কথাঃ আবোলতাবোল (স্কুল পরিদর্শন)

 স্কুল পরিদর্শন

বিদ্যাসাগর গিয়েছেন এক গ্রামের স্কুলে। স্কুল-পরিদর্শনে। উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের ভূগোলের বিদ্যা পরীক্ষা করতে তিনি একজন ছাত্রকে শুধোলেন-‘ বল তো,পৃথিবীর কত রকম গতি আছে? আর কোন গতির জন্য কত সময় লাগে?

ছেলেটি জবাব দিল-‘পৃথিবীর তো কোনও গতি নেই।পৃথিবী স্থির হয়ে আছে।আর পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে সূর্য।’

এক এক করে সব ছেলেকে জিজ্ঞেস করে একই উত্তর পেলেন বিদ্যাসাগর।

বিদ্যাসাগর ভাবলেন নিশ্চয় ,স্কুলের পন্ডিতমশাই এরকমই শিখিয়েছেন ছাত্রদের। তবু ব্যাপারটা যাচাই করার জন্য পন্ডিতমশাইকে ধরলেন।-‘ছেলেরা কী বলছে এসব? পৃথিবী নাকি স্থির,আর সূর্য ঘুরছে   পৃথিবীর চারদিকে!’

 পন্ডিতমশাই বললেন-‘কেন কথাটা কি ভুল?’

-‘ভুল তো বটেই। পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে,আপনি জানেন না?’

যেন কোনও আশ্চর্য কথা শুনছেন,এমনিভাবে পন্ডিতমশাই তাকালেন বিদ্যাসাগরের দিকে।–‘সত্যি সত্যি পৃথিবী ঘোরে নাকি? আমি ভাবতাম পৃথিবী এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে।’

বিদ্যাসাগরের মতো ভূদেব মুখোপাধ্যায়কেও অনেকদিন স্কুল ইনেস্পেক্টারের দায়িত্ব সামলাতে হয়। স্কুল ইনেস্পেকশানের সময় তাঁর একটা মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার। তবে এখানে শিক্ষককেন্দ্রিক ঘটনা  নয়। ঘটনাটি বই কেন্দ্রিক।

এক স্কুলে গিয়েছেন ভূদেব। একটা ক্লাশে গিয়ে দেখলেন,পড়ানো হচ্ছে জ্যামিতি। বইটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন ভূদেব। বইয়ের লেখকটি তাঁর চেনা। তাঁরই অধীনে তিনি একজন সাব ইনেসপেক্টার। ভূদেব বইটা দেখতে দেখতে এক জায়গায় একটা মারাত্মক ভুল পেলেন। ভুলটা  পেন দিয়ে কেটে সংশোধন করে দিলেন ভূদেব। ক্লাশের শিক্ষককে বললেন-‘সব ছাত্রকে ভুলটা সংশোধন করে নিতে  বলবেন।’

কিছুদিন পরে ওই জ্যামিতি বইয়ের লেখক সাব ইনেস্পেক্টার এলেন ওই স্কুল পরিদর্শন করতে। এসে শুনলেন ভূদেববাবু তাঁর বই পেন দিয়ে কেটে ঠিক করে দিয়ে গেছেন। শুনেই তো ইনেসপেক্টারের মাথা গরম হয়ে গেল। হলেই বা তিনি অধীনস্থ। তাই বলে তাঁর বই কাটা! বললেন-‘ভূদেববাবু আমার বই কলম দিয়ে কেটেছেন। আমি তাঁর বই কোদাল দিয়ে কাটব।’

সাব ইনেসপেক্টারের এই কথা ভূদেবের কানে পৌঁছল । কোদালের কথাটা শুনেই ভুদেব হেসে ফেললেন। গ্রন্থকার সাব ইনেস্পেক্টার জাতিতে ছিলেন উগ্রক্ষত্রিয়,কৃষিজীবী পরিবার থেকে উঠে আসা। হাসতে হাসতে ভূদেব বললেন-‘সকলেই নিজ নিজ হাতের যন্ত্র ব্যবহার করে,এতে আশ্চর্যের কী আছে?’  

একালে স্কুল পরিদর্শনে সেই হরধনু ভাঙার গল্পটা বেশ জনপ্রিয়। একবার স্কুল পরিদর্শন করতে গিয়ে এক ইনেস্পেক্টার এক ছাত্রকে শুধোলেন-‘ বলো,হরধনু কে ভেঙেছে?’ হরধনূ ভাঙার গল্প পুরাণে রয়েছে, সিলেবাসে নেই। ছাত্র জানবে কোথা থেকে? হরধনু কে ভেঙেছে,এ প্রশ্ন শুনে সে ভাবল, নিশ্চয় হরধনু স্কুলের কোনও জিনিস। সেটা কোনও কারণে ভেঙে যাওয়ায় তাকে দোষী করা হচ্ছে। ছাত্র বলল-‘আমি ভাঙিনি।’  এরপর সে গল্প কোথায় গড়িয়েছিল তা আমাদের অনেকেরই জানা।

এরকমই আর একটি গল্প। এক স্কুল ইনেস্পেক্টার গেছেন স্কুলে। প্রাথমিক স্কুল। একেবারে ঝাঁ চকচকে চারিদিক। স্কুল ইনেসপেক্টার মশাই তো বেজায় খুশি। এবার  বেরোলেন ক্লাশ দেখতে। ফোরের ক্লাশে গিয়ে একটা ছাত্রকে শুধোলেন-‘বলো তো ভারতের রাজধানী কী?’

নিরুত্তর ছাত্র।

ইনেস্পেক্টার ছাত্রটির কাছ থেকে যে কোনও উপায়ে উত্তর বের করবেনই। তাই প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করলেন-‘বেশ বলো,দিল্লি ভারতের কী?’

এবারেও ছাত্র নিরুত্তর।

এবার এগিয়ে এলেন শিক্ষক। বললেন, ‘এখন তো ছোট প্রশ্নের যুগ। আমি জিজ্ঞেস করছি প্রশ্নটা। দেখুন তো পারে কি না!’

শিক্ষকমশাই ছাত্রটিকে জিজ্ঞেস করলেন-‘বলো তো দিল্লি ভারতের কী ধানী?’

এবার সরব ছাত্র।–‘রাজধানী’।

স্কুল ইনেসপেক্টারের দিকে শিক্ষকমশাইয়ের গর্বিত চাহনি-‘দেখলেন!’

সত্যি,আধাসত্যি,বানানো এইসব গল্প যে কালেরই হোক, এ আসলে কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষারই  চালচিত্র।

যাঁদের কাছে শিক্ষাদান ব্রত তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু সাধারণভাবে আজও ,কোথাও সঠিক কী শিক্ষা   দেওয়া হবে সেটাই যেমন শিক্ষকের জানা নেই তেমনি কোথাও সিলেবাসের বাইরে মানেই ছাত্র শিক্ষক সবার কাছে এক অচেনা পৃথিবী।  কোথাও আবার রয়েছে সুশিক্ষার জন্য গৃহীত যে কোনও ব্যবস্থাকে সরল করে ফেলার প্রবণতা।

বিদ্যাসাগরের পন্ডিতমশাই কম জানলেও অজ্ঞতা চাপা দেননি। এই সততার তো এখন বিলক্ষণ অভাব!