Ami Mishuk | আমি মিশুক গল্পঃ অণুগল্প (নাথিং,সামথিং)

গল্পঃঅণুগল্প (নাথিং,সামথিং)নাথিং

ছাব্বিশ জনের মধ্যে এসেছে একুশ জন। বাকি পাঁচ জন দেশের বাইরে। যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি কলেজ। ছাব্বিশে একুশ,বেশ ভালো উপস্থিতি। মঞ্চ একেবারে ভরে গিয়েছে।
একেবারে প্রথমে ডক্টর বিনয় সাক্সেনা,তারপর প্রফেসর কুশল বোস,তৃতীয় স্থানে বিজ্ঞানী আশিস তলাপাত্র…। এইভাবে দলের নামী দামিদের একেবারে শেষে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন অ-নামী,অ-দামি ব্যক্তি,নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দ দাস। একটা বেসরকারি সংস্থার করণিক। বাদবাকি কুড়ি জনের পাশে যে, নিত্যানন্দের ভাষায়, ‘নাথিং’।
দলের মধ্যে নিজেকে কেমন বেমানান লাগে নিত্যানন্দের। এরকম ব্যাচ অনুযায়ী পরিচিতির পাঠ থাকবে জানলে এই পুনর্মিলন উৎসবে ও কিছুতেই আসত না।
বিনয় নিজের কথা শুরু করেছে। ও বাবা,সামনের পর্দাতে  ফুটে উঠছে ওর কর্মক্ষেত্র,দৈনন্দিনের টুকরো। এসব বিনয় নিশ্চয়ই নিজের পেনড্রাইভে ভরে,সাপ্লাই দিয়েছে ওদের। বিনয়ের পর কুশলেরও এক ঘটনা। ও মুখে বলছে,আর পর্দায় ফুটে উঠছে ওর কীর্তিকথা। আগের মতই কখনও স্টিল,কখনও  ভিডিয়ো।
ওদেরকে নিশ্চয়ই কলেজ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, এসব নিয়ে আসতে। আশ্চর্য,নিত্যানন্দকে তো কেউ বলেনি। একবার কেবল কলেজ থেকে একটা মেয়ে শুধিয়েছিল,ওর পেশার কথা। বোঝা যাচ্ছে,পেশার কথা শুনেই ওরা আর উৎসাহ দেখায়নি। 
তা না উৎসাহ দেখাক,মুখে তো কিছু বলতে হবে। নিত্যানন্দ মনে মনে গুছিয়ে নেয় কথাগুলো। ওর টার্ন আসতেই নিত্যানন্দ বলে-‘আমার আসলে দাঁড়ানো উচিত ছিল সবার আগে। অন্ধকার না-হলে যেমন আলো ঠিক বোঝা যায় না তেমনই,আমি প্রথমে আমার কথা বলে নিলে,আমার বৈপরীত্যে বন্ধুরা আরও আলোকিত হত বলে মনে হয়। 
‘যাইহোক,নিজের পরিচয় দিই। আমি এই কুড়ি জনের এক ব্যর্থ সহপাঠী। একটা বেসরকারি সংস্থায়,গেলে পয়সা পাব,না গেলে পাব না,এই ভিত্তিতে কেরানির কাজ করি। বন্ধুদের পাশে,আমাকে বলতে পারেন ‘নাথিং’।
‘নাথিং থেকেই তো সৃষ্টি হয়েছে এভরিথিং-এর!’ হঠাৎ অডিয়েন্স মাইক্রোফোনে একটা চেনা কন্ঠ। শীলভদ্র। কিন্তু কোথায় দাঁড়িয়ে বলছে ও? আরে,এ যে একেবারে দর্শকদের মাঝে দাঁড়িয়ে!
‘স্যার,আমি এই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেরই ছাত্র। আপনার কাছে আমরা আপনার কর্মক্ষেত্র,জীবনের কিছু জানতে চাইনি ইচ্ছে করেই। আসলে,এই পুনর্মিলন উৎসবের সম্পাদক হিসাবে আমার মনে হয়েছিল,আপনি কেন আপনার  নিজের কথা বলবেন? তাহলে আমরা রয়েছি কী জন্য? আপনি নাথিং হতে পারেন,কিন্তু আপনার হাতে গড়া এই সামথিংদের তো আজ চেঁচিয়ে বলার দিন!’
শীলভদ্র বলে চলে-‘যেসব পথশিশুদের দিকে মানুষ ফিরেও তাকায় না,তাকালেও অবজ্ঞাভরে ছুঁড়ে দেয় এক-আধটা টাকা অথবা উচ্ছিষ্ট খাবার,এই নাথিং স্যার দিনের পর দিন তাদের খাবার দিয়ে,যত্ন দিয়ে,শিক্ষার ব্যবস্থা করে ,জীবন গড়ে দেওয়ার কাজ করে চলেছেন। কোনও প্রচার নেই,কোনও আড়ম্বর নেই,উনি নিঃশব্দে আলো দেখিয়ে চলেছেন তাদের।
‘আমি সেই আলোকপ্রাপ্ত পথশিশুদেরই একজন। আমার নামটাও স্যারেরই  দেওয়া। উনি সামান্য করণিক হতে পারেন। কিন্তু,আমাদের-আমাদের কাছে উনি ভগবান।পর্দায় এবারে দেখে নিন,স্যারের হাতে দ্বিতীয় জীবন পাওয়া অসংখ্য পথশিশুর কয়েকজনকে। আর শুনুন তাদের কথা।’
নিত্যানন্দ তাকিয়ে থাকে পর্দার দিকে। কেমন যেন লজ্জা লাগে। দিব্যি ঢেকে রেখেছিল সব। আজ ছেলেটা একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল।
কিন্তু কনিষ্ক,রাসেল,জাহানারা,পারিজাত,বিপ্লব সবার নাম আর ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘আগুনের পরশমণি’ই তো শুনে চলেছে। কাউকে দেখতেই পাচ্ছে না। অবশ্য দেখবেই বা কী করে? নিত্যানন্দের দুচোখে যে বন্যা। 

