গল্পঃ ছোটদের গল্প (অপয়া)

 

Ami Mishuk | আমি মিশুক গল্পঃ ছোটদের গল্প (অপয়া)

ছোটদের গল্প

অপয়া 

আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট। অন্য আর পাঁচটা পরীক্ষার্থীর মত অপয়ারও বুক দুরু দুরু। সকাল থেকেই কোনও কাজে মন লাগছে না। এরই মধ্যে মা এসে দুবার শাসানি দিয়ে গেছে,’ধিঙ্গি মেয়ে,এই কটা বাসন নিয়ে এখনও বসে আছ,মেজে শেষ করতে পারছ না!’
-‘দিদি!’ হঠাৎ চাপা স্বরে চেনা ডাক।
অপয়া বাসন থেকে চোখ তোলে। রোজকার মত নিধি। হাজির দুধের গ্লাস নিয়ে। অপয়ার চোখে আজ দ্বিধার চেয়ে ভয় বেশি। বাড়িতে বাবাও রয়েছে। মানে দু’জোড়া চোখ। যদি ধরা পড়ে যায়! এই ছোট্ট ভাইটার কাছে ও রোজই হার মানে। ওকে গ্লাসের অর্ধেক দুধ না খাইয়ে ও খাবে না।
কিন্তু আজ সেটা অসম্ভব। অপয়া চোখের ইশারায় ভাইকে চলে যেতে বলে। ভাই তা শুনলে তো!  শুরু করে সেই জোরাজুরি। জোরাজুরিতে হার মানতেই যা ভাবা গিয়েছিল ঘটে তাই। মা ধরে ফেলে। এরপর বাবার উদ্দেশে মার চিল চীৎকার-‘দেখে যাও অপয়ার কীর্তি! বাসন ফেলে ভাই-এর দুধ কেড়ে খাচ্ছে হতচ্ছাড়ি!’
বাবা দৌড়ে আসে।অপয়ার পিঠে দুমদাম নেমে আসে বেশ কয়েকটা কিল। এসব কিল অপয়া হরদমই খায়। অভ্যেস  হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করে না। করার কথা ভাবেও না।
ওর জন্মের দিনেই বাবার কারখানার চাকরিটা যায়। সেদিন থেকেই ও নাম পেয়েছে,অপয়া। এরপর দিনে দিনে নামটা পোক্ত হয়েছে আরও বেশ কিছু দুর্ঘটনায়। কয়েকদিন পরেই ওদের সামান্য যে জমি,তার ধান কেটে নিয়ে যায় ডাকাতের দল। এর একদিন পরে জমির ধারের ফলন্ত নারকেল গাছটায় বাজ পড়ে। মারা যায় দুধ দেওয়া গাইটাও। বাবা মা দুজনেই  এরপর থেকে বলতে থাকে-‘ও আমাদের খেতে এসেছে।’
এরপর  কিল চড় ছাড়া আর কি ওর প্রাপ্য হতে পারে!
 অপয়ার একটা ভাল নাম আছে। সোনালি। অনেকটা কানাছেলের নাম পদ্মলোচনের মত। আসলে অপয়া নামের সঙ্গে যেন মানানসই ওর চেহারাটাও। যে দেখে সেই বলে,’মানবসমাজে এ মেয়ে বের করার নয়!’
