Blog

কথাঃ মিথ্যুক
মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাসনি? এত মিথ্যা কথা বল কেন? মিথ্যা বলা আপনার স্বভাব।
এই হল, ‘তুই’, ‘তুমি’ আর ‘আপনি’ বেলায় আমার সম্পর্কে লোকের মূল্যায়ন। একটুও ভুল নয় কিন্তু। একেবারে সঠিক এই মূল্যায়ন। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব মিথ্যে কথা বলি। আর এখন তো মিথ্যে বলাটা বেড়ে বেড়ে এমন জায়গায় গিয়েছে,যে আমাকে মিথ্যেবাদী বললে মিথ্যেবাদীদেরও রাগ হবে।
মিথ্যে কথা বলা খারাপ সে আমিও জানি। কিন্তু কী করব? স্বভাব যায় না ম’লে।
আমার মিথ্যে বলা প্রথম শুরু হয় স্কুলে। অমর,বিনয়,শমিত,অরুণেশ,বাবু,সুব্রত আমার স্কুলের প্রিয় সহপাঠী এদের কাছে। কারণে,অকারণে। ‘মিথ্যে বলার জায়গা পাসনি?’ ওদেরই কথা।
সেসময়, একটা মিথ্যে বলার ঘটনা এখনও খুব মনে পড়ে।
মিথ্যেটা চটি নিয়ে।
অমর একদিন শুধোল-‘খালি পায়ে আসিস কেন? চটি নেই তোর?’
আমি হা হা করে হেসে উঠে বলি-‘চটি থাকবে না কেন? চটি পরেই তো আসি। কিন্তু স্কুলে ঢোকার আগে ব্রিজের নিচে একটা ঝোপে ওটা লুকিয়ে রাখি।’
-‘কেন কেন?’ শমিত শুধোয়।
-‘বাবার গুরুদেবের বারণ। আমার গ্রহ নক্ষত্রে কী সব গন্ডগোল আছে,তাই উনি বলেছেন সতেরো বছরের আগে বিদ্যালয়ে জুতো পরে ঢোকা যাবে না।’
মিথ্যেটা সেসময় ধরা পড়েনি। কিন্তু নাইনে ওঠার পর হঠাৎ একদিন চটি পরে স্কুলে যেতেই,অরুণেশ খিক খিক করে হেসে শুধিয়েছিল-‘সতেরো হয়ে গেল তোর?’
আমি অবশ্য হার মানিনি। বলেছিলাম-‘ বাবার গুরুদেব জানিয়েছেন,ফাঁড়া কেটে গেছে।’ তাতে অরুণেশের হাসিটা বেড়ে গিয়েছিল। আর তাতে যোগ দিয়েছিল অন্যরাও।
আর কলেজে এসে তো আমি মিথ্যের ব্যাপারে লাগামছাড়া। হয়ত জয়দীপ বলল-‘কাল তোমাদের ওখানে কারেন্ট ছিল? আমাদের এখানে তো সন্ধে থেকেই-’
আমি বলে দিলাম দুম করে।-‘সন্ধেয় ছিল। পরে চলে যায়। আসে আবার অনেক রাতে।’
চল্লিশকিমি দূরে বাড়ি, কে আর আসল সত্যি খুঁজতে আসছে, ভেবেছিলাম এরকম। কিন্তু কয়েকদিন কী একটা কারণে কলেজ না যেতে পারায় জয়দীপ যে এক বিকেলে খোঁজ নিতে এত কিমি পথ পেরিয়ে সটান আমাদের বাড়ি এসে হাজির হবে তা কে জানত!
আমি তো জয়দীপকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে গেছি। তবে জয়দীপ আমার এই রাতকে দিন করা মিথ্যে নিয়ে কিছু বলেনি কোনওদিন। বরং আমাদের মাটির বাড়ি, হ্যারিকেনের আলো ওর ভালো লেগেছিল। কিন্তু বিশ্বাস! করত কি আর? আমি কোনও একটা কথা বললেই জয়দীপ আমার দিকে তাকিয়ে বলত-‘সত্যি বলছ?’
