(আজ কাজিন ডে। একটা গল্প। ছোটদের)
ক্যাডবেরি
এই পৃথিবীতে ঋতমের একটাই শত্রু। বাদল। বাদলকে দেখলেই ঋতমের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ওর চোখেমুখে এলোপাথারি ঘুষি চালাতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু শেষ অবধি ইচ্ছেটা কাজে পরিণত করতে পারে না। মা বা মালতীমাসি কেউ না কেউ ঠিক হাজির হয়ে যায়।
একটা ব্যাপারে আশ্চর্য লাগে ঋতমের। বাদল এখন একেবারে ছোট নয়, ওর মনোভাব বোঝার বয়স যথেষ্টই হয়েছে। কিন্তু তবু সারাদিন ওর চারপাশেই ও ঘুরবে। ঋতম যেহেতু বাদলকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না, তাই ওর কাছাকাছি বাদল এলেই চিৎকার শুরু করে দেয়। মা ছুটে আসে। বলে-‘এরকম করছিস তুই! ও যে তোর ভাই রে…’
ভাই! দূর সম্পর্কের কাকার ছেলে। বাবা মা যতই ওকে কোর্টকাছারি করে ছেলে হিসাবে নিক, ওর বয়েই গেছে তা মানতে। বাদলের যখন বছর ছয়-সাতেক বয়স কাকা কাকিমা ওকে রেখে পাহাড়ে ট্রেকিং করতে গিয়েছিল। আর ফেরেনি। সেই থেকে বাদল এখানে। ঋতম তখন ফাইভে পড়ে। বাদলকে প্রথম দিকে খারাপ লাগত না। কিন্তু কয়েকবছর যেতেই দেখা গেল, বাদলের জন্য বাবা মায়ের টানটা ওর চাইতে অনেক বেশি। আর তখন থে্কেই ও চক্ষুশূল।
বাদল যা চায়, তাই পায়। আর ও, চারটে জিনিস চাইলে একটা। তাও অনেক গড়িমসি করে আসে। মা বা বাবাকে এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলে ওদের একটাই উত্তর-‘বাদল ছোট না! ওর সঙ্গে তুলনা করছ?’
তুলনা তো আসবেই! ঋতম ছবি আঁকতে ভালবাসত। এইটে ও চেয়েছিল, আঁকা শিখতে পাড়ার ড্রইং স্যরের কাছে। বাবা রাজি হয়নি। বলেছিল-‘তুমি পড়াশোনায় ভাল, আঁকা শিখতে গেলে ওতে ইনভলভড হয়ে যাবে। পড়াশোনায় ফাঁকি পড়বে। বাড়িতেই আঁক। কী লাগবে বলো, এনে দিচ্ছি।’
ঋতম রেগে বলেছিল-‘কিচ্ছু লাগবে না।’ওর এই রাগের কথাটাকে সত্যি ভেবে কিছু আনাও হয়নি। অথচ সেই বাবা মা-ই বাদলকে ভর্তি করে দিয়েছিল নাচের স্কুলে। লেখাপড়ায় বাদলও ওর মতই ভাল। অথচ নাচ শিখলে ওর পড়ার ক্ষতি হবে না, কিন্তু আঁকা শিখলে ঋতমের হবে! অদ্ভুত যুক্তি।
মনের রাগ মনে পুষে রেখেছে ঋতম। বকুনি, মার একসঙ্গে দিলে উলটো ফল হত বলে এখন আর বকুনি দেয় না। ওর কোনও জিনিসে বাদল হাত দিলে, সামনে কেউ না থাকলে একেবারে আওয়াজ না করে মাথায় বসিয়ে দেয় দু’-চারটে গাট্টা। এই সিক্সেই মার সহ্য করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছেলেটার। কাঁদে না। কেবল মুখটা গোমড়া করে সরে যায়।
একই স্কুলে পড়ে বাদল। ঋতম স্কুলে খুব ঠেকায় পড়লে মানে স্যরেরা কেউ শুধিয়ে বসলে অনেক কষ্টে কাজিন হিসাবে পরিচয় দেয় ওর। এর অতিরিক্ত নয়। কিন্তু ছেলেটা এত বেহায়া যে ওর বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করার সময় ঋতম কোনওভাবে ওখানে হাজির হয়ে গেলে এমনভাবে ‘দাদা আসছে’ বলে থেমে যায় বা সরে যায় যে মনে হয় ঋতম ওর কত জন্মের দাদা!
