Blog

গল্পঃসাহিত্য/সাহিত্যিক (সুরসিক বিদ্যাসাগর)
সুরসিক বিদ্যাসাগর


একবার এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ সাহায্য চাইতে এসে বললেন,’আমার খুব দুরাবস্থা।’ সুপন্ডিত,দয়ালু মানুষটির কাছে অভাবী কারও সাহায্য চাইতে আসা নতুন কিছু নয়। এদিকে পন্ডিত মানুষটি আবার সুরসিক খুব। সাহায্য তো করবেনই,কিন্তু ব্রাহ্মণের ‘দুরাবস্থা’র ব্যাকরণগত ত্রুটি নিয়ে কৌতুক করার লোভ সামলাতে পারলেন না। ব্রাহ্মণের দৈন্যদশার ব্যাপারটা মাথায় রেখে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন। ‘আমার খুব দুরবস্থার’ পিঠে পিঠেই বলে উঠলেন,’সে তো আকার দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’সংস্কৃতের পন্ডিত মানেই যে শুষ্কং কাষ্ঠং নয়,সারাজীবন এরকম নানা রসিকতায় বুঝিয়ে গিয়েছেন তিনি। আসলে তাঁর জীবনটাই তো এক শিক্ষা। এমনকী রসিকতাতেও। কারণ,তিনি যে বিদ্যাসাগর!
১৮২০ এর ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৯১ এর ২৯ জুলাই মোটামুটি সত্তর বছরের একটা জীবন। কত কর্ম,কত ব্যস্ততা! আর এসবেরই সঙ্গে প্রতিনিয়ত জীবনের পাত্র থেকে উছলে ওঠা কত না রস-রসিকতা!
জীবনের শেষ পর্যায় তখন। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য এসেছেন চন্দননগর। চিরকালের মজলিশি মানুষ। এখানেও জুটে গেল লোকজন,আড্ডা।
গল্প চলে। চলে রসিকতাও। একদিন এক নেশাখোরের কথা শুনে বিদ্যাসাগর বললেন,’ও আমার প্রথমভাগের গোপাল।’
প্রথমভাগে বলা আছে,’গোপাল অতি সুবোধ বালক।’ তাই সকলে জিজ্ঞাসু হয়ে চাইলেন তাঁর দিকে।
বিদ্যাসাগর বললেন,’কেন,প্রথমভাগে পড়োনি,গোপাল বড় সুবোধ বালক,যা পায় তাই পরে,যা পায় তাই খায়! ইনিও তাই। যা পান তাই খান। মদ মদই সই,গাঁজা গাঁজাই সই। এটা খাব না,ওটা খাব না বলে উৎপাত করেন না।’
আর একদিন। চন্দননগরের স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনার সময়,ইংরেজদের সংশ্রবে এসে আমাদের কী লাভ এবং কী লোকসান হয়েছে সে প্রসঙ্গ উঠল। লাভের কথায়,রেলপথ,ডাক্তার,তার-এসবের কথা এল। আর লোকসানের প্রসঙ্গে কেউ বললেন শান্তির কথা, কেউ বললেন স্বাস্থ্যের কথা।
বিদ্যাসাগর নীরবে সকলের বক্তব্য শুনছিলেন। এবার সমবেত সকলে জানতে চাইলেন তাঁর অভিমত। বিদ্যাসাগর বললেন,’লাভ লোকসান অত খতিয়ে দেখিনি। তবে ইংরেজদের কাছ থেকে আমরা তিনটি ভালো জিনিস পেয়েছি। এক,ইংরেজি সাহিত্য। দুই, বরফ। তিন,পাঁউরুটি।’ ইংরেজি সাহিত্য,বরফ, পাঁউরুটিকে এক তালিকাভুক্ত করাতে সকলেই হেসে উঠলেন।
ওই চন্দননগরেই এক কবিরাজ বিকেলে গিয়ে বসতেন বিদ্যাসাগরের কাছে। বিদ্যাসাগর নিজের পীড়া নিয়ে কবিরাজমশাইয়ের পরামর্শ নিতেন। কবিরাজমশাইয়ের অন্যান্য বিষয়েও বেশ জ্ঞান ছিল। বিদ্যাসাগরকে একদিন শুধোলেন,’সব শাস্ত্রেই মুক্তির কথা লেখে,এই মুক্তির স্বরূপটা কীরকম?’
