গল্পঃ একটা চুরি

 

গল্প   

Ami Mishuk | আমি মিশুক গল্পঃ একটা চুরি

একটা চুরি              

চোর ঢুকেছিল এটা স্পষ্ট। কিন্তু কী চুরি হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। 

তবে ঘর লন্ডভণ্ড।না,আলমারি খোলেনি কেউ।ড্রেসিং টেবিলের কাচ সরিয়েও কেউ দেখেনি ওখানে কী আছে। শোকেসের নিচের সেলফে দলিল-দস্তাবেজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা মার গয়নার বাক্সটাও কেউ টেনে বের করেনি। 

কিন্তু যা হয়েছে তাও কম নয়। টেবিলের উপর রাখা জলের জক উল্টে মেঝে জলমগ্ন হয়েছে। তরকারির ঝুড়ি উল্টে আলু পটল সব মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গ্যাসের পাশে রাখা ভাতের খালি জায়গাটা কাত হয়ে গিয়েছে। ড্রইংরুমের সোফাটার অবস্থাও ভাল নয়।বেশ খানিকটা ছেঁড়া। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি সোফাটার মধ্যেও কিছু খুঁজেছে। 

আলু পটল যেভাবে ছড়ানো তাতে মনে হয় ওগুলোর জন্যই চোরের আগমন। কিন্তু চোর আলু পটল নিতে আসবে না এটা নিশ্চিত। তাই ওগুলো পরিমাণে কমেছে না কমেনি,তা নিয়ে মাথা ঘামাতে কৃষ্ণেন্দু রাজি নন। আপাতত যেটা নিয়ে একেবারেই সংশয় নেই সেটা হল,ফ্ল্যাটে চোরটা ঢুকেছিল সকাল দশটা থেকে পাঁচটার মধ্যে,যে সময়টায় কর্তা গিন্নি দুজনেই বাইরে।

কিন্তু চোরটা ঢুকল কীভাবে? নিচের গেটে তো সিকিউরিটি। সুতরাং সামনে দিয়ে কেউ ঢোকেনি,এটা ঠিক। যদিও ফ্ল্যাটের পিছন দিকটায় বাড়ি নেই,দুপুরের সময়টায় ওদিকের রাস্তাটা জনশূন্যও থাকে এবং সিকিউরিটির লোকেরাও ওদিকে কালেভদ্রে যায়,তবু দিনের বেলা ওদিক দিয়েও ফ্ল্যাটে ঢোকার সাহস কি কেউ পাবে! 

অথচ পেয়েছে যে তা তো পরিষ্কার। কৃষ্ণেন্দু চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। ড্রইংরুমের ওদিকের জানলা দুটো বাদ দিয়ে তো সব দিকই বন্ধ,আর খোলা জানলা দুটোতেও লোহার শিক! হতে পারে লোহার শিকের ফাঁক গুলো একটু বড়,কিন্তু সে ফাঁক দিয়ে বিড়াল টিরাল গলতে পারলেও মানুষ গলা অসম্ভব। বাঁদিকের জানলাটার একটা শিক অবশ্য আলগা। কসরত করলে ওটা খোলাও যায়। কিন্তু সেটা যদি কেউ আগাম জেনে থাকে তবেই সম্ভব। চোরেরা অবশ্য অনেক খোঁজখবর নিয়ে আসে।সুতরাং বলা যায় না হযত ওখান দিয়েই…।

পুলিশে খবর দেওয়া হল। পুলিশ এ অঞ্চলে খুবই তত্‍পর।খবর পেয়েই ছুটে এলেন থানার লস্কর দারোগা। সঙ্গে দুই কনস্টেবল। কৃষ্ণেন্দু জানলার শিকের ব্যাপারটা নিজে থেকেই বললেন। লস্কর দারোগা শিকটা নেড়েচেড়ে বললেন-‘তিন তলার উপর ফ্ল্যাট,অন্য দরজা জানলা যখন ভাঙ্গেনি তখন তো এটাই একমাত্র প্রবেশপথ।–এখন বলুন কী কী খোয়া গেছে?’

খোয়া যাওয়ার ব্যপারে কৃষ্ণেন্দু এখনও অন্ধকারে। বললেন সেটাই।

-‘আচ্ছা-’ লস্কর দারোগা বেশ চিন্তিত মুখে বললেন-‘আপনার বা মিসেসের অফিসের কোনও কাগজ-টাগজ খোয়া যায়নি তো?’

