কথাঃ পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছিল শেরফুলের মা (pisima k ata ene diyechilo sherfuler ma)
কথাঃ পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছিল শেরফুলের মা (pisima k ata ene diyechilo sherfuler ma)

কথাঃ পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছিল শেরফুলের মা (pisima k ata ene diyechilo sherfuler ma)

Ami Mishuk | আমি মিশুক কথাঃ পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছিল শেরফুলের মা (pisima k ata ene diyechilo sherfuler ma)

কথাঃ

 পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছিল শেরফুলের মা

পরীক্ষার খাতায় পিছনের দিকের ছাত্রদের হাবিজাবি উত্তরের সঙ্গে আমরা শিক্ষকেরা কমবেশি সকলেই পরিচিত।সেই হাবিজাবি উত্তরের মধ্যে এবার একটা ভিন্ন রকম কথা পাওয়া গেল। সহকর্মী শিক্ষকবন্ধু  ক্লাস নাইনের ভৌত বিজ্ঞানের শেষ মূল্যায়নের খাতা দেখছিলেন। কথাটা দেখালেন উনিই। প্রশ্ন ছিল,ব্লেড জলে ভাসে কোন ধর্মের জন্য। উত্তরে একটি ছেলে লিখেছে,হিন্দু ধর্মের জন্য।

এটা সংশ্লিষ্ট ধর্মের গরিমা না নিন্দা,নাকি কোনওকিছুই না ভেবে লেখা,তা ছাত্রটিই জানে। কিন্তু   পারিপার্শ্বিক ঘটনা যে কোমলমতি ছাত্রদের মনেও প্রভাব ফেলছে,এটা পরিষ্কার।

আমি জন্মেছি এই দেশে। কিন্তু আমার পূর্বপুরুষ দেশভাগের ক্ষত নিয়ে একদা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন এখানে। শুনেছি, দেশ পরিবর্তনের কারণে ধনী থেকে রাতারাতি গরিব হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। আমাদের  মানুষ করে তুলতে  সীমাহীন শ্রম এবং অশেষ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল বাবা মাকে। কিন্তু তার জন্য তাঁদের কখনও বলতে শুনিনি, এর জন্য দায়ী মুসলিমেরা।  যে কষ্ট,দুর্গতি এদেশে এসে প্রথমদিকে তাঁরা পেয়েছিলেন,তা তাঁদের প্রাপ্য ছিল না,কিন্তু দেশ যে সাধারণ মানুষ ভাগ করে না,এ বোধবুদ্ধি তাঁদের ছিল। তাই কখনও প্রতিবেশী ধর্মের মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে দেখিনি তাঁদের। উল্টে চিন্তায় আচরণে তাঁদের মধ্যে দেখেছি মিলনের,মানিয়ে চলার মানসিকতা। মানুষকে ভালবাসতে গেলে ধর্মপরিচয়কে পাত্তা দিতে হবে এমন হীন প্রবৃত্তি তাঁদের ছিল না।

এদেশে এসে বাবা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার কাজ পেয়েছিলেন। মনে আছে, সেসময় ক্লাস ফোর থেকে  ফাইভে যেতে  পাস করতে হত যে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা তার জন্য গরিব প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকটির বাড়ির মাটির দাওয়ায় খেজুর পাতার মাদুর বিছিয়ে চলত পরীক্ষার আগে ফ্রি কোচিং।  সেখানে এসে বসত যেমন পুষ্কর,সাধনে্রা তেমনই থাকত আজাহার,ইমরান হাবিবের মত গরিবেরাও।

 একটা দহের উপর কাঠের স্ল্যাব-পাতা ব্রিজ পেরিয়ে বাবা স্কুলে যেতেন। কাঠের স্ক্যাবগুলো বেশ কিছুটা   ফাঁক দিয়ে দিয়ে পাতা। ফলে একটু অসাবধান হলেই ফাঁক গলে নিচে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকত। বাবা যখন পঁয়ষট্টির কোঠায় এসেও আর্থিক কারণে এক্সটেনশন নিয়ে রয়ে গেছেন শিক্ষকতায়, চোখে  ছানি, কানেও শোনেন কম,তখন কোনওদিন উল্টো দিক থেকে ব্রিজ পার হয়ে এসেও দাঁড়িয়ে যেতেন  শরিফদা বা সালামদা কিম্বা সিরাজ সেখের মত কেউ। হাত ধরে বাবাকে আবার ব্রিজটা পার করে দিয়ে  আসতেন।

