Blog
কথাঃআবোলতাবোল
কলেজের দিন
গোল আকারের বিস্কুট।অথচ নাম,লম্বু। কে না অবাক হবে! কল্পনা্র ঘোড়া ছুটিয়ে রীতিমত গবেষণায় নামে সুব্রত। জয়দীপ তাল দেয়। আমি চুপ।
স্কোয়ারফিল্ডের পাশে চিলতে চায়ের দোকান। শহুরে সহপাঠী জয়দীপ,সঙ্গে আমরা দুই পাড়গেঁয়ে ভূত। শীতের দুপুরে টিফিনে এসেছি তিনজনে। চা খাব,খাব লম্বু। খাওয়াবে জয়দীপই। জয়দীপ ছাড়া চা-লম্বুতে টিফিন তখন সুব্রতর কিছুটা সীমার মধ্যে থাকলেও আমার পকেটের ভূগোলে ভাবাই যায় না। ডানহাতে লম্বু,বাঁ হাতে চায়ের কাপ এমনিতেই সঙ্কোচে থরথর। তার উপর ওরকম উটকো গবেষণায় ঢোকা- আমার কাছে বাড়াবাড়ি লাগে।
মুর্শিদাবাদের আঁচল ছোঁয়া নদীয়ার গ্রাম। সেখান থেকে সাতসকালে যখন কলেজের উদ্দেশে বের হই, চলনে বলনে লেগে থাকে বেশ একটা গর্বের ভাব। জয়েন্ট দিয়ে টেক্সটাইল কলেজে ঢুকেছি; জনরব,পাশ করার আগে প্রবেশও করে যাব চাকরিতে। গর্ব হবে না! গ্রামের সীমানা ছাড়ালেই গর্ব কিন্তু গা থেকে খুলে যায়। আর যত কলেজের কাছাকাছি আসি মিইয়ে যাই একেবারে। ভিতরে কে যেন বলে ওঠে-‘হিথায় তুকে মানাইছে নাই গ’,ইক্কেবারেই মানাইছে নাই গ’।’
সত্যি বলতে কী,আমার বিবর্ণ পোশাক,ছেঁড়া জুতো দেখে এর সঙ্গে আমার কলেজের নাম ট্রেনের চেকারও মেলাতে পারেন না। বিনা টিকিটের কৈফিয়ৎস্বরূপ, ছাত্র পরিচয় দাখিল করলে, এক আধদিন ওঁদের কেউ জিজ্ঞেসও করে বসেন, ‘ইঞ্জিনীয়ারিং’ শব্দের স্পেলিং। কলেজেও কোণঠাসা। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কেতাদুরস্ত সহপাঠীরা মশকরা ছোঁড়ে,বন্ধুত্ব নয়। উঁচু ক্লাশের দাদারা আরও এককাঠি উপরে। এই ফার্স্টইয়ারের ছাত্রের জন্য তারা ঘোষণা দিয়েছে-‘এ ব্যাটা র্যাগিংয়েরও অযোগ্য।’ তবু এরই মধ্যে ব্যাচের সেরা ছাত্রটি আমার মধ্যে কী দেখেছে কেজানে,জুটেছে আমার সঙ্গেই। আর ওই জয়দীপের টানেই আমাদের দু-কামরার নির্জন ভুবনে যুক্ত হয়েছে সুব্রতর মত আরও এক আধটা খুপরি।
চা লম্বু খেতে খেতেই জয়দীপ হঠাৎ বলে বসে-‘১৯৪৭ সালের পনেরোই আগস্ট এই ব্যারাক স্কোয়ারের মাঠে কোন দেশের পতাকা উঠেছিল,জানিস?’
আর্থিক ভূগোলে তিনজনের মধ্যে যে সবচেয়ে দুর্বল,তার আবার ইতিহাস সঞ্চয়ে আগ্রহ প্রবল। মিইয়ে থাকা অবয়ব ইতিহাসের গন্ধ পেয়ে নড়েচড়ে বসে। বলি, ‘কোন দেশের?’ জয়দীপ বলে-‘পাকিস্তানের।কারণ সীমানা ভাগাভাগির নিয়মে মুর্শিদাবাদে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ বেশি হওয়ায়,মুর্শিদাবাদ প্রথমে গিয়েছিল পাকিস্তানে, আর খুলনা এদেশে। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ব্যবস্থাটা উল্টো করা হয়। ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে এখানে ওঠানো হয় ভারতের পতাকা।’
এই চায়ের দোকানে বসেই জয়দীপ ওঁর বাবার কাছে শোনা ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের আর এক গল্প বলে একদিন। গল্পটা বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে।
