Ami Mishuk | আমি মিশুক কথাঃ আবোলতাবোল ('বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না...')

কথাঃ আবোলতাবোল 

বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না

অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে,ধরতে একটু বাধো বাধো ঠেকেই। তবু না ধরেও পারা যায় না। কারণ অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে শুধু বিরক্তিকর অভিজ্ঞতাই হয় না,অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবরও মাঝেসাঝে মিলে যায়।

লকডাউনের বাজারে সেদিন সন্ধেয় একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। ইতস্তত করে ধরে যেই বলেছি ‘হ্যালো’,অমনি একটা জড়ানো কাঁপা-কাঁপা পুরুষ গলার আবৃত্তি-‘জীবন গিয়াছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার…’।‘রং নাম্বার’ বলে কাটতে যাব ফোনটা,এমন সময় ওই জড়ানো কন্ঠ বলে ওঠে-‘চিনতে পারলি  না!আমি দীপ্তেন্দু,-নবীন। ফেসবুক থেকে ফোননম্বর  যোগাড় করে  ফোন করছি।’  

মুহূর্তেই হু হু করে ছুটে চলে এল বাল্যকাল ;‘হরিহর আত্মা’ দুই কিশোরের বন্ধুত্ব। খুলে গেল হৃদয়ের  উদারা-মুদারা। কে যেন বলেছিল, বন্ধুত্বের চেয়ে বড় প্রেম আর নেই। মনে হল কথাটা মিথ্যে নয়।

যাঁরা একেলা জগৎ ভুলে পড়ে থাকেন আপন সংসার-কূলে,তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু গড়পড়তা বেশিরভাগ মানুষেরই ,পরিবার,আত্মীয়স্বজন যতই থাক বাইরের পৃথিবীটা চিনতে জানতে সর্বোপরি বেশ কিছু অনুভূতি শেয়ার করতে বন্ধু ছাড়া চলে কি!

হয়ত এ সম্পর্কও কখনও প্রতারণার ফাঁদ  পাতে। ঈর্ষায় জর্জরিত হয়। লোভের খপ্পরে পড়ে। অনেকসময়  চলে আসে ছুরি,রিভালবারও। তবু বন্ধুত্বের বন্ধন এড়াবে কে?

বন্ধুত্ব আমাদের অনেকের কাছেই বড় মায়ায় গড়া শব্দ। তাই একে খুন হতে দেখলে বুকে বাজে। যে  কোনও সম্পর্কের মত এখানেও টানাপোড়েন থাকতে পারে। কিছু ঈর্ষার কাঁটা, কিছু সন্দেহের তীর, উত্তরজীবনে আর্থিক অসাম্য জনিত কিছু উপেক্ষার চাহনি এসে একে বিব্রতও করতে পারে কখনওসখনও, কিন্তু উপসংহার  কোনও একজনের মৃত্যু দিয়ে  শেষ হলে তা  খুবই পরিতাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

অল্পবয়সের বন্ধুত্ব যদি দুজনেরই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাহলে সে-বন্ধুত্ব ঘিরে সমস্যা আসা নতুন কিছু নয়। আমাদের সাহিত্যে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের  বালি’তে বিনোদিনীকে  ঘিরে মহেন্দ্র আর বিহারীর বন্ধুত্বের কথাই ধরা যাক। মহেন্দ্র আর বিহারীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো মাঝে মাঝেই ঠোক্কর খেয়েছে। দু বন্ধুর মধ্যে দূরত্বও তৈরি হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই বন্ধুর আশৈশব অটল বন্ধুত্বের মহামূল্যই স্বীকৃত হয়েছে মহেন্দ্রর উপলব্ধির মাধ্যমে।  

‘গোরা’তে গোরা ও বিনয়ের বন্ধুত্বেও টানাপোড়েন এসেছে। তবে ‘চোখের বালি’র মত কোনও ত্রিকোণ  সমস্যাজনিত টানাপোড়েন নয়।এখানে দুই বন্ধুর সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয়েছে দুজনের আদর্শ ঘিরে। কিন্তু বন্ধুত্ব তা বলে হারিয়ে যায়নি। উপন্যাসের শেষই হয়েছে আনন্দময়ীর এই উক্তি দিয়ে-‘গোরা,এইবার একবার বিনয়কে ডেকে পাঠাই।’

