কথাঃআবোলতাবোল

Ami Mishuk | আমি মিশুক কথাঃআবোলতাবোল( 'ও বক বকম বকম পায়রা...')

‘ও বক বক্ বকম পায়রা…’

‘ঝিনেদার জমিদার কালাচাঁদ রায়রা/সে-বছর পুষেছিল একপাল পায়রা।’ ছেলে পড়ছে। পাশে বসে আমি ছেলের পড়া শুনছি আর আমার সামনে ভেসে উঠছে একটা ছবি। শুধু ছবি নয়,সঙ্গে ‘আও,আও,আও’ শব্দও। পঞ্জাবের সবুজ শস্য প্রান্তরের মাঝখানে এক চিলতে খালি জায়গা। সেখানে ভিড় করে আছে অজস্র পায়রা। তাদের ‘আও আও’ শব্দে দানা খাওয়াচ্ছেন চৌধুরী বলদেব সিংহ,আর ঠিক তাঁর পাশেই একই  ভঙ্গিতে পারিবারিক বন্ধুর ছদ্মবেশে সিমরণের প্রেমিক রাজ। ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’ ছবি দেখেছি আজকে নয়। কিন্তু  এক ঝাঁক পায়রার কথা  শুনলে ওমরেশপুরি আর শাহরুখের এই দানা খাওয়ানোর দৃশ্যটা আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

জগদানন্দ রায়ের ‘বাংলার পাখি’ বইতে কপোত প্রজাতির পাখির প্রথমেই রয়েছে পায়রা। তবে লেখক শুরুতেই বলে দিয়েছেন,পায়রা যেহেতু বাড়িতে আমরা অনেকে পুষি,তাই এই পাখি নিয়ে বেশি কথা  বলবেন না। শুধু পোষা নয়,মানুষের সঙ্গ প্রিয় এই পাখি আমাদের প্রতিদিনের চলাফেরায় এতটাই জড়িয়ে আছে যে আলাদা করে এর দেহের বর্ণনা দেওয়া সত্যিই অনাবশ্যক।

শোনা যায় পৃথিবীতে ২০০ জাতের পায়রা আছে। এর মধ্যে দুই বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ৩০ জাতের পায়রা। ঝিনেদার জমিদারদের পায়রা কোন জাতের?‘ বড়বাবু খাটিয়াতে বসে বসে পান খায়,/পায়রা  আঙিনা জুড়ে খুঁটে খুঁটে ধান খায়।’ পড়া শুনতে শুনতে সেই বহুযুগের ওপার থেকে এসে হাজির হয়,আমার ক্লাস ফোর।‘পঁচিশ গন্ডা পায়রা নিয়ে/আমার যে কি হয়রানি এ…’ সারা সকাল চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মুখস্থ করার পরও,যদু মাস্টার ক্লাসে সেদিন বিপাকে ফেলে দিয়ে ছিলেন আমাকে।  

-‘ তুই ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতার সারাংশটা বল।’

-‘সারাংশ! আমি তো…’

-‘আমি তো শুধু কবিতাটা মুখস্থ করেছি,তাইতো?কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক বাঁদর!’

-‘বাবা ভুটকি আর ছুটকি তো আসে না আর!’ ‘পায়রা জমায় সভা বক বক বকমে’ শেষ করেই ছেলে  তাকায় আমার দিকে।

ভুটকি আর ছুটকি আমাদের দুই প্রিয় পায়রা। পোষা নয়,কিন্তু পোষ্যের মতই তাদের আচরণ। ফ্ল্যাটের বাঁদিকের ঘরের পুবমুখো জানলাটা খুললেই প্রতি সকালে ওরা টুকি দেয়। বিস্কুট মুড়ি দিই,খুঁটে খুঁটে খায়। কিন্তু করোনা পর্বে ও জানলা আর খোলাই হয় না। এই লকডাউনেও ওদিকের প্রতিবেশির লাগোয়া ছাদে নিত্যদিন মিস্ত্রি লেগেই আছে। কোথা থেকে কী হয়,ভেবে ও জানলা বন্ধই থেকে যায় সারাদিন।

-‘ভুটকি,ছুটকিকে দেখলে চিনতে পারবি?’

-‘কেন পারব না? আমি যে একদিন ওদের দুজনের পিঠেই আলতা ঢেলে দিয়েছিলাম।’

