Blog

অণুগল্প


ডালপুরি
তিন মাস পরে ছেলেটা আবার বসেছে। তেতালায় বসেও জানলা দিয়ে শোভন আওয়াজ পাচ্ছেন ওর ডালপুরি ভাজার। ষাট পেরিয়েছে, কিন্তু দোকানের ডালপুরির ব্যাপারে দুর্বলতা যায়নি। আগে মাঝে মাঝেই জানলা দিয়ে একটা ব্যাগ দড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে দিতেন। ডালপুরি ভেজে,প্যাক করে ছেলেটা ঢুকিয়ে দিত ঝোলায়। দাম মেটানো হত পরে। যখন দূরের কোনও দোকানে কিছু কিনতে নামতেন।
ছেলেটার ডালপুরির স্বাদই আলাদা। অনেকদিন পরে ওকে ডালপুরি ভাজতে দেখে মনটা আজ আবার আনচান করে উঠল শোভনের। কিন্তু খাওয়াটা কি ঠিক হবে? হাত দিয়েই তো সব করছে। খাচ্ছে অবশ্য অনেক লোক। সাতপাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত দড়ি লাগানো ঝোলাটা নিচে পাঠিয়েই দেন শোভন। তারপর উপর থেকে হাঁকে্ন,-‘সুরেশ,চারটে।’
সুরেশ উপরে তাকিয়ে বলে, ‘আপনাকে দেব না। এসব বাইরের জিনিস বয়স্কদের এখন না খাওয়াই ভালো।’
খালি ঝোলা উঠে আসে। শোভনের কিন্তু মনে হয়,ঝোলাটা একেবারে খালি নয়।
ছোট ছোটগল্প


গজা
অনেক বয়স অবধিও এটা ছিল। সব মিলিয়ে তিনটে। দুটো বাইরে থাকত। পাল্টাপাল্টি করে পরার জন্য। আর তিন নম্বরটা বিয়েবাড়ি বা ওই ধরণের কোথাও যেতে হলে বেরোত। এটা অবশ্য জামার হিসেব। প্যান্ট কিন্তু খুব বেশি হলে দুটো। এক্ষেত্রে তোলাতুলির ব্যাপার ছিল না। যখন যেটা পরিষ্কার,তখন সেটাই পরা। সে খেলার মাঠ হোক কিম্বা বিয়েবাড়ি।
আর এখন? আলমারি ভর্তি জামা,প্যান্ট। কোনও কোনওটার তো আলমারি-বাস তিন-চার বছর হয়ে গেলেও এক-দুবারের বেশি পরাই হয়নি। এসব জামা বা প্যান্ট আলমারিতেই পুরোনো হয়। তারপর একদি ন দেখা যায় যুগের ফ্যাশনের সঙ্গে রং বা কাটিংয়ে এরা চলতে অক্ষম। তখন অব্যবহৃত হয়ে বাতিল হওয়া জামাকাপড়ের ডাঁইয়ে এরা গিয়ে মেশে। কিন্তু,সে আলমারির জায়গাও তো অফুরান নয়!
সুচরিতা তাগাদা দেয়।-‘কিছু একটা করো!’
-‘কী করব? এসব দিয়ে তুমিই বরং স্টিলের বাসন-টাসন নিয়ে নাও। রক্তিম ব্যাপারটা সুচরিতার ঘাড়েই চাপাতে চায়।
বাসনওয়ালার দেখা পাওয়া তিনতলার এই ফ্ল্যাটে অত সহজ নয়। পাশের ফ্ল্যাটের বৌদির চেনা এক বাসনওয়ালা আছে। সে এখানে এলে এ ফ্ল্যাটেও টোকা দেয়। কিন্তু বহুযুগ হল তারও পাত্তা নেই।
একদিন ইভনিং ওয়াক থেকে ফিরে রক্তিম বলে-‘পুরোনো জামাপ্যান্টের একটা ব্যবস্থা হয়েছে।’
-‘কোথায়?’
-‘বাসস্ট্যান্ডের পাশে এসব দেওয়ার একটা জায়গা হয়েছে। নামটা ভারি সুন্দর।‘বিনা পয়সার বাজার।’ একটা এনজিও খুলেছে। ওরা না-ছেঁড়া পুরোনো জামাকাপড় সব সংগ্রহ করে। তারপর সেগুলো ভালোভাবে কেচে ইস্ত্রি করে গরিবদের দেয়। জামা-প্যান্ট সব বের করে রেখো। কাল সন্ধেবেলায় ব্যাগে করে ওখানেই দিয়ে আসব।’
এসব তিনমাস আগের ঘটনা। মনেও ছিল না।
তারপর আজ ট্রেনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটে ছেলেকেই চেনা লাগছিল রক্তিমের। অথচ, ওদের কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছিল না।
ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেনের গেটটায়। আঠারো থেকে বিশের মধ্যে বয়স। কেউই যে স্কুলমুখো হয়নি, সে ওদের চেহারা আর কথাবার্তাতেই বোঝা যাচ্ছিল। এক গজাওয়ালার সঙ্গে ওদের দরদাম চলছিল গজা নিয়ে।
কোথায় দেখেছে ওদের,রক্তিম খুব চেষ্টা করল মনে করার। গতকাল মেলায় গিয়েছিল,সুচরিতাকে নিয়ে। সেখানে দেখেছে কি ওদের? না তো!
ওদের জামাগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তাইতো,এগুলো তো ওরই ছিল এককালে! এজন্যই এত চেনা লাগছিল ওদের! এগুলো নিশ্চয় সেই ‘বিনা পয়সার বাজার’ থেকে নিয়েছে ওরা। কী সুন্দর কাটছাঁট করে নিয়ে পরেছে!
এই তিনটে জামা কিন্তু ওর একেবারে কম ব্যবহৃত ছিল না। তবু এখনও কেমন সুন্দর রয়ে গিয়েছে এগুলো! অথচ, আলমারিতে এগুলো অনাদরেই পড়েছিল। মূল্য ছিল না কোনও।
তিন জামার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি রক্তিমের মনে বিলি কেটে যায়। হঠাৎই বেশ ভালো লাগে ছেলেগুলোকে।
এগিয়ে যায় গেটের দিকে।–‘এই গজা খাবে তোমরা?’ ওদের সম্মতির অপেক্ষা না করেই রক্তিম গজাওয়ালাকে বলে-‘দাও, তিনজনকে দেড়শো করে।’
ছেলে তিনটে হাঁ। ওরা কী করে বুঝবে ‘বিনা পয়সার বাজার’ ওদেরকে দিয়ে আজ রক্তিমের কাছে কী উপঢৌকন পাঠিয়েছে!
ছেলে তিনটে কিন্তু বিনা প্রশ্নেই গজা নিয়ে খেতে শুরু করে। মচমচ আওয়াজ ওঠে। ওদের দিকে তাকিয়ে রক্তিমের মন জুড়েও মচমচ।
স্মৃতির শুকনো পাতায় হেঁটে গেলে বুঝি এমনই আওয়াজ হয়!