সিরাজ সেখ ছিলেন বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। হঠাৎ একদিন,বলা নেই,কওয়া নেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন তিনি। সেদিন বাবারও স্কুল কামাই, এবং তিনি বেপাত্তা। পরে শুনেছিলাম,ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক না করে জলস্পর্শ না-করা প্রবল ধার্মিক মানুষটি  বেলা তিনটে অব্দি ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলেন বন্ধুর কবরে ধূপকাঠি গুঁজবেন বলে।

বাবা যেদিন মারা গেলেন আমাদের প্রাক্তন অঞ্চলপ্রধান আশরাফ মুন্সী,বার্ধক্যের বাধা নিয়ে তিন কিলোমিটার হেঁটে আমাদের বাড়িতে এসে এমন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে শোকের বাড়িতে আমরা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম তাঁকে সামলাতেই।  

ধর্মপরিচয়কে দূরে রেখে পরস্পরের মধ্যে এই প্রীতির বন্ধন,কিন্তু মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। ছিন্নমূল হয়ে এদেশে আসা পরিবার আমাদের ছোট্ট গ্রামটায় একেবারে কম ছিল না। কিন্তু কোথাও ধর্ম এসে পরস্পরের মধ্যে দেওয়াল তুলেছে,এরকম দেখিনি। বরং উল্টোটাই দেখেছি। পাতানো কাকির প্রতি ভালবাসায় দূর গ্রাম থেকে প্রতিবেশি পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছেন শেরফুলের মা। খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যাওয়া বাবলুদাকে দু মাইল রাস্তা কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে এসেছেন রহিম রাজমিস্ত্রি। প্রফুল্ল স্যারের গাছের বড় কাঁঠালটা বরাবর দেওয়া হয়েছে বস্তর আলির বাড়িতে।

দেশভাগের দগদগে ঘা নিয়ে এদেশে এসেও বিদ্বেষবিষ থেকে  পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন আমাদের বাবা মায়েরা এবং চারপাশের বহু মানুষ। আমরা দেশভাগের দুঃখ না পেলেও ফল ভোগ করেছি বিস্তর। কিন্তু কই তার জন্য তো আমাদেরও কখনও মনে হয়নি হাসানুলের সঙ্গে হারাধনের বন্ধুত্ব হতে পারবে না। যে জাতি-জটিলতা কখনও মনেই আসেনি এতবছর পরে  নিশ্চয় অন্য কারও প্ররোচনায় নতুন করে তাকে ফিরিয়ে আনব না। আর এড়িয়েও যাব তাঁদেরকে যাঁদের মধ্যে রয়েছে এই জাতি-জটিলতা।  

এর সঙ্গে ধর্মাচারণকে গুলিয়ে ফেলার কোনও কারণ নেই। আমার জামার তলায়ও পৈতে রয়েছে। ছিঁড়ে যাবার মুহূর্তে এখনও ব্যস্ত হয়ে যাই আর একটা সংগ্রহে। নিয়ম করে গায়ত্রী মন্ত্রও জপি স্নানের পর। কিন্তু মনে মনে জানি রোগ হলে ডাক্তারের কাছেই যেতে হবে। জীবন ধারণের জন্য রোজগারের ধান্দায় পথেও বেরোতে হবে । মন্ত্রের মত কিছুই হয়ে যাবে না। ধর্মাচারণ বড়জোর মনে একটা শক্তি আনতে পারে,ঠিক রাখতে পারে মনের ভরকেন্দ্রটাকে, এর বেশি ধর্ম দেয় না। এর বেশি আশা করতেও নেই। এর বেশি আশা করতে গেলে রাম রহিমের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবে।এবং প্রাপ্তি গুণ হবে শূন্য দিয়ে। এই করোনা সংকটেও মানুষের এই চৈতন্য এল না,এটাই আশ্চর্যের!

Product

Leave a Reply