা জনিত ভাবনার দিক। এরপরে রয়েছে সুরক্ষার প্রশ্ন। গ্রামাঞ্চলে যে কোনও বাংলা মাধ্যম স্কুলে প্রতিদিন সহপাঠী বা উঁচুশ্রেণির ছাত্রের দ্বারা নিগৃহীত হওয়া ছাত্রের সংখ্যার গড় নিলে সেটা কিন্তু নেহাৎ কম হবে না। চুল ধরে টানা্,কিল খাওয়া খুব মামুলি ব্যাপার। রক্তারক্তি, ধাক্কা মেরে ফেলে পা হাত ভেঙে দেবার ঘটনা অসংখ্য। আজকাল বেশির ভাগ পরিবারে একটি দুটি সন্তান। তাছাড়া সন্তানের প্রতি সচেতনতাও অভিভাবকদের মধ্যে এখন আগেকার তুলনায় বেশি। স্কুলে সন্তানের শারীরিকভাবে এই হেনস্থা কোন অভিভাবক মানবেন? স্কুল এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় অসহায়। কেননা এইসব নিগ্রহের অনেকটা কারণই বসার জায়গা নিয়ে। ক্লাশঘরে পনেরো থেকে সতেরটা বেঞ্চ ধরে,কিন্তু ছাত্রসংখ্যা ঘরপিছু একশোর আশেপাশে। এই অবস্থায় বসা নিয়ে ছাত্রে ছাত্রে ঝামেলা কে আটকাতে পারবে? এই ঝামেলার সূত্র ধরে উঁচুক্লাশের ছাত্রেরাও অনেকসময় সেখানে ঢুকে যায়। তার বাড়ির অথবা পাড়ার ছেলের পক্ষ নিয়ে আঘাত করে বসে অন্যজনকে।এরপরে রয়েছে শৌচাগারের প্রশ্ন। পর্যাপ্ত শৌচাগার অনেক স্কুলেই নেই। যাও আছে তা ঠিকঠাক পরিষ্কার হয় না। কারণ দেখভালের স্থায়ী কোনও লোক নেই। ছাত্রেরা স্কুলে যে সাইকেল নিয়ে আসে তা রাখার গ্যারেজ হয়ত অনেক স্কুল করে ফেলেছে। কিন্তু গ্যারেজের পাহারাদার নিয়োগ করে উঠতে পারেনি প্রায় কেউই। এসব ক্ষেত্রে স্কুলস্তরে স্থায়ী কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা সরকারের তরফে নেই। যা করবার করতে হবে স্কুলকেই ডেভলপমেন্ট ফান্ড থেকে। কিন্তু স্কুলের নানান খরচ চালিয়ে সে ফান্ড কতটুকু থাকে! ফলে স্কুলের পক্ষে এসব ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখানো ছাড়া উপায় থাকে না।সচেতন অভিভাবককুল তাঁদের সন্তানকে সরকার পোষিত স্কুলের এইসব অব্যবস্থার মধ্যে ফেলতে কি চাইবেন যদি হাতের কাছে বিকল্প কিছু পেয়ে যান? যাঁরা সন্তানের আপগ্রেডেশনটা আজও অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে দেখেন,তাঁদের কথা আলাদা। জিপুর রামপদস্যারের মত তাঁরা হয়ত আজও মনে করেন, ‘ইশকুলও একটা সমাজ,একটা কমিউনিটি’ এবং মনের পুরো বিকাশের জন্য সন্তানের এই সমাজের সংস্পর্শে থাকা খুব জরুরী। অব্যবস্থা যাই থাকুক, নানান সামজিক স্তর থেকে আসা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাংলা মাধ্যম স্কুলের এই সমাজটা হয়ত এখনও আছে। তবে কেরিয়ারসর্বস্বতার এই যুগে সার্বিকভাবে এই সমাজের আবেদন কতটুকু?