Blog
গরুর গাড়ির ক’টি চাকা

আলাপনের বিয়েতে বরযাত্রী যাচ্ছি। পিচঢালা মসৃন রাস্তা। চারচাকা এসিতে আলাপন। পাশে আমরা ক’জন।
-‘আমার বিয়েতে সবাই গিয়েছিলাম বাসে।’ কিছুটা যেতেই বললেন এক বয়স্ক সহকর্মী।
সমবয়সী সহকর্মী বন্ধু তমাল এক বয়স্ক সহযাত্রীকে শুধোল-‘কাকু আপনিও কি বাসে গিয়েছিলেন বিয়ে করতে?’ বরবেশী আলাপন রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল-‘কাকুর বিয়ের গাড়ির কথা শুধোচ্ছিস? আমি জানি। বাবার মুখে শোনা। কাকু বিয়ে করতে গিয়েছিল দশচাকার গাড়িতে।’
-‘দশচাকার গাড়ি!’ তমাল শহুরে ছেলে,বুঝতে না পেরে তাকাল আলাপনের দিকে।
আমি হেসে বললাম-‘দশচাকার গাড়ি মানে হল গরুর গাড়ি।’
দশচাকার গাড়ির রসিকতা তমাল বোঝেনি। এখনকার শহুরে ছেলেরা তো আরও বুঝবে না! গ্রামের ছেলেরাও কি বুঝবে?
সেদিন গ্রামের বাড়িতে শরৎচন্দ্রের মেজদিদি দেখছিলাম টিভিতে। সেই কাননদেবীর করা মেজদিদি নয়। একালের অভিনেতা অভিনেত্রীদের করা ‘মেজদিদি’।
ছবির প্রায় শেষদিকে মেজদিদি গরুর গাড়ি করে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছেন,এমন সময় কাজের মেয়ে চুমকি তার ছোট ভাই গোপালকে আঙুল দেখিয়ে বলল-‘দ্যাখ দ্যাখ অ-আ বইয়ের গরুর গাড়ি।’
চমকে উঠলাম। জায়গাটা তো গ্রামই। আর চুমকিরা যেখানে থাকে সেটা আরও গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা হয়ে চুমকিদের গরুর গাড়ি দেখার দৌড় এখন তা হলে অ-আ বই আর সিনেমা! গরুর গাড়ি গ্রামদেশেও এতটা দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে বুঝিনি তো!
বড় রাস্তার ধারে বাল্যবন্ধু অশোকের চালের দোকান। গ্রামে গেলে,বিকেলে ওখানে কিছুক্ষণ বসি। সেদিন অশোককেই শুধোলাম-‘গ্রামে এখন কারও বাড়ি গরুর গাড়ি আছে রে?’
উত্তরে যতটা ভেবেছিলাম,অশোক তার চাইতেও খারাপ খবর দিল। ওর কথায়,আমাদের গ্রাম তো বটেই, আশেপাশের গ্রামেও কারও বাড়িতে এখন গরুর গাড়ির দেখা পাওয়া যাবে না।
গরুর গাড়ির প্রয়োজন তাহলে ফুরিয়েছে! অশোক বলল-‘গ্রামের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক ওলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছে ভ্যান রিকশা। এর সুবিধা অনেক। যেখানে সেখানে ঢুকতে পারে,খরচ কম,উপরন্তু দ্রুতগামী। অন্যদিকে গরুর গাড়ির অসুবিধা নানা ধরণের। গরু চাই,গাড়োয়ান চাই। আবার এগুলো দিয়েও এই দ্রুতগামিতার যুগে বরণ করে নিতে হবে মান্ধাতা আমলের শ্লথগতি। এ আবার হয় নাকি!’