সোনালি নামটা বাবা মা কেউ রাখেনি। রেখেছিল পড়শি এক দাদু। হয়ত মজা করেই। কিন্তু ওই নামটাই শেষে ওর স্কুলের নাম হয়ে যায়।  অপয়া ছোট থেকেই ঘরের কাজকর্ম করে। মানে করতে হয়। এ মেয়ের কি বাইরে খেলতে যাওয়ার কথা! অপয়া ছোটতেই ওর জগৎটা জেনে নিয়েছে ঠিকঠাক। এর মধ্যে যা একটু বাঁচোয়া,অপয়ার বাবা মা ওর স্কুলে যাওয়া আটকায়নি।হয়ত আজকাল স্কুলে পড়তে পয়সাটয়সা তেমন লাগে না,বরং পাওয়া যায় ,সেজন্যই।
 কিন্তু ওইটুকুই। ওর জন্মের সময়কার সাংসারিক অবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হলেও ওর দোষ কখনও লঘু হয়নি। বাবা মা এক মুহূর্তের জন্য ভোলেওনি ওর জন্মানোর অপরাধ!  প্রাইভেট টিউশন তো দূরঅস্ত, প্রতিবছর পাশের খবরটুকু জানা ছাড়া মেয়ে স্কুলে কেমন  পড়ে,তার রেজাল্ট কেমন হয় কোনওদিন জানার চেষ্টা করেনি কেউ। বাবা না দেখেই বরাবর প্রগতিপত্রে সই দিয়ে গেছে। স্কুলটাও চার কিমি দূরে। অপয়ার সঙ্গে একই ক্লাসে এ গ্রামের কেউ পড়ে না,তাই সেখানকার ঢেউ অন্যভাবেও বাড়িতে আসেনি।
অপয়া জানত,স্কুলের সময়টুকুই ওর ছাড়। কেননা বাড়িতে পড়তে বসলেই তো মার ঝঙ্কার-‘মেয়ে দিগগজ হবে!’ এবং সঙ্গে সঙ্গে কোনও না কোনও একটা কাজের ফরমাশ। স্কুলের সময়টুকুকেই ও তাই কাজে লাগাত।
নামী স্কুল তো নয়। ফলে স্কুলে সবদিন ক্লাশ হত না। এছাড়া ছিল টিফিন পিরিয়ড। এই সময়গুলোয় অপয়া স্কুলের পিছনের ওর প্রিয় বকুল গাছটার তলায় চলে যেত। স্কুলের পড়াগুলো আর একবার পড়ে ঝালিয়ে নিত। এ নিয়েও অবশ্য কম হাঙ্গামা পোয়াতে হয়নি। বাবা জানত ওদের পাড়ার কুসুম ওর এক ক্লাশ নিচে পড়ে। কোনওদিন  কুসুমকে ফিরতে দেখে,যদি বাড়িতে এসে দেখত ও ফেরেনি,তাহলে ও ফিরতেই শুরু হত জেরা।
আবার কোনোদিন বাবা সন্দেহের বশে নিধিকে পাঠাত কুসুমদের বাড়ি,কুসুম ফিরেছে কিনা জানার জন্য। দিদি বিপদে পড়ুক এমন কিছু নিধির পক্ষে বলা অসম্ভব। বেমালুম মিথ্যে বলে নিধি দিদিকে বাঁচাত প্রায়ই।
ভাই যাতে দিদির কাছে বেশি না যায় তার জন্য দিনরাত ছেলেকে উপদেশ আর মেয়েকে শাসানি বাবা মা দুজনের তরফেই চলে। কিন্তু নিধি এসব কে পাত্তা দিলে তো! অপয়া এসব জানে। তবু আজ রেগে যায় ভাইয়ের উপর। মায়ের মিথ্যে তিরস্কারটা একেবারে বুকটাকে শূন্য করে দিয়েছে। নিধির দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলে-‘তুই আর কোনওদিন যদি আসিস দুধ নিয়ে,তাহলে আর কথাই বলব না তোর সঙ্গে,দেখিস?’ নিধির বয়স বারো। দিদির যেমন গার্লস স্কুল,ওর তেমনি বয়েজ। ক্লাস সিক্স ওর এখন। বাবা মার আচরণের প্রতিবাদ করার মত বড় না  হলেও একেবারে ছোট ও নয়। দিদির কষ্টটা ও বোঝে। তবু দিদির কথায় ও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। 
নিধিকে কড়া কথা বলে অপয়ারও মনটা অস্বস্তিতে পড়ে। ও কী করে ভুলবে,টেস্টের পরের দিনগুলোতে এই একরত্তি ভাইটার সাহায্যের কথা! ও না থাকলে তো সবাই ঘুমোবার পর ওর বেশিক্ষণ পড়াই হত না। কূপিতে যে টুকু তেল মা দিত তা তো  দু ঘন্টাতেই শেষ।ক্লাস ফাইভের কর্মশিক্ষায় শালিমার নারকেল তেলের  কৌটোতে তৈরি কলমদানিটা তখন আর কলম  রাখার কাজে লাগত না নিধির। ওটাতে নিজের হ্যারিকেন থেকে ও প্রতিদিনই তেল ঢেলে রাখত দিদির জন্য।
অপয়া নিধিকে  ইশারায় কাছে ডাকে। বলে-‘আয় দু’জনে মন  থেকে সব ঝেড়ে ফেলি।আজ আমাদের রেজাল্ট। আজ কি কিছু মনে রাখতে হয়!’