মাধ্যমিকের পরে একই স্কুলে বারো ক্লাস পড়া যেত। কিন্তু ঋতমের অসহ্য লাগছিল বাড়ির পরিবেশ। বাড়ি মানেই যেন বাদল, আর ঋতম বাবামায়ের আপন সন্তান হয়েও যেন বানের জলে ভেসে আসা। ঋতম স্ট্রেট জানিয়ে দিল বাবাকে, ও পড়বে জেলা স্কুলে। বাবা অরাজি হল না। মাধ্যমিকে বিশাল নম্বরের সূত্রে ও জেলার সবচেয়ে নামকরা স্কুলে ভর্তির সুযোগও পেয়ে গেল।
বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ঋতম রওয়ানা দিল এক সকালে। সঙ্গে বাবা। ঋতম যখন যাবার আগে মাকে প্রণাম করছে, দেখে বেহায়াটা কিছু দূরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। রাগে গা পিত্তি জ্বলে গেল ঋতমের। ‘তুই আবার কাঁদছিস কেন? যত্তসব…!’ মা বাবা কাছে না থাকলে দু’-এক চাপড় বসিয়েই দিত বেহায়াটাকে।
হোস্টেলে নতুন বন্ধুবান্ধব।-‘কে কে আছে রে তোর বাড়িতে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ সময়েই শুধু ‘বাবা মা’ বলে চালিয়ে দেয় ঋতম। একবার বাবা বাদলকে নিয়ে হোস্টেলে ওর সঙ্গে দেখা করতে এল। বাদলের সঙ্গে অনেকের ভাবও হয়ে গেল। বাবারা যেতেই সেই বন্ধুরা চেপে ধরল ঋতমকে-‘এত সুন্দর একটা ফুটফুটে ভাই রয়েছে তোর, বলিসনি তো!’
-‘ভাই মানে কাজিন।’
-‘কই তা তো বলল না তোর বাবা কিম্বা বাদল। তোর নিজের ভাই এরকমই তো মনে হল ওদের কথায়!’
-‘দূর!’
টুয়েলভের শেষদিক চলছে। পড়াশোনার অজুহাত দেখিয়ে দুটো বছর ঋতম বাড়িতে যায়নি। তবে বন্ধুদের বাড়িতে গেছে অনেকবার হোস্টেলের একঘেঁয়েমি কাটাতে। টুয়েলভের টেস্টের পরে রঞ্জন বলল, অনেকের বাড়িতেই তো গেলি। এবার চল আমাদের বাড়ি। দিন তিনচারেক আমার সঙ্গে কাটিয়ে আসবি। দেখবি ভাল লাগবে।’
রঞ্জনদের বাড়ি শিলিগুড়ি। ওখানে যেতেই ঋতম বিরাট আপ্যায়ন পেল। রঞ্জনের মা ঋতমকে একেবারে আপন করে নিলেন। সবচেয়ে ভাল লাগল রঞ্জনের বোন তিতলিকে। ক্লাস ফোরে পড়া তিতলি ঋতমদাদা ঋতমদাদা বলে একেবারে গায়ে লেপটে রইল সারাদিন। তিতলির বাড়িতে বিশাল আদর। সবাই তিতলিকে যেন একেবারে বুকে করে রাখে। রাখবে নাই বা কেন! একেবারে পরির মত মেয়েটা!