বাড়ির পাশেই কুমোরবাড়ি। এতদিন খেয়াল করিনি। এবার দেখলাম,রবীন্দ্রনাথ কুমোরপাড়া থেকে বংশীবদন আর ভাগ্নে মদনকে দিয়ে সেই যে গরুর গাড়ি খানাকে যুগ যুগ ধরে বের করে আনছেন সেই জায়গাতেও কামড় বসিয়েছে ভ্যানরিকশা। দেখলাম, এই ভ্যান রিকশায় বাঁশের বাখারি দিয়ে কাঠের পাটাতনখানাকে চারদিক বরাবর ঘিরে হাঁড়ি-কলসি রাখার বেশ সুবন্দোবস্ত রয়েছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। গরুর গাড়ি চলার ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ সেই সুদূর অতীত থেকে ভেসে আসছে। শুধু বাস্তবের নয়,বইয়ের পাতারও। কত গল্প উপন্যাসেরই না সার্থক অনুষঙ্গ হিসাবে এসেছে গরুর গাড়ি!
মনে করা যাক ‘পথের পাঁচালী’র সেই দৃশ্যটা, যেখানে মা ও বাবার সঙ্গে অপু চিরকালের মতো নিশ্চিন্দিপুরের সীমানা পেরোচ্ছে হীরু গাড়োয়ানের গরুর গাড়ি চেপে। গরুর গাড়ির জায়গায় অপুদের যাত্রা যদি ভ্যান রিকশায় হত তবে চিত্রটা এত নিখুঁত হত কি? নিশ্চিন্দিপুরের ক্রম-অপসৃয়মানতার জরুরি আবহসঙ্গীতটি গরুর গাড়ি ছাড়া আর কোন যান রচনা করতে পারত!
গতির যুগ এটা। গরুর গাড়ির তো হারিয়ে যাওয়ারই কথা। অথচ এককালে যান বলতে ছিল গরুর গাড়িই। মালপত্র বহন তো বটেই,এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম যাওয়া,এমনকী দূরপাল্লার যাত্রাতেও অনেক সময় গরুর গাড়ির সাহায্য নেওয়া হত।
শোনা যায়,১৮৭৮ সালে,স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবেনেশ্বরী দেবী,ভাষাবিদ হরিনাথ দের মা এলোকেশীদেবীর সঙ্গে চব্বিশ পরগনা থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন এই গরুর গাড়িতেই। তাঁদের কর্তারা তখন ওখানকার বড় চাকুরে। গরুর গাড়িতে ওই দীর্ঘ পথযাত্রায় বালক হরিনাথ ও বিবেকানন্দ (তখন নরেন্দ্রনাথ) সঙ্গীও হয়েছিলেন।
গরুর গাড়িতে দীর্ঘযাত্রার আরও উদাহরণ আছে। রামতনু লাহিড়ীর নিরুদ্দিষ্ট দাদা দ্বারকানাথ লাহিড়ীর সন্ধান পেয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে রামতনুর মা কৃষ্ণনগর থেকে আগ্রা গিয়েছিলেন গরুর গাড়ি চেপে।
অশোকের দোকানে বসে এসব ভাবছিলাম। আর মনে হচ্ছিল,একে একে গ্রামজীবনের কত অনুষঙ্গই না হারিয়ে গেল! আমাদের ঢেঁকি গিয়েছে। কলুটানা ঘানি ইতিহাসের পাতায়। তালপাতার ছাতা তো এখন প্রাগৈতিহাসিক জিনিস,কাউকে বিশ্বাসই করানো যাবে না এরকম একটা আশ্চর্য জিনিস একসময় দেখা যেত গাঁ-গেরামে। গরুর গাড়িও নিঃশব্দে এই চলে যাওয়াদের মহামিছিলে যোগ দিয়েছে ।
সেদিন কাগজ পড়ছিলাম, আর পাশে বসে স্কুলের কাজ সারছিল ছেলে। ওর অঙ্ক বইয়ের চৌকো ঘরে ইংরেজি সংখ্যায় লিখতে হবে বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর। প্রথম প্রশ্ন, গরুর কটি পা। সেটা লিখেই ছেলে দাঁড়িয়ে গেল দ্বিতীয় প্রশ্নে। কারণ দ্বিতীয় প্রশ্নটা বেশ কঠিন। রসিকতা নয়, সঠিক উত্তরটাই বসাতে হবে। ছেলে রুল মুখে নিয়ে চিন্তিত। কী হল? ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘গরুর গাড়ির কটি চাকা বাবা?’

