dhon-amimishuk
কথাঃআবোলতাবোল ( ধন)

কথাঃ আবোলতাবোল

ধন

একটা রংচটা টিনের বাক্স। বাক্সের সঙ্গে ডালার সংযোগ কবে ছিন্ন হয়েছে কেউ জানে না। তবে ডালাটা  আছে। বাক্সের উপর বসানো অবস্থাতেই।

বাক্সের ডালাটা একটু তুললেই বেরিয়ে পড়বে সেই একমাত্র ধন যা বাবা রেখে গিয়েছেন আমাদের জন্য। সোনা নয়,নয় টাকা,এ হল চিঠি,এক বাক্স চিঠি।

ধনী আমরা কোনওকালেই ছিলাম না। তবু আশেপাশের অনেককে যখন দেখতাম,পিতৃপুরুষের ধন-সম্পত্তির উপর  বসে পা ছড়িয়ে দিব্যি খাচ্ছে,তখন বাক্সটা দেখে,সত্যি বলতে কী প্রথম প্রথম একটু রাগই হত। কিন্তু এখন কী এক অপ্রতিরোধ্য টানে মাঝে মাঝেই খুলে বসি ওই বাক্স, খুঁতে খুঁটে পড়ি পুরোনো চিঠি। কোনওটা কীটদষ্ট,কোনওটা হলুদ হয়ে আসা আবার কোনওটা শতচ্ছিন্ন। এক বিরাট সময়সীমায় সাংসারিক ঘটনাপ্রবাহের টুকরো টুকরো নানা ছবি।

এক এক সময় তন্ময় হয়ে যাই। চিঠিতে চিঠিতে কত মানুষের কণ্ঠস্বর,কত আশা-নিরাশার দোলাচল,কত স্বপ্ন,কত প্রীতিময় বন্ধনের সুরভি। মনে হয় অক্ষরে অক্ষরে বন্দি আবেগেরা যেন আমাকে বলে চলেছে- জীবন এই,জীবনের ছাঁচ এই,একে ধরে রাখ শ্রমে,যত্নে,ভালবাসায়! মনে মনে ভাবি,এর চেয়ে ভাল আর কোন ধন রেখে যেতে পারত আমার বাবা!

এইখানটাতে মোচড় দিয়ে ওঠে বুক। যত দরকারি কাজ,কুশল বিনিময়,আমন্ত্রণ-নি্মন্ত্ণ সবই তো এখন দু’কথায়, ‘হ্যালো’ বলে। শেষ চিঠি এ বাড়িতে কবে এসেছে মনে নেই। মনে নেই শেষ চিঠি কবে লিখেছি। অক্ষরের চেয়ে বড় আর কোন আধার আছে যাতে বন্দি থাকবে আমাদের যাপিত জীবন!

চারদিকে চেয়ে দেখি,উত্তর পুরুষের জন্য থাকবে বাড়ি,টিভি,ফ্রিজ,ওয়াশিং মেশিন আরও কত কিছু। কিন্তু থাকবে না অক্ষরের ফ্রেমে আমাদের জীবনের কোনও স্পন্দন।

খুব কাছ থেকে একটা জীবনের কতটুকু দেখা যায়? ভালভাবে দেখতে গেলে কিছুটা হলেও দূরত্ব লাগে। সেই দূরত্বের শেষে পুনরাবিষ্কারের পথটি তো রচিত হয় চিঠির হাত ধরেই। এই পুনরাবিষ্কারের আলোয়  কখনও কখনও ভিতরকে সাজিয়ে নেওয়ার গুপ্তমন্ত্রটিও উদ্ভাসিত হয়। চিঠিগুলি তখন আর চিঠি থাকে না। হয়ে ওঠে পথের সেই বান্ধব যে গভীর ভালবাসায় তার প্রসারিত হাতে হাত রাখতে বলে এবং উচ্চারণ করে,সখাকে ধরে রাখা,ভরে রাখা এবং সঙ্গে রাখার প্রতিশ্রুতি(হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো,দাও গো আমার হাতে/ধরব তারে,ভরব তারে,রাখব তারে সাথে)।

বাবা ধন না রেখে গিয়েও ধনী করে গিয়েছেন আমাদের।আমরা বেশ কিছুটা ধন রেখে গিয়েও নিঃস্বই ছেড়ে যাব আমাদের উত্তরপুরুষকে।

 

Leave a Reply