কথাঃ বাংলাসাহিত্যে ভূত (Bangla sahitye bhut)

Ami Mishuk | আমি মিশুক কথাঃ বাংলাসাহিত্যে ভূত (Bangla sahitye bhut)কথা

বাংলাসাহিত্যে ভূত

ভূতের গল্প-বাংলাসাহিত্যে ভূত

‘ভূতের গল্প’র শুরুতে উপেন্দ্রকিশোর লিখেছেন, ‘আমি ভূতের গল্প ভালবাসি। তোমরা পাঁচজনে মিলিয়া ভূতের গল্প কর,সেখানে আমি পাঁচ ঘন্টা বসিয়া থাকিতে পারি।’
শুধু লেখক উপেন্দ্রকিশোর নন,ভূতের গল্প বিষয়ে সকলেরই বোধহয় কমবেশি একই বক্তব্য। সেজন্য বাংলাসাহিত্যে আজও প্রচুর ভূতের গল্প লেখা হয়। ভূত আছে না নেই,সে তর্ক বৃথা। প্রমথনাথ বিশী একটা সুন্দর শব্দযুগ্ম উপহার দিয়েছেন, ‘সুখকর ভীতিবোধ।’ বিশ্বাস বা অবিশ্বাস নয়,ভূতের গল্পে সবাই বোধহয় এটাই পেতে চায়।
অন্য গল্প পড়া বা শোনার ক্ষেত্রে হয়তো অনুষঙ্গ লাগে না। কিন্তু ভূতের গল্পের ক্ষেত্রে টিমটিমে আলো,ঘুটঘুটে অন্ধকার আর বর্ষা বা শীতের আবহাওয়া থাকলে বেশ জমে যায়।
ভূতের গল্পের শুরুটা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তবে তাঁর ‘নিশীথ রাক্ষসীর কাহিনী’ সমাপ্ত হয়নি। বরদা আর সারদার কথোপকথোনেই গল্প থেমে গিয়েছে। বঙ্কিমের পর ভূতের গল্প নিয়ে বৈঠকী মেজাজে বাংলা সাহিত্যের আসর জমিয়ে দিয়েছেন ত্রৈলোক্যনাথ। তাঁর ‘লুল্লু’ ভূতের গল্প, ‘কঙ্কাবতী’ সকলেরই পড়া।
ভূত কী করে তৈরি হয়,তার সরস বর্ণনা দিয়েছেন ত্রৈলোক্যনাথ-‘যেমন জল জমিয়া বরফ হয়,অন্ধকার জমিয়া তেমনই ভূত হয়।’ তেলের কলে ভূত পেষাই করে তেল বের করার অদ্ভূত কথাও ত্রৈলোক্যনাথের লেখাতে পাওয়া যায়। ত্রৈলোক্যনাথের ভূতের আর একটা বৈশিষ্ট্য,তারা সবাই দেশজ।
যদিও ভূতের রাজ্যে ছোটদেরই অধিকার বেশি,তবু ভূত নিয়ে সাবালক গল্পও লেখা হয়েছে। ছোটদের ভূতের গল্পে ভূতের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ। বড়দের ভূতের গল্পে ভূতের উপস্থিতি নাও ঘটতে পারে। সাবালক ভূতের গল্পের পথিকৃৎ বলা যায় রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর ‘নিশীথে’,‘মণিহারা্’ ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মাস্টারমশাই’ ইত্যাদি হয়তো আক্ষরিক অর্থে ভূতের গল্প নয়। তবে এসব গল্পে ভূতের গল্পের মতই নানা অলৌকিক, অতিপাকৃত ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়।
ভূতের গল্পের প্রসঙ্গে পরশুরাম অর্থাৎ রাজশেখর বসুর কথা উল্লেখ করতেই হয়। তবে তাঁর ‘ভুশন্ডীর মাঠে’, ‘মহেশের মহাযাত্রা’র মেজাজ একটু আলাদা। এসব গল্পে হাস্যরসের প্রাচুর্যে ভৌতিক গল্পের ভীতিভাব নেই বললেই চলে।
এই ভীতিভাব আবার পুরোদস্তুর রয়েছে শরৎচন্দ্রের ‘পিশাচ’, ‘কাশীর ভূত’ জাতীয় গল্পে। শোনা যায়,’যমূনা’ পত্রিকার অফিসে শরৎচন্দ্র ‘পিশাচ’ গল্পটি পড়ে শোনানোর পর একজন শ্রোতা বলে উঠেছিলেন, ‘এখন তো পথে বেরোতেই ভয় করছে।’
ভূতের গল্প আমাদের রূপকথা-উপকথায় প্রচুর রয়েছে। সেসব গল্পে সবই কাল্পনিক,ভূত আলাদা করে আর নজর কাড়ে না। উপেন্দ্রকিশোরের বেশিরভাগ ভূতের গল্পেও এই রূপকথার ঢং। তবে তাঁর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’বেশ অন্য স্বাদের। বাংলা শিশুসাহিত্যে এটি নিঃসন্দেহে একটি সেরা ভূতের গল্প।।