আলাপনের বিয়েতে বরযাত্রী যাচ্ছি। পিচঢালা মসৃন রাস্তা। চারচাকা এসিতে আলাপন। পাশে আমরা ক’জন।
-‘আমার বিয়েতে সবাই গিয়েছিলাম বাসে।’ কিছুটা যেতেই বললেন এক বয়স্ক সহকর্মী।
সমবয়সী সহকর্মী বন্ধু তমাল এক বয়স্ক সহযাত্রীকে শুধোল-‘কাকু আপনিও কি বাসে গিয়েছিলেন বিয়ে করতে?’ বরবেশী আলাপন রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল-‘কাকুর বিয়ের গাড়ির কথা শুধোচ্ছিস? আমি জানি। বাবার মুখে শোনা। কাকু বিয়ে করতে গিয়েছিল দশচাকার গাড়িতে।’
-‘দশচাকার গাড়ি!’ তমাল শহুরে ছেলে,বুঝতে না পেরে তাকাল আলাপনের দিকে।
আমি হেসে বললাম-‘দশচাকার গাড়ি মানে হল গরুর গাড়ি।’
দশচাকার গাড়ির রসিকতা তমাল বোঝেনি। এখনকার শহুরে ছেলেরা তো আরও বুঝবে না! গ্রামের ছেলেরাও কি বুঝবে?
সেদিন গ্রামের বাড়িতে শরৎচন্দ্রের মেজদিদি দেখছিলাম টিভিতে। সেই কাননদেবীর করা মেজদিদি নয়। একালের অভিনেতা অভিনেত্রীদের করা ‘মেজদিদি’।
ছবির প্রায় শেষদিকে মেজদিদি গরুর গাড়ি করে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছেন,এমন সময় কাজের মেয়ে চুমকি তার ছোট ভাই গোপালকে আঙুল দেখিয়ে বলল-‘দ্যাখ দ্যাখ অ-আ বইয়ের গরুর গাড়ি।’
চমকে উঠলাম। জায়গাটা তো গ্রামই। আর চুমকিরা যেখানে থাকে সেটা আরও গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা হয়ে চুমকিদের গরুর গাড়ি দেখার দৌড় এখন তা হলে অ-আ বই আর সিনেমা! গরুর গাড়ি গ্রামদেশেও এতটা দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে বুঝিনি তো!
বড় রাস্তার ধারে বাল্যবন্ধু অশোকের চালের দোকান। গ্রামে গেলে,বিকেলে ওখানে কিছুক্ষণ বসি। সেদিন অশোককেই শুধোলাম-‘গ্রামে এখন কারও বাড়ি গরুর গাড়ি আছে রে?’
উত্তরে যতটা ভেবেছিলাম,অশোক তার চাইতেও খারাপ খবর দিল। ওর কথায়,আমাদের গ্রাম তো বটেই, আশেপাশের গ্রামেও কারও বাড়িতে এখন গরুর গাড়ির দেখা পাওয়া যাবে না।
গরুর গাড়ির প্রয়োজন তাহলে ফুরিয়েছে! অশোক বলল-‘গ্রামের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক ওলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছে ভ্যান রিকশা। এর সুবিধা অনেক। যেখানে সেখানে ঢুকতে পারে,খরচ কম,উপরন্তু দ্রুতগামী। অন্যদিকে গরুর গাড়ির অসুবিধা নানা ধরণের। গরু চাই,গাড়োয়ান চাই। আবার এগুলো দিয়েও এই দ্রুতগামিতার যুগে বরণ করে নিতে হবে মান্ধাতা আমলের শ্লথগতি। এ আবার হয় নাকি!’
