Blog



কথাঃ
পার্থেনিয়ামের সংসার
মুর্শিদাবাদ লাইনে তেমন ঘেঁটুফুল না দেখলেও রেলরাস্তার দুধারে অনেক জায়গাতেই ঘেঁটুফুলের সৌন্দর্য সেদিন দু চোখ ভরে উপভোগ করেছিলেন বিভূতিভূষণ। গত শতকের ত্রিশের দশকের শেষে বেলডাঙায় কর্মসূত্রে আসা ভাইয়ের কাছ থেকে ঘুরে গিয়ে দিনলিপিতে সেই রেলযাত্রার কথা তিনি লিখেওছিলেন।
বিভূতিভূষণ এখন এলে তিনি হয়ত লিখতেন রেললাইনের দু ধারে ফুটে থাকা আর একটি ফুলের কথাও। সেটি পার্থেনিয়ামের ফুল।
এই ফুল দেখে বিভূতিভূষণ সাময়িক মুগ্ধতা কাটিয়ে হয়ত চিন্তিতই হতেন। কেননা, এই ফুলের যা গুণপনা তাতে এ-ফুল নিয়ে যে কারও প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হওয়া অসম্ভব।
তবে এই কল্পিত রেলযাত্রার আগে পার্থেনিয়াম বিভূতিভূষণের অভিজ্ঞতার বাইরে থাকাটাও অসম্ভব হত। কেননা এই বিদেশি আগাছার আগ্রাসন এখন এই রাজ্য তথা দেশের প্রায় সর্বত্রই। আর সত্যি বলতে কী ,গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি আমেরিকার গমের সঙ্গে এদেশে পা রাখা ‘কংগ্রেস ঘাস’ পার্থেনিয়াম এখন যেভাবে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে তাতে কীভাবে এর সাম্রাজ্যবিস্তার আটকানো যায়, আমাদের মত হয়ত সে-চিন্তার শরিক হতেন তিনিও ।
এক থেকে দেড় মিটার লম্বা এই গাছের সাদা সাদা খুদে ফুলগুলোকে দেখলে কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে খারাপ কিছু মনেই হবে না। এবং হয়ত ধনে গাছের ফুলের কথা মনে পড়ে যাবে। আর মাথাতেও কি আসবে, ফুলগুলো ধারণ করে আছে যে গাছ সেটি বিশ্বের ভয়ানক সাতটা আগাছার মধ্যে একটি!
এক-একটা গাছ বাঁচে তিন থেকে চার মাস। এর মধ্যেই ধরাধামে সে-গাছ অনেক ‘কীর্তি’ রেখে যায়। সামান্য এই সময়ের মধ্যেই তিনবার ফুল ও বীজ দিয়ে দেয় । একটা গাছ থেকে উৎপন্ন বীজের সংখ্যাও প্রচুর। ১০ থেকে ২০ হাজার। আর এই বীজ এত ছোট যে হাওয়াতেই ছড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া তো রয়েছেই গবাদি পশুর গোবর,গাড়ির চাকার কাদামাটি পথচারীদের জুতো-স্যান্ডেলের তলা। এসবে আটকে বীজের এদিক সেদিক ছড়িয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
পার্থেনিয়ামের ক্ষতিকারক দিক একটা নয় অসংখ্য। এই গাছের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শে এলে চর্মরোগ,হাঁপানি,শ্বাসকষ্ট,অ্যালার্জি জাতীয় সমস্যা ঢুকে যেতে পারে আমাদের শরীরে। চর্মরোগের শিকার হতে পারে মনুষ্যেতর প্রাণীরাও। সাধরণত এই গাছ খাদ্য হিসাবে গবাদি পশুরা গ্রহণ করে না। কিন্তু এর তো আরেক নাম ‘দুর্ভিক্ষের আগাছা’। ঘাসের অভাবে যদি গবাদি পশুরা এই গাছ খাদ্য হিসাবে নিয়ে ফেলে, বদহজম,পেট ফুলে যাওয়ার মত নানা উপসর্গ দেখা দেয় তাদের। এছাড়া হতে পারে তীব্র জ্বর সহ অন্যান্য রোগও। পার্থেনিয়াম পেটে গেলে তার প্রভাব তাদের দুধেও এসে যায়।
আর কৃষিজমিতে পার্থেনিয়াম একবার প্রবেশ করে গেলে ফসলের বিশাল ক্ষতি করে দেয়। পার্থেনিয়াম মাটির ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মেই কামড় দিয়ে বসে। ধান,ছোলা,সরষে, গম,বেগুন,লঙ্কার ক্ষেত্রে বীজের অঙ্কুরোদগম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দেয় উল্লেখযোগ্য ভাবে। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশের কৃষিতে পার্থেনিয়ামের প্রভাব পড়ে গেছে অনেকটা। পার্থেনিয়াম দমন করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে কৃষির ক্ষেত্রে বলা যায় বিপর্যয়ই ঘটে যাবে।