আমার মনে হত ওর এই ‘সত্যি বলছ’ প্রশ্নটার তলায় রয়েছে আমার সম্পর্কে একটা তেতো মূল্যায়ন,‘খুব মিথ্যে বল তুমি।’
এই ‘আপনি’ বেলার মিথ্যে নিয়ে আর কী বলি? এখন তো আমি দাগি মিথ্যেবাদী। ফুটপাতে সেলে কেনা জিনিস আমার বাগাড়ম্বরে অ্যামাজনে অর্ডার দিয়ে কেনা দামি মাল হয়ে যায় হরদম। সপ্তাহে অন্তত তিনদিন আমার খাবারের মেনুতে ইলিশের উপস্থিতি শোনে বন্ধুরা।
কারণ ওদের এ জাতীয় গল্পের আসরে আমিই বা পিছিয়ে থাকব কেন? সে আড়ালে যতই থাক না বিরাট পরিবারের দায় সামলানো এক সর্বস্বান্ত মানুষ!
আড়ালে আমার নামে ফিসফাস চলে কিনা জানি না,তবে স্টাফরুমে কোনও বিষয়ে ডিবেটের সময় বিরোধী কেউ যখন আমার কোনও কথার সূত্র ধরে আগুপিছু না ভেবেই দুম করে বলে দেয় ‘ মিথ্যা বলা আপনার স্বভাব’ তখন মনে হয় এ মোটেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, এ আমার সম্পর্কে ওর মনে ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া মূল্যায়ন। এবং এর কারণ অ্যামাজন,এর কারণ ইলিশ,এর কারণ ওই জাতীয় আরও নানা গালগল্প।
মিথ্যে বলা একটা রোগ। কিন্তু এ রোগ আমি সারাতেও চাই না। কারণ? একটা ঘটনা বলি। সেবার এক কম্পিউটার শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ক্লাস নাইনের পাঁচজন মেধাবি গরিব ছাত্রের নাম পাঠাতে বলল স্কুলকে। দায়িত্বটা কেন কে জানে আমার ঘাড়েই এল। হেডস্যার নাইনের দশজন গরিব,মেধাবিকে আমার সামনে এনে হাজির করালেন।
মেধাবি চেনা সহজ,কিন্তু গরিব?
আমি একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করলাম।
এক-শেষ কবে খালি পায়ে হেঁটেছ?
দুই-রাতে আলো চলে গেলে কোন আলোয় পড়ো?
তিন-গঙ্গা আর পদ্মার ইলিশের মধ্যে কোনটা তোমার বেশি ভালো লাগে?
চার-অ্যামাজনে আনা জিনিস পছন্দ না হলে ফেরত দেওয়া যায় কি?
ছোট থেকে দারিদ্র্যকে ঢাকতে ঢাকতে এসেছি। ঢেকে চলেছি আজও। তাই দশ মেধাবির উত্তর দেখেই বুঝে গেলাম,বিপিএল কার্ড কার সত্যি,কার নকল,আর কার ওই কার্ড না থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্য ষোলোয়ানা।
আর অবাক হয়ে দেখলাম নিয়মটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়,অনেকের ক্ষেত্রেই আজও একই রকম। মানে এই একই রকম ঢাকতে চাওয়ার অভ্যেস। কেউ ধরা পড়ল,’গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশ দুটোই ভালো লাগে’ লিখে,’অ্যামাজনের জিনিস পছন্দ হলে ফেরত দেওয়া যায় না’ জানিয়ে। কেউ, ‘রাতে আলো চলে গেলে ইমার্জেন্সির আলোয় পড়ি’ জানিয়ে, ‘শেষ খালি পায়ে হাঁটা বারো বছর আগে’ লিখে।
দুই বিপরীত অবস্থার সহাবস্থান যে হতে পারে না তা নয়। কিন্তু এতদিনে আমি তো ‘নয়’এর উপর ‘হয়’এর ঢাকনা চাপাতে ওস্তাদ হয়ে গেছি। তাই বিপরীত অবস্থার সহাবস্থানে ওদের কাটাকুটি,কলম কাঁপা দেখে ঠিক চিনে ফেলেছি ঢাকনা।
আমার মিথ্যে বলার অভ্যেস সেদিন প্রথম সার্থক হয়েছিল। সত্য বাছাইয়ে আমার কোনও ভুল হয়নি।
-‘