বাড়ির পাশেই কুমোরবাড়ি। এতদিন খেয়াল করিনি। এবার দেখলাম,রবীন্দ্রনাথ কুমোরপাড়া থেকে বংশীবদন আর ভাগ্নে মদনকে দিয়ে সেই যে গরুর গাড়ি খানাকে যুগ যুগ ধরে বের করে আনছেন সেই জায়গাতেও কামড় বসিয়েছে ভ্যানরিকশা। দেখলাম, এই ভ্যান রিকশায় বাঁশের বাখারি দিয়ে কাঠের পাটাতনখানাকে চারদিক বরাবর ঘিরে হাঁড়ি-কলসি রাখার বেশ সুবন্দোবস্ত রয়েছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। গরুর গাড়ি চলার ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ সেই সুদূর অতীত থেকে ভেসে আসছে। শুধু বাস্তবের নয়,বইয়ের পাতারও। কত গল্প উপন্যাসেরই না সার্থক অনুষঙ্গ হিসাবে এসেছে গরুর গাড়ি!
মনে করা যাক ‘পথের পাঁচালী’র সেই দৃশ্যটা, যেখানে মা ও বাবার সঙ্গে অপু চিরকালের মতো নিশ্চিন্দিপুরের সীমানা পেরোচ্ছে হীরু গাড়োয়ানের গরুর গাড়ি চেপে। গরুর গাড়ির জায়গায় অপুদের যাত্রা যদি ভ্যান রিকশায় হত তবে চিত্রটা এত নিখুঁত হত কি? নিশ্চিন্দিপুরের ক্রম-অপসৃয়মানতার জরুরি আবহসঙ্গীতটি গরুর গাড়ি ছাড়া আর কোন যান রচনা করতে পারত!
গতির যুগ এটা। গরুর গাড়ির তো হারিয়ে যাওয়ারই কথা। অথচ এককালে যান বলতে ছিল গরুর গাড়িই। মালপত্র বহন তো বটেই,এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম যাওয়া,এমনকী দূরপাল্লার যাত্রাতেও অনেক সময় গরুর গাড়ির সাহায্য নেওয়া হত।
শোনা যায়,১৮৭৮ সালে,স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবেনেশ্বরী দেবী,ভাষাবিদ হরিনাথ দের মা এলোকেশীদেবীর সঙ্গে চব্বিশ পরগনা থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন এই গরুর গাড়িতেই। তাঁদের কর্তারা তখন ওখানকার বড় চাকুরে। গরুর গাড়িতে ওই দীর্ঘ পথযাত্রায় বালক হরিনাথ ও বিবেকানন্দ (তখন নরেন্দ্রনাথ) সঙ্গীও হয়েছিলেন।
গরুর গাড়িতে দীর্ঘযাত্রার আরও উদাহরণ আছে। রামতনু লাহিড়ীর নিরুদ্দিষ্ট দাদা দ্বারকানাথ লাহিড়ীর সন্ধান পেয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে রামতনুর মা কৃষ্ণনগর থেকে আগ্রা গিয়েছিলেন গরুর গাড়ি চেপে।
অশোকের দোকানে বসে এসব ভাবছিলাম। আর মনে হচ্ছিল,একে একে গ্রামজীবনের কত অনুষঙ্গই না হারিয়ে গেল! আমাদের ঢেঁকি গিয়েছে। কলুটানা ঘানি ইতিহাসের পাতায়। তালপাতার ছাতা তো এখন প্রাগৈতিহাসিক জিনিস,কাউকে বিশ্বাসই করানো যাবে না এরকম একটা আশ্চর্য জিনিস একসময় দেখা যেত গাঁ-গেরামে। গরুর গাড়িও নিঃশব্দে এই চলে যাওয়াদের মহামিছিলে যোগ দিয়েছে ।
সেদিন কাগজ পড়ছিলাম, আর পাশে বসে স্কুলের কাজ সারছিল ছেলে। ওর অঙ্ক বইয়ের চৌকো ঘরে ইংরেজি সংখ্যায় লিখতে হবে বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর। প্রথম প্রশ্ন, গরুর কটি পা। সেটা লিখেই ছেলে দাঁড়িয়ে গেল দ্বিতীয় প্রশ্নে। কারণ দ্বিতীয় প্রশ্নটা বেশ কঠিন। রসিকতা নয়, সঠিক উত্তরটাই বসাতে হবে। ছেলে রুল মুখে নিয়ে চিন্তিত। কী হল? ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘গরুর গাড়ির কটি চাকা বাবা?’