পার্থেনিয়াম নিয়ে সচেতনতা যেমন জরুরী তেমনই জরুরী পার্থেনিয়াম দমনে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এ রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কোনও পুরসভা অথবা কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাঝে সাঝে পার্থেনিয়াম দমনে এগিয়ে আসে না তা নয়। পত্র-পত্রিকায় দেখাও যায় এই আগাছা দমনে তাদের অভিযানের বিবরণ। ছবিও ছাপা হয়,পার্থেনিয়াম কাটা এবং পোড়ানো,মাটিতে পুঁতে ফেলার। কিন্তু এ তো রক্তবীজের ঝাড়। প্রতিনিয়ত এর আগ্রাসনের যে হার,তাতে এইসব অভিযান প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।
আর এভাবে পার্থেনিয়াম পুরোপুরি দমন করা সম্ভবও নয়। একে তো গাছ কাটতে গেলেও গাছের সংস্পর্শে আসার একটা ব্যাপার থাকবেই,যাতে যাঁরা এই কাজটি করবেন তাঁদের শারীরিক ক্ষতির একটা সম্ভাবনা থাকবে; তার উপর এই কর্মসূচিতে ক্ষতিকারক এই আগাছা সমূলে বিনষ্টও হবে না। সুতরাং এর মোকাবিলায় অন্য পথ অবলম্বন করা ছাড়া গতি নেই। বেশ কিছু রাসায়নিক জলে গুলে স্প্রে করলে এই আগাছা দমন করা যায়। কিন্তু পার্থেনিয়ামের যে বিপুল বিস্তার তাতে এটা যেমন খরচসাপেক্ষ তেমনি এই প্রক্রিয়া পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনও নয়।
সবচেয়ে ভালো জৈবিক পদ্ধতি। নানা ধরণের পাতাখেকো,ঘাসখেকো পোকার মাধ্যমে পার্থেনিয়াম দমন করা যায় বলে জানা গেছে। কিন্তু এসব এখনও রয়েছে,গবেষণার স্তরে এবং সীমিত প্রয়োগের মধ্যেই। কবে এই জৈবিক পদ্ধতিকে সর্বাত্মক করা যাবে,সে উত্তর অজানা। সব মিলিয়ে পার্থেনিয়াম নির্মূলীকরণ চিত্রটা এখনও অনেকটা ‘করা যায়’, ‘করা উচিত’এর স্তরেই। নেই সেভাবে সরকারি উদ্যোগ বা এই মর্মে গণজাগরণ।
এরই মধ্যে পার্থেনিয়াম নিয়ে সাম্প্রতিক খবরাখবরও বেশ হতাশার। জানা গেছে এই গাছের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলা এবং বংশবিস্তারের ক্ষমতা এতই প্রখর যে এখনকার এই পরিবর্তিত জলবায়ুতেও তার হেরফের হবার সম্ভাবনা কম। ইতিমধ্যেই দেশের ৪.২৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি পার্থেনিয়ামের কবলে। আর বর্তমানকালের উষ্ণ জলবায়ুতেও দেশের ৬৫ শতাংশ জমিই নাকি পার্থেনিয়ামের জন্য অনুকূল।
তবে এসব তথ্যও এখন বাস্তবের অনেকটা দূরে। কেননা, ‘করছি’, ‘করা উচিত’ করেও এই আগাছার নির্মূলীকরণ যেটুক হচ্ছিল সেটুকুও আজ অনুপস্থিত। তার উপর, মানুষ ও যানের চলাফেরাতে এর বিস্তার যে কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয় সেটাও এখন নেই। সবাই করোনায় বন্দী।
তবে সেদিন এই করোনার মধ্যেও যেতে হয়েছিল রেললাইন টপকে। দেখলাম, ‘আমরা ঘাসের ছোট ছোট ফুল/হাওয়াতে দোলাই মাথার’ মত ভালোমানুষীর ভাব করে রেললাইনের দুধার দিয়ে আরও বিস্তৃত হয়েছে এই বিষফুল।
করোনা আমাদের চৌহদ্দি ছেড়ে কবে পালাবে জানা নেই। যেদিন আমরা বাইরে বেরোব,দেখব পার্থেনিয়াম আরও সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে তার সংসার। আমাদের জন্য সেটা যে খুব ভালো ব্যাপার হবে না,তা বলাই যায়।