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে টিকে থাকা বন্ধুত্ব আরও আছে।যেমন ‘চতুরঙ্গ’এ শচীশ,শ্রীবিলাস। এ বন্ধুত্ব অবশ্য শৈশবে গড়া নয়। বিএ পড়তে এসে শ্রীবিলাস শচীশের বন্ধুত্বে বাঁধা পড়ে।মাঝখানে দামিনী সংযোগে এখানেও একটা ত্রিকোণ প্রেমের আবহ তৈরি হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব বধ্যভূমিতে যায় না,বরং রক্ষিত হয় অশেষ গরিমায়।

 আদর্শ বন্ধুত্ব বলতে যা বুঝি বাংলাসাহিত্যে তাও নেহাৎ কম নেই। এর মধ্যে সেরা হবার মত বন্ধুত্বটি সম্ভবত রচনা করে গেছেন শরৎচন্দ্র। ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্তের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব ছেলেবেলায় আমাদের কাকে না  উত্তেজিত,উদ্বুদ্ধ করেছে! এখানে কোনও টানাপোড়েন নেই,কোনও অশুভ ছায়াপাত নেই,বন্ধুত্ব এখানে যথার্থই প্রেমে পর্যবসিত। ইন্দ্রনাথের দুঃসাহসিক অভিযান,মানবিক কর্মকান্ডের শ্রীকান্ত শুধু সঙ্গী নয়, মুগ্ধ দর্শকও। তাই হয়তো সেসবের বর্ণনা চিরকালের মত গেঁথে গেছে আমাদের মনে।   

‘পথের পাঁচালী’র অপু-পটু জুটির যাত্রা ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্তের মতই কৈশোরের বাঁকে থেমে গেছে। কিন্তু এই বন্ধুত্বও যতটুকু পাতা জুড়ে,সবটুকুই মধুরতায় ভরা। হয়ত এই বন্ধুজুটি বাংলাসাহিত্যে তত বিখ্যাত নয়,  কিন্তু   মনে রাখার মত তো বটেই। মালিন্যহীন এই বন্ধুত্ব অপুর নিশ্চিন্দিপুর ছাড়ার পরে একদা মামজোয়ানের মেলায় চকিতে  ফিরে এসে অচিরকালের মধ্যেই আবার দূরে চলে যায়। আমাদের অনেক দূরে যাওয়া-সরে যাওয়া বন্ধুত্বের মতই।    

আসলে বন্ধু কেউ থাকে,কেউ চলে যায়,আবার নতুন বন্ধু এসে যোগও দেয় জীবনের স্রোতে। এটাই নিয়ম। আর এখন তো সোস্যাল মিডিয়ার যুগ। এতে একবার প্রবেশ করলে অজস্র বন্ধুর হাতছানি। বন্ধু নিয়ে একসময় আমাদের উপর পরিবারের নানা নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর সঙ্গে মেশা যাবে না,ওর সঙ্গে কম মিশবে ইত্যাদি। গড়ে ও বেড়ে ওঠার বয়সে বন্ধু নির্বাচনে সাবধান করে দেওয়াটা অভিভাবকদের অন্যায় নয়। কিন্তু পরিণত বয়সে কে সাবধান করবে? অথচ সোস্যাল মিডিয়ায় বন্ধুর ছদ্মবেশে অনেকসময় এসে  হাজির হয় প্রতারক। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ,একথা মেনে নিয়েও বলা যায়, ভার্চুয়াল বন্ধুত্বে আস্থা রাখার আগে একটু যাচিয়ে নেওয়া দরকার।

তবে বিপদ যে শুধু এখানেই ওৎ পেতে আছে তা তো নয়। অস্থিরতা একালের যুগধর্ম। আর তাছাড়া সাহিত্য নামক যে যাদুকাঠির ছোঁয়ায় মন প্রসারিত হয়, আসে জীবনকে জানার সেই পিপাসা যাতে ভর করে মানুষ হাত বাড়ায় একে অপরের দিকে,তা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। হয়ত এ কারণেই  অল্পবয়সের বন্ধুত্বেও এখন সামান্য কারণে ভুল বোঝাবুঝি চলে  আসে। এবং বন্ধুত্ব কখনও বিধ্বংসী আকারও নিয়ে নেয়।  

আমরা সৌভাগ্যবান।আমাদের সাহিত্য ছিল।জীবন ঘিরে আমাদের তেমন অস্থিরতাও ছিল না। জানি না সেসব কারণে কিনা,বৃহত্তর জীবনের ডাকে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্ব,বহু বছর পরে ফোনে ফিরে পেয়ে সেদিন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ চলে এ প্রান্তে। ও প্রান্তের আবেগ বুঝিয়ে দেয়, একই অবস্থা ওখানেও।