সামথিং

মশা কামড়াচ্ছে। কামড়াক। মাথার উপর পাখির নোংরা পড়ল। পড়ুক। এই বয়সে রাতে এমনি ওঠেনি গাছে। একটা হেস্ত নেস্ত আজ করবেই।
যতই সস্তা হোক, এরকম হবে জানলে এ পাড়ায় সত্যিই বাসা নিত না। এর আগে জোড়াপুকুরের ধারে ন’বছর কাটিয়ে এসেছে। কোনও অশান্তি হয়নি কিন্তু এখানে কয়েকমাসেই…। শিক্ষিত মানুষ,সবটা যে নিজেকে বলতেই রুচিতে বাঁধে! কিন্তু এটা তো ঠিক,সামথিং ইজ রং হেয়ার। এবং এই’ রং’ সহ্য করা কঠিন।
বাতাসে  কিছুদিন ধরেই ফিসফাস চলছিল। সেদিন প্রকাশ্যেই বলে দিল পাড়ার দিনু মুদি-‘ঘর সামলান মাস্টার। ঘরে গ্রহণ লেগেছে।’
বিয়ের পর চৌদ্দটা বছর  কিন্তু কোনও বেচাল দেখেনি বউয়ের। এখনও যে আচার আচরণে  অস্বাভাবিক কিছু আছে তা নয়। করোনায় একটা একটা করে টিউশন চলে গিয়েছে। তবু টলে যায়নি। টিকে থাকা খান কতক টিউশনের সামান্য টাকায় হাসিমুখেই চালাচ্ছে দুজনের সংসার।
কিন্তু ওই যে,ও টিউশনে গেলেই নাকি বখাটে ছোঁড়াটা এসে জোটে।
ছেলেটার কথার আওয়াজ পাচ্ছে। গাছ থেকে নামল পবন। চুপিসাড়ে বারান্দায় উঠে কান পাতল দরজায়।
-না,না বিপ্লব এভাবে প্রায়-রোজ-
-কেন বারণ করছ কাকিমা?
-তোমার কাকু টের পেলে,মুখ দেখাতে পারব না।
ঘরে কি ঢুকবে পবন এবারে? ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে যায়।
-‘কাকুর টিউশন কমে গেছে। তোমাদের চলছে না আমি জানি। কেন না করছ? আমার মা নেই। তোমার মধ্যে আমি আমার মাকে দেখেছি। তোমার কষ্ট হলে আমার কি ভালো লাগবে বলো!-প্লিস কাকিমা ফিরিয়ে দিয়ো না। রাখো  টাকাটা।’
ছেলেটা বেরোচ্ছে। আবার লুকোতে হবে। আবার কি গাছে?  সেই ভাল।  গাছের একটা নিজস্ব জল-মোছানো রুমাল আছে। কাজে লাগবে।