কথাঃ আবোলতাবোল

Ami Mishuk | আমি মিশুক কথাঃআবোলতাবোল (বাংলা প্রবাদের পুনর্লিখন প্রস্তাব)

বাংলা প্রবাদের পুনর্লিখন প্রস্তাব

স্টিফেন লিককের একটা ইংরেজি প্রবন্ধ পড়েছিলাম।’ওল্ড প্রোভার্বস মেড নিউ’। প্রবন্ধটিতে বেশ কয়েকটা ইংরেজি প্রবাদ নিয়ে লেখক আলোচনা করে দেখিয়েছিলেন বাস্তবে কীভাবে প্রবাদ প্রবচনের ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে থাকে। প্রবাদগুলোকে নতুনভাবে লেখার কথাও লেখক ওখানে বলেছিলেন।
ঘটনা হল,ইংরেজির মত বাংলাতেও কিন্তু অসংখ্য প্রবাদ-প্রবচন ছড়িয়ে আছে যেগুলোর মনে হয়,ওই একই কারণে পুনর্লিখন প্রয়োজন। 
যেমন ধরা যাক,’বোবার শত্রু নেই’। খুবই চালু প্রবচন। কিন্তু এখন এটা  ঠিক মানা যাবে কি? বোবা বলতে এখানে শারীরিকভাবে বোবাদের কথা কিন্তু বলা হচ্ছে না। যারা ইচ্ছাকৃত বা স্বভাবগতভাবে চুপচাপ থাকে,কথা হচ্ছে তাদের নিয়েই। এদের শ্ত্রু নেই,একথা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। বরং এদের শত্রু অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। যেহেতু এদের মতামত স্পষ্টভাবে শোনা যায় না,তাই এদেরকে ডান ভাবে বাম,বাম ভাবে ডান। অর্থাৎ দু পক্ষেরই এরা সন্দেহের তালিকায়। 
আবার কোনও দলের মেম্বারশিপ নিয়ে যদি এদের কেউ অবস্থানটা স্পষ্ট করেও থাকে,তবু ফাঁড়া কাটল এটা ভাবা ঠিক নয়। কোনও ভোটাভুটিতে দলের একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলে সবার আগে কিন্তু নজর যাবে ওই বোবাটির দিকেই। কেননা যতই মেম্বারশিপ নিয়ে থাকুক,সে যে বোবা,কম কথা বলে! অতএব তার পেটে পেটে কী রয়েছে জানা যাচ্ছে না। সুতরাং ডোবালে ওই ব্যাটাই ডুবিয়েছে।
তারপর ধরা যাক,কেউ পাড়াতে সাতেপাঁচে থাকে না,লোকের সঙ্গে মেশেও কম অর্থাৎ সব মিলিয়ে থাকে খানিকটা বোবা হয়েই। এক্ষেত্রে কিন্তু পরিপার্শ্ব তাকে রেহাই দেবে না। যে কোনও উৎসবে অন্যদের তুলনায় তার বেশি চাঁদা ফেলবে। তার অগোচরে   বাড়ির গাছের আমটি কলাটি ছিঁড়ে নিয়ে চলে যাবে।  তার অনুমতি ছাড়াই  বাড়ির দেওয়ালটি বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকবে।
 আর কর্মক্ষেত্রে বোবা হয়ে থাকলে তো কথাই নেই। কাজের চাপ ক্রমাগতই বাড়বে। যেন অফিসে বোবাটিই একমাত্র কর্মী। অথচ,বাড়তি সুবিধা নৈব নৈব চ। যেখানে প্রোমোশন এফিসিয়েন্সি-নির্ভর সেখানে বোবার এফিসিয়েন্সি একের থেকে বেশি হলেও তার উন্নতি হবে না। বরং তার অনেক পরে জয়েন করা ফাঁকিবাজটি এফিসিয়েন্সি নয়,স্রেফ বাতেলা দিয়ে উপরে উঠে যাবে এবং একদিন বোবার বস হয়ে বসবে।