পারমিতা স্কুলে পড়ায়। স্কুলের খাতা ছাড়া বাড়িতে কিছু আনে না। খাতা নিতে কেউ আসবে না। তাছাড়া এটা পরীক্ষার মরসুমও নয়। নিজের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ব্যাপার। তবু কৃষ্ণেন্দু টেবিলের উপর রাখা অফিসের ফাইলটা একটু উল্টে দেখে নিলেন। তারপর বললেন-‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমার কাছে থাকে না,তবু..না,সব ঠিকই তো আছে দেখছি।’

এরপর এসব ক্ষেত্রে দারোগা পুলিশ যা জিজ্ঞেস করে থাকে সে সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল কৃষ্ণেন্দু ও পারমিতাকে।যেমন,আপনাদের সঙ্গে কারও শত্রুতা আছে কিনা,কাউকে সন্দেহ হয় কিনা,পরিবারে কে কে আছে,কর্মস্থানে কোনও সমস্যা আছে কিনা ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের যেসব উত্তর কর্তা গিন্নি দিলেন কোনওটাই চুরির কিনারা করার মত নয়।কাজেই লস্কর দারোগাকে ফিরতে হল নিরাশ হয়ে। যাওয়ার আগে উনি বলে গেলেন,যদি আবার কিছু ঘটে এবং যদি কিছু খোয়া গিয়েছে বোঝা যায় তাহলে যেন খবর দেওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গে।

নশো স্কোয়ারফুটের এই ফ্ল্যাটটা কৃষ্ণেন্দু কিনেছেন বছর ছয়েক আগে। ব্যাঙ্কে এখনও বেশ মোটা অঙ্কের ঋণ। তবে ঋণটা শোধ হয়ে যাবে শিগগিরই। গ্রামের এক বিঘে জমির উপর গাছ্গাছালি  সমেত বাড়িটা হস্তান্তরিত হবার সব বন্দোবস্ত পাকা। দূরসম্পর্কের এক পিসি ওখানে রয়েছেন। এই ফ্ল্যাটের একটা ঘর তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছে। নিঃসন্তান বিধবা পিসি এখানে চলে এলে পিসির কেমন লাগবে জানা নেই। এত বড় ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কৃষ্ণেন্দু ওসব ভাবতেও রাজি নন। ঠিক হয়েছে ওখানেও আবাসন তৈরি হবে। কৃষ্ণেন্দুকে টাকা আর একটা ফ্ল্যাট দিতে চেয়েছিল প্রোমোটার।কৃষ্ণেন্দু ওখানে ফ্ল্যাট নিয়ে কী করবে? ও সবটাই তাই ক্যাশে চেয়েছে।

কৃষ্ণেন্দু অন্যদিন খাবার খেয়ে কাগজটা পড়েন। তারপর পারমিতা কাজ সেরে এলে দুজনে বসেন কাগজের শব্দছকটা  নিয়ে। আজ জিনিসপত্র গোছগাছ করতে অনেকটা সময় চলে গেল। তার উপর মনটাও অশান্ত। কী চুরি হয়েছে এখনও বোঝা যায়নি। ঘরে একটা উটকো লোক কী কারণে ঢুকল সেটা না জানা অব্দি কাগজ টাগজ পড়া কঠিন। আর শব্দছকের তো প্রশ্নই আসে না। একবার মনে হল সোহমকে একটা ফোন করবেন। কিন্তু কী বলবেন ওকে ফোনে? এখন ওর সেমিস্টার চলছে। রোজ ফোন করেন না।একদিন অন্তর করেন।কাল করেছেন। আজ আবার করলে ছেলের পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আর তাছাড়া এই চুরির ব্যাপারটা যদি মুখ ফসকে বলে ফেলেন তা হলে ছেলেটাও উদ্বিগ্ন হবে।

কৃষ্ণেন্দু পারমিতা আসার আগেই শুয়ে পড়লেন বিছানায়।

পরদিন সকালে উঠে দক্ষিণদিকের ঘরের জানলাটা খুলে ডিভানটার উপর বসলেন চা নিয়ে। এ সময় পারমিতা রান্নার মাসির সঙ্গে হাত লাগায়। আর কৃষ্ণেন্দু অতিথি সত্‍কারে ব্যস্ত থাকেন। প্রতিদিন তিন তিনজন অতিথি আসে জানলায বিস্কুট খেতে।আজও তার অন্যথা হল না। প্রথমে এল কাকটা,তারপর পাযরা আর শেষে চুড়ুইটা।