বিদ্যাসাগর সহজে কারও সঙ্গে শাস্ত্র-আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন না। সেদিনও তাই কবিরাজমশাইয়ের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুললেন। কিন্তু কবিরাজমশাই তো নাছোড়বান্দা। আবার শুধোলেন প্রশ্নটা। বিদ্যাসাগর বললেন,’কেন এই বুড়ো বামুনটাকে বেত খাওয়াবে?’
কবিরাজমশাই অবাক। ‘আমি আপনাকে বেত খাওয়াব কীভাবে?’
বিদ্যাসাগর বললেন,’মুক্তি সম্পর্কে আমার যে ধারণা, সেটা যদি ভুল হয় তো চিত্রগুপ্ত মৃত্যুর পর এমনিতেই আমাকে বেত মারবেন। তার উপর তুমি যদি আমার ধারণা বিশ্বাস করে ফেলো,তবে তুমি ওখানে গিয়ে সেকথা বললে আবার বেত খাব। কারণ চিত্রগুপ্ত তো তোমাকে শুধোবেই,কে এই জ্ঞান দিয়েছে। তখন তুমি তো আমাকে না-দেখিয়ে পারবে না। তার থেকে এ সম্পর্কে তুমি যা জানো সেটা নিয়েই থাকো। আর আমি থাকি আমার ধারণা নিয়ে। ওসব কথা জিজ্ঞেস করে আমাকে আর ফ্যাসাদে ফেলো না।’
কবিরাজমশাই হয়তো এমন ব্যাখ্যার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। তবে তিনি বিদ্যাসাগরের কথা নিশ্চয়ই উপভোগ করেছিলেন।
বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের ঘরে। কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনও গোঁড়ামি ছিল না। ধর্মীয় উদারতা তাঁর চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তো,সেবার এক গ্রামের দিকে বেড়াতে গিয়েছেন বিদ্যাসাগর। সেখানে ছিল একটি ব্রাহ্মসমাজ। বিদ্যাসাগর এসেছেন শুনে ব্রাহ্মেরা তাঁর কাছে দেখা করতে এলেন। অনুরোধ করলেন,তাঁদের সমাজে একটিবার আসার জন্য। ব্রাহ্মদের আগ্রহ দেখে বিদ্যাসাগর অসম্মত হলেন না,গেলেন।
বিদ্যাসাগরের আগমনে সেদিন ভিড় কিছু বেশিই হয়েছিল ব্রাহ্মসমাজে। বাইরে জুতো রেখে ভিতরের মেঝেতে ঢালা বিছানায় বসার ব্যবস্থা। উপাসনা পর্ব চুকল। বাইরে বেরিয়ে এসে বিদ্যাসাগর দেখেন অন্ধকার,তার উপর ভিড়। তিনি আর নিজের চটি জোড়া খুঁজে পান না। ব্যর্থ হয়ে সুরসিক বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মদের উদ্দেশে বলে উঠলেন,’তোমরা তো ও ঘরে ঢুকলে আর চোখ বুজে নিরাকার ঈশ্বর দেখে এলে, এদিকে আমি যে তালতলার সাকার চটি-জুতো জোড়াটি দেখতে পাই না।’
বিদ্যাসাগরের এই কথা শুনে সমবেত দর্শকদের মধ্যে অনেকেই যে সেদিন হাসি সংবরণ করতে পারেননি,তা বলাই যায়।