-‘বঙ্কিম তখন বহরমপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। একদিন পাল্কিতে করে কোর্ট থেকে ফিরছিলেন এই ব্যারাকের মাঠের পাশ দিয়ে। এই মাঠে ক্রিকেট খেলছিল গোরা সৈন্যরা। বঙ্কিমের পাল্কির একদিকে বন্ধ ছিল।সেনাদলের অধ্যক্ষ কর্ণেল ডফিন মাঠ থেকে এসে সেই বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন। বঙ্কিম পাল্কি থেকে লাফিয়ে নেমে ডফিনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন-‘কে রে তুই বর্বর?’ ডফিন কোনও কথা না বলে বঙ্কিমের হাত ধরে দূরে সরিয়ে দিলেন। পরদিন বঙ্কিম কোর্টে গিয়ে ডফিনের নামে মানহানির মামলা করলেন। বঙ্কিম মামলা করলে কোর্টের প্রায় দেড়শো উকিল-মোক্তার স্বেচ্ছায় বঙ্কিমের ওকালতনামায় সই করলেন।ডফিন মামলা চালাতে গিয়ে কোনও উকিল মোক্তার পেলেন না। বেগতিক দেখে প্রকাশ্য আদালতে ডফিন বঙ্কিমের হাত ধরে ক্ষমা চাইলেন। জয় হল বঙ্কিমের। তিনি মামলা তুলে নিলেন।’
তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে আমার হাতের চা সেদিন ঠান্ডা হয়ে যায়।–‘ওটা ফ্যাল।আর এক কাপ নে।’জয়দীপ তার গল্পের একনিষ্ঠ শ্রোতার জন্য সেদিন আরও এক কাপ চায়ের দাম বেশি গোনে।
শুধু কি এই ব্যারাক স্কোয়ারের পাশের চায়ের দোকান?ব্যারাকের মাঠটাও তো ছিল তখন আমাদের অলস আড্ডার জায়গা। এর আগে বাংলা ব্যাকরণে ‘বইমেলা’ শব্দের সমাস পড়লেও বইমেলা চাক্ষুষ করাও প্রথম এখানে। বই কিনব সে সামর্থ্য তখন ছিল না। ক্যাটালগ আর লিফলেট নিয়েছিলাম সেবার দুহাত ভরে। সে-বইমেলায় অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন। গান গেয়ে একেবারে মাত করে দিয়েছিলেন বইমেলার আসর।‘সুখহীন,নিশিদিন,পরাধীন হয়ে…’সেই যে শুনেছিলাম তাঁর গলায় সেদিন,সে শোনার মুগ্ধতা আজও রয়ে গেছে।
২০১৮ এর ডিসেম্বরে ব্যারাকের পার্শ্ববর্তী আমাদের সেই কলেজটার মেগা রি-ইঊনিঊনে জড়ো হয়েছিলাম প্রায়-সবাই। জয়দীপ এসেছিল। আমাদের ছোট্ট বন্ধুবৃত্তটার মধ্যে কেবল আসতে পারেনি সুব্রত। ও ছিল বাংলাদেশে। অনুষ্ঠানের ফাঁকে আমি আর জয়দীপ একবার গিয়ে দাঁডিয়েছিলাম ব্যারাকের মাঠে। তবে বেশিক্ষণ নয়। জয়দীপ বলছিল-‘ দাঁড়াতে পারছি না রে।এই মাঠে,মাঠের চারপাশে আমাদের সেইসব হারানো দিন হু হু করে ছুটে আসছে।’
আমিও অবাক। বহরমপুরবাসী হবার সুবাদে এই মাঠের পাশ দিয়ে কম যাওয়া হয় না। আর মাঠেও আসি নানান উপলক্ষ্যে। ফি বছর বইমেলাতে তো এখানে আসা বাঁধা। কখনও একা,কখনও সঙ্গে থাকে ছাত্র মৃণাল অথবা তাহের। ঘুরে ঘুরে দেখি বই,কিনিও কিছু। স্টলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কলেজকালে ব্যারাকের এই বইমেলার সময় লেখা আমার সেই তুচ্ছ ছড়াটাও তো কোনওবার তাহের (কোথায় ও পেয়েছে,ও-ই জানে) বলে যায়-‘কবে ছাপা হয়েছিল বই/বই কবে হয়েছিল/তোমার-আমার সই/বইমেলা এমনই হরেক প্রশ্ন/মনের দুয়ারে করাঘাত হেনে /মনকেই করে উষ্ণ…’ কিন্তু কই,এখানে ফেলে যাওয়া আমার সেই মলিন বেশবাসের যৌবন,দারিদ্রের সঙ্কোচ,জড়তা,ইতিহাস-মুগ্ধতা,প্রথম বইমেলা,অশোকতরু… সেভাবে তো…আজ কীভাবে সেইসব দিন এসে যাচ্ছে এত কাছাকাছি!
-‘চল সেই আগের মত লম্বু,চা খাই দুজনে।’ বলে জয়দীপ।আমি বলি-‘তুই এখন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট,তোকে কি মানাবে এইসব দোকানে!’
-‘মানাবে,খুব মানাবে। কারণ আমরা দুজনে তো টিফিনে বেরিয়েছি। মনে আছে তো এরপরে মনোজিৎ বাবুর ক্লাস-টেক্সটাইল কেমিস্ট্রি!..আর আজ সন্ধেয় কিন্তু প্রোগ্রাম ওই বইমেলা।’ ফাঁকা মাঠে কাল্পনিক বইমেলার প্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে শিল্পপতি জয়দীপ হঠাৎই যেন বত্রিশ বছর আগের জয়দীপ। এবং সেই পুরোনো গলায় হুবহু সেই সেদিনের কথাটিও-‘আজ সুব্রতদের মেসে থেকে যাস তুই। অশোকতরু আসছে…’
‘