ওরা একে একে আসতেই বিস্কুটের কৌটো থেকে বিস্কুট নিয়ে ভেঙে ভেঙে কৃষ্ণেন্দু সন্তর্পণে রাখলেন ওদের আওতার মধ্যে। ওরা  রোজকার মতই বিস্কুট খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল। চড়ুইটার চাহিদা কম।তাই একটু খায আর জানলার শিকের তলায় গিয়ে বসে।পায়রাটা রোজই খুব ভয়ে ভয়ে ঠুকরোয়। আজও তার সেরকমই আচরণ। সবচেয়ে চালাক আর চাহিদাসম্পন্ন হল কাকটা।বড় বড় টুকরোগুলো নেয় আর উড়ে গিয়ে রেখে আসে মুখোমুখি ছাদটায়। কৃষ্ণেন্দু একমনে দেখে যান প্রাণী তিনটের কান্ড। একসময় কাকটাকে অনুসরণ করে মুখোমুখি ছাদটায় তাকাতেই নজরে পড়ল একটা অদ্ভুত দৃশ্য। 

সে দৃশ্য দেখে কৃষ্ণেন্দু হো হো করে হেসে উঠলেন আপন মনেই। তারপর মোবাইলের বোতাম টিপে লস্কর দারোগাকে ধরে বললেন-‘চোর কে হদিশ পাওয়া গেছে,আর কী খোযা গেছে জানা গেছে তা-ও।’

-‘তাই নাকি!’ লস্কর দারোগা বেজায় উত্তেজিত।–‘ভয় পাবেন না আমরা যাচ্ছি।–কিন্তু চোরটা এখন কোথায়?’

-‘আমার উল্টোদিকের ছাদে।’

-‘ওখানে কী করছে বলুন তো?’

-‘আপাতত আমার খোয়া যাওয়া কাচ-ভাঙা চশমাটা পরে,আমার আর একটা খোয়া যাওয়া জিনিস-একটা নারকেল-ফাটিয়ে খাবার চেষ্টা করছে।’

-‘লোকটা পাগল টাগল নয় তো?’

-‘না না পাগল নয়,আর ও লোকও নয়।’  

-‘কী বলছেন অবোলতাবোল!’

-‘ঠিকই বলেছি। চোর মানুষ নয়,একটা বাচ্চা হনুমান।’

-‘যত সব রাবিশ!’ ও প্রান্তে ফোন রাখার কট আওয়াজ হয়।

আর এদিকে কাচ-ভাঙ্গা চশমা পরা হনুমানটাকে দেখে আবার এক চোট হাসতে গিয়েও সামলে নেন কৃষ্ণেন্দু। বিয়ের আগের ওই চশমটা ব্যবহারযোগ্যতা হরিয়েছে বছর পনের আগে। তবু অনেক বাতিল জিনিস যেমন ফেলা হ্য় না,তেমনি ফেলা হযনি ওটাও। কিন্তু আজ ওটা আবার এক না-মানুষের চোখে চড়ে কিছু কি বলতে চাইছে! অনেকক্ষণ কাচ ভাঙ্গা চশমায় হনুমানটাকে দেখেন কৃষ্ণেন্দু। দৃষ্টিটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে আসে। কাচভাঙ্গা চশমায় হনুমানটাকে কেমন শরণার্থী মনে হয়।

মস্ত এক বাগান কেটে এই বসতি। ফ্ল্যাটে-বাড়িতে ছয়লাপ এই জায়গাটা তো এককালে ওদেরই ছিল! অথচ আজ…।মা বাবার মুখে ওঁদের দেশ ছেড়ে আসার সময়কার শরণার্থী জীবনের কথা শুনেছেন। এরকম একটা চশমা মনে মনে বাবার চোখে পরিয়ে দেন কৃষ্ণেন্দু। মনটা ককিয়ে ওঠে।মা বাবা গত হয়েছেন। কৃষ্ণেন্দুর চোখেও এখন নতুন চশমা। তবু মা-বাবার কথা,গ্রামের আকর্ষণ এখনও সবটুকু ঝেড়ে ফেলতে পেরেছেন কি? এখনও তো কাক,চড়ুই,পায়রাদের খাবার খাওয়ান। তাহলে!

পারমিতার মুখটা এক ঝলক ভেসে ওঠে। কিন্তু ওখানে বৈষয়িক কোনও ব্যাপারে বাধার কোনও অস্তিত্ব কোনওদিনই ছিল না,আজও থাকবে না এটা বলাই যায়। সিদ্ধান্তটা কৃষ্ণেন্দু তাই নিয়েই ফেলেন। গাছ-গাছালিতে ভরা সেই গ্রামের বাড়িটা-যেখানে মানুষের সঙ্গে না-মানুষেরাও দিব্যি থাকে,সেটা যেমন আছে তেমনি রাখার সিদ্ধান্ত।

কৃষ্ণেন্দু মোবাইলের ফোনবুকে বাড়ির প্রোমোটারের  নম্বরটা খোঁজেন।