সুতরাং বলা যায়,বোবা অজাতশ্ত্রু তো নয়ই বরং তার অনেক শত্রু। 
‘বুড়োপাখি পোষ মানে না’-এমনই আর এক প্রবচন। যেখানে এটি চালানো যেতে পারে সেখানে অর্থাৎ পাখিদের সমাজে এটি আর কবে  ব্যবহৃত! যে মনুষ্যসমাজে এই প্রবাদটির বহুল ব্যবহার সেখানে কিন্তু এটিকে আর চালানো যাবে না। কেননা  এর উল্টোচিত্রটাই বর্তমানে বেশি স্পষ্ট। 
দু তিন বছরের সিজারিয়ান বেবি,দেখতে তুলতুলে। কিন্তু স্বভাবে এক একটা লেজহী্ন হনু। বাড়িতে একটা থাকলে কোনও জিনিসই আর আস্ত থাকবে না। কোনও শাসন বারণ মানার প্রশ্নই ওঠে না। ভয়ও কি পায় একটু! লোকের বাড়িতে যাওয়া এখন এমনিতেই কালেভদ্রে। এমন একটা বেবি যদি থাকে তাহলে তো সেই সামাজিকতাও চুলোয়। কেউ বাড়ি যেতে বললে মা অথবা বাবার বিরস উত্তর,’ও একটু বড় হোক,তারপর না হয়…।’ 
 অন্যদিকে বুড়ো পাখির ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। যে ছেলে বিয়ের আগে সারাদিন টইটই,বিয়ে হতেই সে ঘরের পোষমানা ময়না। বাইরে কাজ ছাড়া যেতেই চায় না। এক গ্লাস জল গড়িয়েও যে জীবনে খায়নি,বিয়ের পর তাকে দেখা যায়,গ্যাস জ্বেলে চা করতে,দুধ গরম করতে। অফিসে সারাটা কর্মজীবন যিনি অধস্তনদের দাবকে এসেছেন,রিটায়ারমেন্টের পর তাঁকে বাজারের ব্যাগ হাতে ধরিয়ে সংসার সকলের অধস্তন করে ফেলে অক্লেশে। আবার জীবন সায়াহ্নে নিজ আবাসের খাঁচাটি থেকে ‘বৃদ্ধাবাস’ নামক অন্য খাঁচায় গিয়ে মৃত্যুকাল  অব্দি বৃদ্ধাবাসের নিয়মকানুনেও তিনি দিব্যি পোষ মেনে যা্ন! 
অতি প্রচলিত আর একটি প্রবচন-‘পাগলে কী না বলে,ছাগলে কী না খায়’। প্রবচনটির দুটি ভাগ। প্রথম ভাগটিতে রয়েছে একটু বেশি কথা বলা সরল স্পষ্টবাদী লোকেদের প্রতি বিদ্রূপ আর দ্বিতীয় ভাগটিতে আছে একটু স্থুলবুদ্ধির লোক,যাদের অতি সহজে বোকা বানানো যায়,তাদের প্রতি অবজ্ঞা বা অবহেলা। 
এখন কথা হল,পাগলেরা অনেক কিছু বললেও মিথ্যে কথা কিন্তু কদাচ বলে না। আর ছাগলদের সব কিছু খাওয়ানো গেলেও ঘুষ বা উৎকোচ কিন্তু কিছুতেই খাওয়ানো যাবে না। পাগল এবং ছাগলেরা স্বভাবে সরল হাদা বোকা হতে পারে,তাদের ন্যায় অন্যায় বোধটি কিন্তু প্রখর। সুতরাং প্রবাদবাক্যটি ঠিক থাকল কি?