রবীন্দ্র সমকালে বা অল্প পরে ভূতের গল্প শুধু উপেন্দ্রকিশোর নন,অনেকেই লিখেছেন। সেসময় লেখা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কালের টঙ্কার’,দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘উৎপীড়িতের প্রতিহিংসা’,সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘নরক এক্সপ্রেস’,প্রমথনাথ বিশীর ‘বিনা টিকিটের যাত্রী’ ইত্যাদি গল্প সাহিত্যরসিক বাঙালি আজও পড়ে।
অতিপ্রাকৃতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাবরই ছিল আগ্রহ ও বিশ্বাস। তাই ভূতের গল্প তাঁর হাতে অন্য মাত্রা পেয়েছে। তাঁর ভূতের গল্পের মধ্যে ‘ভৌতিক পালঙ্ক’,’মশলা ভূত’, ‘তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’ আজও জনপ্রিয়। শুধু ছোটগল্প নয়,অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী বিভূতিভূষণের উপন্যাসেও অনেক জায়গায় পাওয়া যায় অলৌকিকের ইশারা।
ভূতের গল্প তারাশঙ্করও লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘অক্ষয়বটোপাখ্যান’ রীতিমত রোমহর্ষক। ঠিক উল্টোটা শিবরাম চক্রবর্তীর ‘গোলদিঘির ভূত’। এখানে রয়েছে ভূতের আইসক্রিম খাওয়ার সরস বর্ণনা।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা গোয়েন্দা গল্পে একটি বিশেষ স্থান জুড়ে আছেন। ভৌতিক গল্পেও কিন্তু তাঁর দক্ষতা কম নয়। এই প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়বে তাঁর ‘যাত্রী’,’ছোটকর্তা’,’মরণদোলা’,’মোক্তার ভূত’ ইত্যাদি গল্পের কথা।
বাংলা সাহিত্যে ভূতের গল্পে সত্যজিৎ রায়ের একটা আলাদা স্থান রয়েছে। তাঁর ‘অনাথবাবুর ভয়’, ‘রাজধনের বাঁশি’ পড়ে মুগ্ধ হয়নি এমন বাঙালি পাঠক বিরল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘অনাথবাবুর ভয়’ প্রসঙ্গে লিখেছেন-‘গল্পটি যেদিন পড়ি,বাড়িতে সেদিন আর কেউ ছিল না। রাত্তির বেলা গল্পটি পড়েছিলুম। কাজটা ভাল করিনি। কেননা ঘুমের সেদিন বারোটা বেজে যায়।’
বর্তমান সময়ে ভূতের গল্প বা উপন্যাস নিয়ে যাঁদের কারবার,তাঁদের মধ্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ভূতের গল্পের একটা আলাদা ঘরানাই তৈরি করে ফেলেছেন। উপকারি,বন্ধুস্থানীয় ভূতের গল্প বাংলা সাহিত্যে আগে অনেকই লেখা হয়েছে। লিখেছেন মনোজ বসু,লীলা মজুমদার এবং আরও অনেকে। কিন্তু শীর্ষেন্দুর গল্পে সেই উপকারী,বন্ধুস্থানীয় ভূতেরাই চমকপ্রদ রহস্য রোমাঞ্চের পরিবেশ তৈরি করে। এইসব ভূতেদের কেউ কেউ আবার বেশ ভীতু প্রকৃতিরও। শীর্ষেন্দুর গল্পে সবচেয়ে মজার বিষয় হল নানা চরিত্রের বর্ণনা ও তাদের মধ্যেকার কথোপকথন।
ভূতের কি মানুষের মতো নাম হয়? বাংলা ভূতের গল্পে ভূতেদের মামদো,স্কন্ধকাটা,পেঁচো,ব্রহ্মদত্যি,শাঁকচুন্নি এইসব নামেই পাওয়া যায়। এছাড়া অনেক সময় তারা ফেলে আসা জীবনের নাম নিয়েও হাজির হয়। এদিক থেকে শীর্ষেন্দুর ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ এর নিধিরাম ব্যতিক্রমী। সিনেমা হয়েছে বলে নয়,তার আগে থেকেই ছোটদের কাছে নিধিরাম অত্যন্ত প্রিয় এক ভূত চরিত্র।

 

Product