রঞ্জন তিতলিকে শুনিয়ে একদিন বলল-‘জানিস ঋতম বাড়িতে এখন তিতলিই সব। আমাকে কেউ পোছেও না।’ এ কথায় তিতলি পিছন থেকে এসে রঞ্জনের চুলগুলো এমনভাবে এলোমেলো করে দিয়ে গেল যে হেসে ফেলল রঞ্জন।
হাসছিল ঋতমও। কিন্তু ক্ষণেক। হঠাৎ আজ প্রথম মনে পড়ল আর একজনের কথা। তিতলির থেকে কতই বা বড় হবে, যখন সে জেলা শহরে পড়তে চলে এল! অথচ…
রাতে ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিল সেদিন সবার সঙ্গে। একটা ভাল ব্যাপার, এ বাড়িতে কেউ সিরিয়াল দেখে না। যতটুকু দেখাদেখি, সব রিয়েলিটি শো। একটা বড় বাংলা চ্যানেলে ছোটদের নাচের রিয়েলিটি শো চালানো হয়েছে। নাচের রিয়েলিটি শো এমনিতে খারাপ লাগে না, কিন্তু… আবছা কানে গিয়েছিল সে এখানে রয়েছে। সেই থেকে এটা ও সুযোগ থাকলেও দেখেনি। আজ উঠে চলে যাওয়া যায় না। অভদ্রতা হয়ে যাবে। আর তাছাড়া…
-‘এবার বীরপুর থেকে আসছে…’
মাকে দর্শকাসনে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ভাগ্যিস রঞ্জনের সঙ্গে বাদলের দেখা হয়নি সেবার! নাহলে তো এতক্ষণে টেকাই মুশকিল হত।
-‘এত ভাল নাচে ছেলেটা!’ রঞ্জনের মার মুখে প্রশংসা।
-‘ওহ,কী পারফরমেন্স!’ আপ্লুত রঞ্জন, রঞ্জনের বাবা।
-‘যদি কোনওদিন দাদাটার সঙ্গে দেখা হয়, আমি একটা বড় ক্যাডবেরি দেব ওকে!’ তিতলি বলে ঋতমের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
-‘আজকের সেরা পারফরমেন্স…’ বিচারক নাম ঘোষণা করতেই রঞ্জন বলে ওঠে-‘আমি জানতাম বীরপুরই আজ জিতবে! আচ্ছা বীরপুরে তো তোরও বাড়ি ঋতম। চিনিস নাকি ছেলেটাকে?’
-‘বীরপুর কি ছোট জায়গা যে চিনবে! একদিন দেখাচ্ছিল তো জায়গাটা। আর তাছাড়া ঋতম তো পড়ালেখার ছেলে। ওর কি এসব দিকে…’ রঞ্জনের বাবা টিভির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন।
-‘আজকের জয় কাকে উৎসর্গ করবে…’ বিচারক শুধোন ছেলেটাকে।
-‘ছোটবেলা থেকে যাকে দেখে বড় হয়েছি, সব সময় হতে চেয়েছি যার মত, আমার সেই ঋতম দাদাকে আমি এই জয় অর্পণ করতে চাই…ঋতমদাদা আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসি…’ বিচারক ছুটে আসেন আসন ছেড়ে, অঝোরে কেঁদে চলা ছেলেটার চোখের জল মোছাতে।
-‘আরে তোর নাম করল তো! বীরপুরে আরও ঋতম আছে তাহলে?’ রঞ্জন তাকায় ঋতমের দিকে।
-‘হয়ত আরও আছে। তবে ও যার কথা বলল, সে আমি। ও আমার ভাই!’ চোখের জল গোপন করতে তাড়াতাড়ি উঠে বেসিনে চলে যায় ঋতম।
শিলিগুড়ি থেকে ফেরার সময় ঋতম বলে-‘আমি হোস্টেলে ফিরব না, সোজা বাড়ি যাব। কটা দিন প্রাইভেট কামাই হবে। বলে দিস স্যরদের।’
বীরপুর স্টেশনে নেমে মনে পড়ল তিতলির কথা। ঋতম বিরাট একটা ক্যাডবেরি কিনল স্টেশনের নিচের দোকানটা থেকে। ক্যাডবেরিটা নিয়ে কিছুটা এগিয়েছে, হঠাৎ মনে হল, ওর দিক থেকে তো কিছু…
আবার দোকানে ফিরল ও। কাজিন থেকে আপন ভাই হয়ে যাওয়া ছেলেটার জন্য বড় কম হয়ে যায়। তবে উপহারের আর ছোট বড় কী! আর একটা বড় ক্যাডবেরিই কিনল ঋতম।