-‘দিদি তুই পাশ করবি তো? পাশ না করলে মা কিন্তু তোকে খুব মারবে। বাবাও ।’ নিধির গলায় ভয় খেলা করে।
অপয়া বলে-‘দেখা যাক কী হয় তবে রেজাল্টের জন্য মার খেতে মনে হয় হবে না।’
বেলা এগারোটার সময় একটা সরকারি গাড়ি এসে থামে অপয়াদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে আসেন এক সুদর্শন ভদ্রলোক।-‘সোনালি সর কে? ‘ শুধোন গম্ভীর মুখে।
মানুষটি আর কেউ নন। অপয়াদের ব্লকের বিডিয়ো।বিডিয়োকে অপয়ার বাবা আগে দেখেছেন, তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে দাঁড়ান কাঁচুমাচু হয়ে। ভিতর থেকে অপয়ার মার তীক্ষ্ণ কন্ঠ শোনা যায়।-‘এই মেয়ের জন্য আমাদের সব যাবে। নিশ্চয় কোনও অনর্থ ঘটিয়েছে স্কুলে।-এই  কিছু চুরিটুরি করিসনি তো ওখানে?’ উল্টোদিকে একটা চাপা স্বর শোনা যায়।-‘তিনমাস তো বাড়িতে। স্কুলে গেলাম কখন যে চুরি-‘
এদিকে অপয়ার বাবা রাগত কন্ঠে বলে ওঠেন–‘স্যার আপনি শুধু বলুন ওর অপরাধটা। তারপর ওকে কেমনভাবে পিটতে হয় দেখবেন!’
বিডিয়ো খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন অপয়ার বাবার দিকে। তারপর বলেন-‘আপনারা ওর সত্যিকারের বাবা মা তো?’
-‘কেন,কেন স্যার!’
-‘নিজের মেয়ে হলে,এত কম চেনার তো কথা নয়! জানেন ও কী করেছে? মাধ্যমিকে এবার রাজ্যে মেয়েদের মধ্যে প্রথম,আর সব মিলিয়ে তৃতীয় হয়েছে আপনার মেয়ে।’
বিডিয়োর কথা শুনে একেবারে গুম মেরে যায় অপয়ার বাবা।
টিভির দৌলতে বিডিয়ো সাহেবের বলা ঘটনাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্র হয়ে যায় চরচাকুন্দপুর গ্রামে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের লোক,স্কুলের শিক্ষিকারা  এসে ভিড় করে অপয়াদের বাড়ি।
বাড়িতে টিভি আছে। কিন্তু টিভি অপয়ার খোলা বারণ। তাই সকাল থেকে ও জানতেও পারেনি খবরটা। একটু পরে   কাগজের লোকেরা এসে যখন ওকে শুধোয়-‘টিভিতে প্রথম খবরটা পেয়ে কেমন লাগল’,তখন ও কেমন ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে থাকে।
অপয়া এমনিতে কথা বলতেও পারে না। কারণ ও তো কথা শুনতেই অভ্যস্ত। অপয়ার হয়ে সাংবাদিকদের সামলায় ওর স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাই।
সাংবাদিকেরা অপয়ার বাবা মাকে ওদের প্রতিক্রিয়া জানতে চায়। ওরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। এত বছরের লাঞ্ছনা গঞ্জনার অনুতাপ তো কম নয়!
