কথাঃ আবোলতাবোল ( আজও যাঁরা পাশে)

 

Ami Mishuk | আমি মিশুক কথাঃ আবোলতাবোল ( আজও যাঁরা পাশে)

কথাঃআবোলতাবোল (আজও যাঁরা পাশে)

আজও যাঁরা পাশে

ওঁরা কেউ সুনীতি চাটুজ্যে বা রাধাকৃষ্ণণ নন। ওরা সাধারণ। তবু ওঁদের শিক্ষাকে পাথেয় করেই তো চলেছি আমরা লক্ষ কোটি জন। পড়া নিয়ে বা পড়ার বাইরে কত কথাই না রয়েছে তাঁদের! কিছু কিছু তো সারা জীবনের সঙ্গী। কারণে, অকারণেও।
কার্তিক স্যারের কথাই ধরা যাক। পড়ানোয় তেমন নাম ছিল না স্যারের। একটু ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। ক্লাসে এসে পড়ানোর চেয়ে জানলা দিয়ে চেয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। ‘কোলিয়ারীর বুকে’ বলে একটা বইও লিখেছিলেন। বাংলার স্যার। মাঝে মাঝে নিচু ক্লাসে ইংরেজি নিতেও আসতেন। আমরা তখন এইট। একদিন ইংরেজির ক্লাসে স্যার ‘অক্সিলিয়ারি ভার্ব’ পড়াতে এসে বললেন,’একটা খোঁড়া লোক হাঁটতে পারছে না,তাকে একটা লাঠি দেওয়া হল। এই লাঠিটা হল  ‘অক্সিলিয়ারি ভার্ব।’ আর একদিন ‘নাউন’ প্রসঙ্গে বললেন,’ যা দেখতে পাচ্ছ তা-ই ‘নাউন।’ এখন ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে আমিও স্যারকে কোট করি অহরহ।
এই এইটেই একদিন সুখেনবাবু,ভূগোলের স্যারের পরিবর্তে ক্লাসে এসে হাঁক পাড়লেন-‘কী পড়া আছে রে!’ আমরা ‘পৃথিবী’ বলতেই স্যার পকেট থেকে একটা লজেন্স বের করে বললেন-‘বল তো এটা কী লজেন্স?’ লজেন্সটাকে আমরা প্রায় সবাই-ই চিনি। বড্ড প্রিয় লজেন্স আমাদের। বেশ কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠলাম-‘লর্ডসের জেলি!’ সুখেন স্যার বললেন-‘পৃথিবীটাও হল এই,লর্ডসের জেলি। উপরে শক্ত,ভিতরে জেলির মত থকথকে।’ ট্রেনে উঠে আজ যখন লর্ডসের জেলি হেঁকে যায়,মনে পড়ে সুখেন স্যারের কথা।
ইতিহাসের স্যার বেশ চমৎকার করে বোঝাতেন। কিন্তু ইতিহাসে বেশিরভাগ ছাত্রেরই আগ্রহ কম। তাই পড়া করে আসত না প্রায় কেউই। স্যার কিন্তু নিয়ম করে পড়া ধরতেন। না পারলে মারতেন না। শুধু সেই ভাব সম্প্রসারণ-‘যারা শুধু মরে নাহি দেয় প্রাণ,কেহ কভু তাহাদের করেনি সম্মান’ এর আদলে সুর করে বলতেন-‘যারা শুধু আসে নাহি পারে পড়া,নামেতে ছাত্র তারা আসলেতে মরা।’ এর পর আবার পড়ানো শুরু করে বলতেন-‘এমন করে বোঝাই,তবু মড়াগুলো জ্যান্ত হয় না!’ এখন ক্লাসে বসে যখন দেখি,শুধু ইতিহাস নয়,সব বিষয়েই ছাত্রদের ওই একই ছবি,স্যারের ছড়াটা মনে পড়ে যায়।
এ্কসময় নাকি ইউনিভার্সিটিতে বাংলা কোশ্চেনও  ইংরেজিতে হত। তো সেবার এমএ তে নাকি একটা কোশ্চেন এসেছিল-‘হোয়াট আর দ্য থ্রি  ট্র্যাজিক এলিমেন্টস ইন কৃষ্ণকান্তের উইল?’ বাংলা ইকনোমিক্স দুটোতেই মাস্টার্স করা স্যার সেদিন  কলেজে টেক্সটাইল ইকনোমিক্স পড়াতে এসে গল্পের মুডে। স্যার বলে চলেন-‘কোশ্চেনটা দেখেই আমার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। আমি লিখলাম,  কলসির ডুবডুব,ঘাটের সিঁড়ির কানা,আর কোকিলের কুহু। তারপর ছ’পাতা জুড়ে চলল  বিশ্লেষণ।’ এরপর স্যারের যা দাবি সেটা নিয়ে অন্য স্যারেরাই হাসাহাসি করেছেন। তবে ইউনিভার্সিটির পরীক্ষক ঠিকানা  বের করে স্যারের বাড়িতে না এসে থাকলেও,স্যারের এ গল্প আজও বেশ মনে আছে। অথবা বলা যায় সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।
বিএড পড়তে গিয়ে ওয়াল ম্যাগাজিনে কবিতা দেওয়া নিয়ে ক্লাসে কথা হচ্ছিল। এতে ইন্টারনাল মার্কস আছে। এক ডেপুটেড শিক্ষক-ছাত্র বলে উঠল-‘এটা বাড়াবাড়ি। আমি অঙ্কের লোক,ওসব কবিতা ,কল্পনা কি আমাদের আসে?’  ক্লাস নিচ্ছিলেন সালাম স্যার। বললেন-‘কবিরা আর কতটুকু কল্পনা করে? আপনারা যে সমগ্র অংশটাকেই কখনও কখনও এক্স হিসাবে কল্পনা করে বসেন। কাজেই একথা বলবেন না,অঙ্কের লোক বলে কবিতা,কল্পনা আসে না!’
অঙ্কের স্যারের কবিতা নিয়ে কথা হচ্ছে। আমাদের স্কুলের অঙ্ক স্যার বিষ্ণুবাবু কিন্তু সত্যি সত্যিই কবিতা লিখতেন। তবে উপমা টুপমা সবই অঙ্কের। সে বার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে স্যার স্বরচিত কবিতা শোনালেন। যার চার লাইন-‘একটা রবির উন্নতিকোণে/ তালগাছ মাপা যায়-/ একটা রবির  প্রগতি-ভাবনা/ বিন্যাসে সমবায়।’