Blog

অণুগল্প


টিকটিকি
ফ্ল্যাটের নিচেই সব্জি নিয়ে বসেছে একজন। ভিড় নেই। তবু ক্রেতা একেবারে শূন্য হলে,মুখে মাস্ক বেঁধে তেতালা থেকে নামল তমাল।
হাতে ঝোলা। আগে নিজে বেছে সবজি কিনত। এখন প্রশ্নই ওঠে না। বাজারে দরদাম বলে যে কোনও একটা ব্যাপার আছে,সেটাও যেন ভুলে গেছে। করোনা পালটে দিয়েছে সব।
মানুষ এখন সবচেয়ে ভয়ের জীব। যদি কোনও ক্রেতা এক্ষুনি এসে জুটে যায় সে ভয়ে যতটা তাড়াতাড়ি পারল তমাল সবজি কিনল। তারপর প্রায় দৌড়ে ফিরল ফ্ল্যাটের দরজায়।
সবজিগুলো ধোয়ার জন্য তৃণাকে ঝোলাটা দিয়ে তমাল ঢুকে গেল বাথরুমে। মাস্ক ফেলে ,হাত পা সাবান দিয়ে ধুচ্ছে এমন সময় দেখল মোটা টিকটিকিটা বাথরুমের দেওয়ালে। আগে হলে ওটাকে তাড়িয়ে ছাড়ত তমাল। এখন আর ইচ্ছে হল না। টিকটিকিটাও তমালকে ধর্তব্যের মধ্যে আনল না। এ দেওয়াল সে দেওয়াল করতে লাগল। আগেও কি এরকমই করত?
দ্রুত উপরে উঠে এসেছে,তবু আসার সময় ফ্ল্যাটের নিচের কুকুরগুলোকেও একনজর দেখে কেমন অন্যরকম লাগছিল। কেমন একটা ভ্রুক্ষেপহীন চালচলন। এমনকী প্রাচীরে বসা কাকটাও ঠাঁই বসেছিল। দ্রুত আসার জন্য ওর পদশব্দ ভারী হওয়া সত্ত্বেও। এটাও একটু আশ্চর্যের লেগেছিল তমালের।
টিকটিকিটাকে কি একটু ভয় দেখাবে তবে? থাক। যদি ভয় না পায়,তবে সেটা আরও চিন্তার হবে। বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে টিকটিকিটার দিকে ফিরে তমাল ফিসফিস করে বলে উঠল-‘তোরা কি ধরেই নিয়েছিস,মানুষের দিন শেষ!…’
প্যাঁচা


‘একশোজন ক্যান্ডিডেট ছিল। সবাইকে বাদ দিয়ে শেষে পছন্দ হল একটা প্যাঁচাকে। ধন্য আমাদের এমডি!’ ক্যান্টিনে বসে গজগজ করেন চন্দ্র চট্টরাজ।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বিজয় সাকসেনা বলেন-‘কেন প্যাঁচা কি কাজ পারছে না কিছু?’
-‘কাজ এমন কি আহামরি যে পারবে না!কথা কাজ নিয়ে নয়,দর্শন নিয়ে। পাশে বসে।এমন প্যাঁচা-মুখ, একটা গল্পও করা যায় না।’
প্যাঁচার আসল নাম মলয় আঢ্য। এই অফিসের কনিষ্ঠ করণিক। জয়েন করেছেন মাস দুয়েক। মুখটায় একটু প্যাঁচা-প্যাঁচা ভাব, সেজন্য প্রথমদিন থেকেই অফিসে আড়ালে তিনি প্যাঁচা। কর্মক্ষেত্রে ভালো চেহারার জন্য অনেকে মাইলেজ পায়,আবার চেহারা খারাপ হলে,দক্ষতা থাকলেও অনেকসময় কারও কপালে অকারণে ঠোক্কর আসে। মলয় দ্বিতীয় দলের।
কথা তো কেউ বলেনই না,উপরন্তু অফিসে সবাই আজকাল সুকুমার রায়ের ভীষণ ভক্ত হয়ে উঠেছেন। এ টেবিল থেকে কেউ আবৃত্তি করেন-‘প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি…’ তো ও-টেবিল থেকে-‘শু্নতে পেলুম পোস্তা গিয়ে…’, এবং অবশ্যই ‘ তার উপরে মুখের গড়ন/অনেকটা ঠিক পেঁচার মতন’কে বেশি জোর দিয়ে।
আর আড়ালে? আজকের ক্যান্টিনের আলোচনার মত আলোচনা তো রয়েছেই। মলয় কি এসব কিছু বোঝেন? হয়ত,আবার হয়ত নয়।
সেদিন চন্দ্র আসেননি। কী ব্যাপার? শোনা গেল জ্বর। চন্দ্র পরের দিনও অনুপস্থিত। সবাই ভেবেছিল, করোনা। অফিসে ফোন এল চন্দ্রের স্ত্রী,শ্রীর। জানা গেল,করোনা নয়,ডেঙ্গি হয়েছে চন্দ্রের। রক্ত লাগবে বি-পজিটিভ। রক্তের একেবারে কমন গ্রুপ। অনেকেরই আছে। কিন্তু এই করোনার কালে ডোনার হবার প্রশ্নে অন্তরঙ্গেরা সবাইই নিশ্চুপ।
ডেঙ্গি থেকে সেরে একদিন অফিসে ফিরলেন চন্দ্র। ক্যান্টিনে সাকসেনা বললেন-‘ আপনার মুখ থেকে কতদিন প্যাঁচার গল্প শুনিনি!’
কথাটা শুনে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন চন্দ্র।
ডেঙ্গি থেকে যে সেরে উঠতে পেরেছেন,সে তো ওই প্যাঁচারই জন্য।
রক্ত দেবার প্রশ্নে সবাই যখন নিশ্চুপ। তখন নিজে এবং কয়েকজন ডোনার জোগাড় করে,সবাইকে নিয়ে চন্দ্রের জন্য রক্ত দিয়ে এসেছেন প্যাঁচা ওরফে মলয়। সাকসেনাকে অতসব বলতে ইচ্ছে হল না চন্দ্রের।
শুধু বললেন-‘ওর আসল নাম কিন্তু মলয়। মলয় মানে বাতাস। যে বাতাস না হলে…’
চাটা শেষ হয়ে গেছিল। তাই কথাটা আর শেষ করার প্রয়োজন মনে করলেন না চন্দ্র। বেরিয়ে গেলেন ক্যান্টিন থেকে।