অপয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বলেন-‘আমাদের স্কুল থেকে আগে কেউ স্টারই পায়নি। সোনালি আমাদের সোনার মেয়ে। কোন উচ্চতায় ও নিয়ে গেল আমাদের স্কুলকে ভাবতেই পারছি না। সত্যি বলছি,ও যে এরকম ফল করবে আমরা  কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। পরিবারের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। একটাও গৃহশিক্ষক ছিল না। বোধহয় বাড়িতেও খুব বেশি পড়ার সময় পেত না। কীভাবে পড়ত জানেন? আমাদের স্কুলের পিছনে একটা বকু্লগাছ আছে।ওই গাছের তলায় ও চলে যেত অফ পিরিয়ডে আর টিফিনে। ওখানে বসেই ও পড়ত । এ ঘটনা একদিনের নয়। ওর পুরো স্কুল জীবনের। ওর এই সাফল্যের পিছনে বিশ্বাস করুন কেউ নেই,ও ছাড়া। ওর কথা আপনারা লিখুন। লিখুন বড় করে।’
অপয়া এত আনন্দের মধ্যেও কেমন নিশ্চুপ। কিন্তু ফটো তোলার সময়ে ও আর নিশ্চুপ থাকতে পারে না। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে  বলে ওঠে-‘আমার ছবি তুলবেন না।’ সাংবাদিকেরা অবাক।-‘ছবি তুলতে দেবে না,এ কেমন কথা! জান তুমি কী অসাধ্য সাধন করেছ? কতজনের প্রেরণা তুমি!”
অপয়া মুখে হাতচাপা দিয়ে বলে-‘আমি যে অপয়া! আমার জন্মের দিন বাবার চাকরি যায়,তার কয়েকদিন পরে আমাদের জমির ধান কেটে নিয়ে যায় ডাকাতেরা,আমাদের নারকেল গাছে বাজ পড়ে,গরু মরে। আমার ছবি তুলবেন না। আমার ছবি যদি কেউ দেখে,হয়ত তার  কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে।’
 অপয়ার কথায় বিডিয়োর ভুরু কুঁচকে যায়। অপয়ার বাবা মার দিকে তাকান সন্দেহের চোখে । সাংবাদিকেরা অবাক। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি ওরা কোনওদিন হয়নি। কিন্তু এরপর চ্যানেলের লোকেরা এলে এমন অভিমান তো ছড়িয়ে যাবে রাজ্যময়! ব্যাপারটা ভালো হবে কি? ওদের  অনেক অনুরোধেও কিন্তু কাজ হয় না। কেবল চাপা হাতের তলায় চোখদুটো যে আজ বর্ষার নদী,তা টের পায় সকলে।
নিধি বিডিয়োর গাড়ি আসা থেকে এতক্ষণ সব্ কিছু নির্বাক বিষ্ময়ে দেখে যাচ্ছিল। এবারে যেন চমক ভাঙে  তার। এক লাফে অনেকটা বড়ও হয়ে যায় ছেলেটা।
দিদির কাছে এসে জোর করে ওর মুখ থেকে হাত সরাতে চেষ্টা করে। চাপা গলায় বলে-‘দিদি মুখ থেকে হাত সরা,ছবি তুলতে দে। আজ তোর দিন। আজ থেকে কেউ তোকে অপয়া বলবে না। আজ তোকে দেখে সবাই শিখবে,কীভাবে বাধা সরিয়ে এগোতে হয়।আজ থেকে তুই শুধু সোনালি,সোনার মেয়ে। আর আমি সেই সোনার মেয়ের ভাই-‘