Blog

কথাঃজাতীয় শিক্ষানীতি২০২০(National Educational Policy 2020


কথাঃ
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০
-‘সবচেয়ে ভাল লাগে কোন বিষয়গুলো?’
আজকাল এই প্রশ্নের জবাব ভাল ছাত্রদের কাছ থেকেও পাওয়া কঠিন। ফলে প্রশ্নটাকে আরও ভেঙে ভেঙে করতে হয়।
-‘অঙ্ক কেমন লাগে?’
-‘খুব ভাল স্যার।’
-‘ইংরেজি?’
-‘ভাল। তবে বাংলাটা বেশি ভাল।’
-‘আচ্ছা। -ইতিহাস?’
-‘ভাল না।’
-‘ভূগোল?’
-‘খুব ভাল স্যার।’
-ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির মধ্যে কোনটা অঙ্ক,ইংরেজি,ভূগোলের মত ভাল লাগে?’
-‘ফিজিক্স,ফিজিক্স স্যার।’
-‘আর বায়োলজি?’
-‘দারুণ লাগে,দারুণ স্যার।’
মনে মনে ছাত্রের খুব ভাল লাগা বিষয়গুলো জড়ো করি এক জায়গায়। অঙ্ক, বাংলা,ভূগোল,ফিজিক্স, বায়োলজি।
বিচিত্র এক পাঁচের সংকলন। চলতি নিয়মে, এইচ এসে বাংলা বাদে বাকি চারের অবস্থান একই গ্রুপে। যেখান থেকে মোট চারটে সাবজেক্ট নেওয়া যাবে না তা নয়। তবে একটিকে থাকতে হবে গুরুত্বহীনের কোঠায়। পরীক্ষায় অন্য তিনের কেউ বিপাকে পড়লে, সে যদি সুবিধাজনক জায়গায় থাকে তবে বিপাকে পড়াকে মিউট করে তার বাটন জ্বলে উঠবে। আর বাংলার মত ইংরেজি কম্পালসারি বিষয়, বাদ দেওয়া যাবে না কিছুতেই। এ গেল নিয়মের কথা।
নিয়মের বাইরে আরও কিছু নিজেদের নিয়ম থাকে। যেমন এমনিতে অঙ্কের বিপরীত শব্দের নাম বায়োলজি। কিন্তু তবু সে থাকবে, এইচ এসের পর কেরিয়ারের নৌকোটাকে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং যে কোনও দিকেই যাতে চালনা করা যায়। আবার ওই একই জয়েন্টের কারণে কেমিস্ট্রির কেরামতি অসহ্য লাগলেও তার তর্জন গর্জন মেনে নিতে হবে মুখ বুজে। এই পাঁচের দলে ভূগোল বড়ই বেমানান। চলতি নিয়মে এই দলে তার থাকাটা নীতিতে না আটকালেও লাভালাভের হিসেবনিকেশ করতে গিয়ে সে বেচারাকে মুখ নিচু করে বাইরেই দাঁড়াতে হবে ।
কিন্তু যদি এমন সংকলন সম্ভব হয় কোনও যাদুমন্ত্রবলে! ছাত্রটি নিশ্চয় চেঁচিয়ে বলে উঠবে-‘হিপ হিপ হুররে!’
বাঁকা চোখে তাকানোর লোকের অভাব নেই।–‘ইংরেজিটা বাদ দিচ্ছিস,পরে ভুগবি।’ অনেকটা এখনকার সেই কথাটার মত।-‘ ছেলেকে বাংলা মিডিয়ামে দিয়েছেন!পরে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতাগুলো সামলাতে পারবে?’
এখানে উত্তর একটাই। পারবে। কারণ, ‘যে পারে সে আপনি পারে,পারে সে ফুল ফোটাতে।’ যিনি বলছেন,অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল থেকে পাশ দিয়ে তিনিও হয়তো এককালে আইআইটিতে বা শিবপুরে বা আরজিকরে গিয়েছিলেন। খুব কি অসুবিধা হয়েছিল মেধা দিয়ে ভাষা-সমস্যা জয় করতে?