আলতা ঢেলে দেওয়ার কথায় মনে পড়ল পাকিস্তানের নারোয়ালের হাবিবুল্লার কথা। এবছর ইদের দিন বেচারি তাঁর পোষা বারোটা পায়রা উড়িয়েছিলেন আকাশে। কিন্তু সব কটা ফেরত এলেও এলনা একটি।  সীমান্ত পার হয়ে চলে এল এদেশে।   জম্মুকাশ্মীরের কাঠুয়া জেলার সীমান্তসংলগ্ন এক গ্রামে পায়রাটা ধরা পড়ে গেল মে মাসের চব্বিশ তারিখ। গায়ে গোলাপি রঙ ঢালা,পায়ে রিং, সেখানে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন লেখা। এতো যে সে পায়রা নয়। এ নিশ্চয় পাকিস্তানি চর। এর আগেও পায়রাকে চরের কাজে লাগিয়েছে পাকিস্তান। পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিল পায়রা্টিকে। এরপর আসল তথ্য ভেসে এল ওপার থেকে। জানা গেল,যাকে সাংকেতিক চিহ্ন ভেবেছে পুলিশ,তা আসলে হাবিবের ফোন নম্বর। পায়রা হারিয়ে গেলে তা ফিরে পাবার জন্যই হাবিবের এই সাবধানতা। হাবিব তাঁর প্রিয় পায়রাটির জন্য সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে সরাসরি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আবেদন জানালেন। সবকিছু খতিয়ে দেখে পায়রাটিকে মুক্তি দেওয়া হল ২৮ মে।

করোনা সংবাদের পাশে এ খবরটিও গত মাসে শিরোনামে উঠে এসেছিল অনেক কাগজেই। পায়রা খবরের শিরোনামে কিন্তু গত বছরেও এসেছিল একবার। আর্মান্দোর কথা হয়ত অনেকেরই মনে পড়বে। গতবছর বেলজিয়ামের পাঁচবছর বয়সী এই পায়রাটিকে নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল কাগজে। কারণ নিলামে এই পায়রার দাম উঠেছিল ভারতীয় মুদ্রায় দশ কোটি টাকা। নিলাম থেকে,দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন পায়রাটিকে কিনে নিয়েছিলেন চিন দেশের এক নাগরিক।

পায়রা যেমন শান্তির প্রতীক,তেমনি জোড়া পায়রা প্রেমেরও প্রতীক। সলমন খানের প্রথম ছবি, ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ মনে আছে? পায়রা যে এককালে ডাকপিওনের কাজ করত তা আবার দেখা গেল এই ছবিতে। ভাগ্যশ্রীর চিঠি সলমনের কাছে পৌঁছে দিত এক শ্বেত কবুতর। ভারি মনোহর সে দৃশ্য সঙ্গে সেই গান, ‘যা যা যা কবুতর…।’

সিনেমায় গানের কথা যখন উঠল তখন বাংলা ‘মায়ামৃগ’ ছবিতে সন্ধ্যারায়ের লিপে শ্যামল গুপ্তের লেখা,সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই, অবিস্মরণীয় গান ‘ও বক বকম বকম পায়রা /তোদের রকম সকম দেখে…’কে ভুলতে পারবে!

ঝিনেদার জমিদারদের পায়রা পোষার ছড়া আমরা ছেলেবেলায় কোনও পাঠ্যপুস্তকে পাইনি।‘পণ্ডশ্রম’ ছিল ফোরে আর ক্লাশ ফাইভে পেয়েছিলাম,ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের, ‘চিত্রগ্রীবের ওড়ার শিক্ষা’। পোষা পায়রা চিত্রগ্রীবকে ছাদের কার্নিশে বসিয়ে বাবা মায়ের সেই ঠেলে দিয়ে ওড়া শেখানোর মধ্যেকার মেসেজটি আজও অনেকসময় সময় বেশ কাজে দেয়।

‘বাবা,আজ ছাদে যাবে?’ ছেলের প্রশ্ন পড়তে পড়তেই। 

-‘কেন রে?’

-‘পায়রাদের চাল খাওয়াব।’

উল্টো দিকের বাড়ির ছাদে এক দঙ্গল পায়রাকে সেই ওমরেশপুরি স্টাইলে দানা খাওয়াচ্ছিলেন এক  বর্ষীয়ান। ছেলের এই সাধ হয়ত সে দৃশ্য দেখেই। হঠাৎ উল্টোদিকের ছাদে  এক সঙ্গে সবকটা পায়রার উড়ে যাওয়ার শব্দ এল। কী ব্যাপার? তাকিয়ে দেখি হুপ হুপ শব্দে ওখানে নেমে এসেছে এক দঙ্গল হনুমান।

এদিকে একসঙ্গে পায়রা ওড়ার শব্দে আমি কিন্তু আঁতকে উঠেছি। আমার চকিতে মনে পড়ে গিয়েছে, সত্যজিৎ রায়ের’ অপরাজিত’ সিনেমায় হরিহরের সেই মৃত্যু দৃশ্য। মনে হয়, কে যেন এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল এতক্ষণের সব প্রসন্নতা। এত বিষণ্নতার অন্য কারণও বুঝি আছে! আসলে,এই করোনায় কে  থাকবে,কে যাবে,সবই তো অনিশ্চিত।    

সম্বিত ফেরে ছেলের কথায়।-‘ছাদে আমরা যাব না বাবা?’     

-‘যাব, আজ না গেলে আর কবে যাব? আজ যে ১৩ জুন,ইন্টারন্যাশানাল পিজিয়ন ডে।’ জোর করে তাড়াবার চেষ্টা করি যাবতীয় বিষণ্নতা।