 বরং বলা যায়,এতকাল পাগলের বলা আর ছাগলের খাওয়া নিয়ে আমরা জ্ঞানীগুণীজন টিপ্পনি কেটে একদিকে যেমন সঠিক তথ্য দিইনি,তেমনি নিজেদেরকে নিজেরাই ছোট করেছি। চারদিকে এখন যে পরিমাণ্ ভেতর-চাপা,ধড়িবাজ আর অসৎ লোকের ভিড় তাতে কিন্তু সময় এসেছে টিপ্পনি না কেটে পাগল ও ছাগলকে জাতে তোলার। প্রবাদবাক্যটি তো এরকম হতেই পারেঃপাগলে মিথ্যে বলে না,ছাগলে ঘুষ খায় না।
বাংলা প্রবাদ প্রবচনের ভান্ডার বিশাল। যুগের প্রয়োজনে তার থেকে মাত্র কয়েকটিই তুলেছি। আলোচনা শেষ করা যাক এই জনপ্রিয় প্রবচন-‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ দিয়ে। ঘটনা হল প্রবচনটি এত বহুল প্রচলিত যে বেশ অনেক কাল ধরেই গেঁয়ো যোগীরা সতর্ক। গেঁয়ো যোগীরা সব জেনেই তাই গ্রামে ভিক্ষায় বের হয় এবং ভিক্ষা পাবার জন্য নেয় নতুন নতুন পথ।
ছোট বেলায় দেখা সেই রাজমিস্ত্রিটির কথাই ধরা যাক। গ্রামে তার রুজি রোজগার সবই ছিল ওই দেওয়াল গেঁথে। এবং গুণেমানে কাজটা তার খারাপও ছিল না। কিন্তু যেহেতু গেঁয়োযোগী তাই অনেকেই তার বদলে ভিন গ্রামের রাজমিস্ত্রি নিয়ে কাজ করাত। বেশি ও নতুন কাজের ধান্দায় গ্রামের রাজমিস্ত্রিটি এরপর শহরে গেল। শহরে গিয়ে সে নতুন কোনও কাজ শিখল না,কেবল শিখল দেওয়ালকে ‘ওয়াল’ বলতে। কিছুদিন পরে গ্রামে ফিরে সে  তার ওইটুকু অধীত বিদ্যাতেই বাজিমাৎ করল। গ্রামে তার কদর বেড়ে গেল। কেননা সে তো আর এখন দেওয়াল গাঁথে না,’ওয়াল’ গাঁথে।
এখন অবশ্য গ্রামের চিত্রপট বদলে গেছে পুরোটাই। সত্যি কথা বলতে কী, গ্রামে এখন যোগীরই বড় অভাব। রাজমিস্ত্রিটি যোগী হয়েও তার গ্রামে ফিরেছিল। এখন বেশিভাগই কিন্তু ফেরে না। যোগীটি নিজেকে যোগী বুঝতে শিখলেই পাকাপাকিভাবে পাড়ি দেয় নিকট বা দূরের শহরে। যথার্থ যোগীকে ঠিকঠাক মূল্য না দেওয়ার মাসুল গ্রামকে অবশ্য এখন গুনতে হয় ভিন্নভাবে।
মাঝারি,ছোট যে সব যোগী গ্রামের উপেক্ষা সয়েও থেকে গিয়েছিল গ্রামে,এখনকার পরিবর্তিত  পরিস্থিতিতে তারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এদের কেউ পঞ্চায়েতের গদি আঁটা চেয়ারে বসে লুটপাট চালাচ্ছে,কেউ সাজিয়ে বসেছে বিদ্যার বেসাতি-ভুল্ভাল টিউশন দিয়ে রোজগার করছে মোটা অঙ্কের টাকা। আবার কেউ হাতুড়ে ডাক্তার সেজে অনেক পাশ করা ডাক্তারের রোজগারকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে।
আসলে গ্রাম এখন যোগীদের মূল্য দিতে শিখেছে কিন্তু সে মূল্য চেটেপুটে খাচ্ছে যোগীর ছদ্মবেশে ভোগীর দল। আর এর ফল? গ্রাম ছিল যে তিমিরে থেকে যাচ্ছে সেই তিমিরেই। ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ প্রবচনটি রূপে রূপকে যেভাবেই ব্যবহৃত হোক,ব্যবহারের আগে যেন একবার ভাবি এইসব। এবং এই ভাবনা থেকেই যেন উঠে আসে পুনর্লিখনের নতুন শব্দগুচ্ছ।