কেউ বলে উঠবে, ‘কেমিস্ট্রি না পড়লে বায়োলজির জ্ঞান কতটুকু পাবে?আজকাল তো বায়োলজিতে বেশ ভাল রকম কেমিস্ট্রির জ্ঞান দরকার।’ এখানে প্রশ্নটা কিন্তু ভালবাসার। ভালবেসে যে বায়োলজি পড়তে এল, যদি তার ভালবাসা যথার্থ হয়ে থাকে সে প্রয়োজনীয় কেমিস্ট্রির জ্ঞান ঠিকই আহরণ করে নিতে পারবে। সর্বজ্ঞানী রসায়নবিদেরা চোখ কপালে তুলে গেঁয়ো ভাষায় ফুট কাটতে পারেন-‘অতটা গুড় আধপোয়া নয়।’
অতটা গুড় কিন্তু আধপোয়াই। এখন তো প্রতিটা সাবজেক্টে দু তিনখানা শিক্ষককোচ। আটের দশকেও কিন্তু এরকম ছিল না। তখন বাবা মায়েদের এত সংগতিও ছিল না। এইচ এস লেভেলের সায়েন্সেও বড়জোর দুজন বাড়তি শিক্ষক দেওয়া হত। একজন অঙ্কের,একজন ইংরেজির। ফিজিক্স,কেমিস্ট্রির বৈতরণী ছাত্রটি নিজেই পার হত। গ্রামগঞ্জের স্কুলে সায়েন্সের সেকশন তখন খুব সবলও ছিল না বেশিরভাগ জায়গাতে। সেসব জায়গায় কাজটা কঠিন ছিল,কিন্তু অসম্ভব ছিল না নিশ্চয়ই। কারণ আমরা অনেকেই তো সে বাধা জয় করেই এতদূর এসেছি।
এখন ইন্টারনেট দাঁড়িয়ে রয়েছে সাহায্যের ডালি নিয়ে। তাই নিজের সাবজেক্টটিকে অন্যের কাছে অতটা দুরূহ নাই বা ভাবলেন শিক্ষকেরা! সব বিষয়ের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
বেশ মনে আছে,ছেলেবেলায় ইতিহাস পড়তে খুব ভালবাসতাম। কিন্তু লাইন ধরে পড়ার সেই যুগে সায়েন্স পড়তে গিয়ে ইতিহাস আর বিষয় হিসাবে নেওয়া হল না। আবার টেকনিক্যাল লাইনে পড়ার পর বাংলার প্রতি ভালবাসা মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌজন্যে যদি বা এমএ,নেট অর্জনে বাধা দিল না, কিন্তু গবেষণার জন্য নানা জায়গায় ছোটাছুটি করতে গিয়ে বুঝলাম নীতিতে না আটকালেও রক্ষণশীলদের নিজস্ব বিধানে আমাকে গ্রহণে আটকে যাচ্ছে সব জায়গায়। কারণ আমার স্নাতক স্তর বিটেক,মানে বাংলাহীন।
এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভিউ বোর্ডে এক্সপার্ট তো চোখ কপালে তুলে দিয়েছিলেন-‘আপনি বাংলা্য অনার্স পড়েননি? অথচ এসেছেন বাংলা নিয়ে গবেষণা করতে!’
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ এর অন্য দোষত্রুটি কিছু থাকতেই পারে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, শিক্ষার্থীর ভালবাসার পাশে এই নীতি কিছুটা হলেও দাঁড়াতে চায়। যেভাবে ভাবা হচ্ছে, সেভাবে সম্ভব হবে কি না ভবিষ্যতই বলবে। তবে নঞ তৎপুরুষের যুগে আশার একটা আলো জ্বলে ওঠাও তো কম ব্যাপার নয়!