Blog



ছোট ছোটগল্প
জন্মভূমি
রেণু,বেণু,কৃশানু। তিনজনের জন্যই জামাকাপড় কিনেছেন। দাদা,বৌদির জন্যও নিয়েছেন নতুন পোশাক।
কত বছর হবে? কুড়ি? না,সময়টা বোধহয় বাইশ। দেশে ফিরছেন বরদা সান্যাল।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বি টেক। তারপর এদেশের নানা জায়গা ঘুরে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়া থেকে ইংল্যান্ড। পিছন ফিরে দেখলে মনে হয়,সব এক লহমার ব্যাপার। অথচ দেখতে দেখতে এতগুলো বছর পার!
গ্রামের জন্য বিদেশে মনটা যে টনটন করত না তা নয়। কিন্তু কাজ বড় বালাই। আর তাছাড়া কাজ-পাগল মানুষ হিসাবে তিনি পরিচিতও হয়েছেন কর্মক্ষেত্রে।
কিন্তু সেদিন যে কী হল! ঘুমের মধ্যে দেখলেন গ্রামের রেললাইনের একদিকের খেলার মাঠটায় চুটিয়ে ফুটবল খেলছেন বলাই, বেল্লাল,সাঈদ সুখেনদের সঙ্গে।
ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু,ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে যে মাঠে খেলাটা নিয়ে স্বপ্ন,সে মাঠ তো ছোটবেলাতেই শেষ। সেবার গরমের ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়িয়ে গ্রামে ফিরেই অবাক। মাঠ চষা। ধান লাগিয়েছে রেলের লোকেরা।
সেদিন ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেটার সে কী কান্না! একরত্তি ছেলেটা সেদিন একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিল মনে মনে। আর কোনওদিন যাবে না ওই চষা মাঠের পাশ দিয়ে। তারপর সত্যিই যায়নি কোনওদিন। কেউ নিয়ে যেতেও পারেনি। চলাচলের পথ ছিল ভিন্ন। তাই অসুবিধেও হয়নি। পাছে ট্রেন থেকে চষা জমিটাকে দেখে ফেলেন এজন্য, গ্রাম থেকে যাওয়া বা গ্রামে আসার সময় ট্রেনে কোনওদিন ওদিকের জানলায়ও বসেননি।
কিন্তু আজ,এত বছর পরে স্বপ্নে সেই মাঠটাকে হুব হু আগের চেহারায় দেখে দেশের জন্য মনটা সত্যি কঁকিয়ে উঠল। ছুটির আবেদন জানিয়ে ফেললেন অফিসে।
বিদেশ থেকে দেশে ফেরা অত সহজ কর্ম নয়। প্রয়োজনীয় কাজ মিটতে অক্টোবর হয়ে গেল। বরদা ভাবলেন,ব্যাপারটা একরকম ভালোই হল। শীতের সময়টাতেই দেশে ফেরা যাবে।
দাদা-বৌদি আর ওদের তিন ছেলেমেয়ে ছাড়া বরদার নিজের বলতে কেউ নেই। বিদেশ থেকে যতটুকু পারেন ওদের সাহায্য করেন। কিন্তু, প্রয়োজনের তুলনায় তা যে অনেকটাই কম,গ্রামে ফিরে ওদের অবস্থা দেখেই সেটা মালুম হল।
জামাকাপড় সব দাদা-বৌদির হাতে দিয়ে একটা অস্বস্তির কাঁটা বুকে নিয়ে বসলেন ওদের বারান্দার চৌকিটায়। দাদা বললেন-‘তুই এত জিনিস কিনেছিস,কিন্তু আমরা তো-‘
-‘তোমরা আবার কী কিনবে?’ হা হা করে উঠলেন বরদা। বৌদি হেসে বললেন-‘তবে ভেবো না যে একেবারেই কিছু তোমাকে দেব না। কেবল উপহারটা আমাদের একার তরফ থেকে হবে না,এই যা!’
বৌদির কথাটা ঠিক বুঝতে পারলেন না বরদা।
বিকেলের দিকে কৃশানু এসে বলল-‘কাকা,শুধুই কি বাড়িতে বসে থাকবে,বাইরে যাবে না!-চলো তোমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’
-‘কোথায়?’
-‘চলোই না!’
বরদা বেরোলেন কৃশানুর সঙ্গে। কিন্তু কৃশানু সেই মাঠের রাস্তার দিকে যাচ্ছে দেখে বরদা দাঁড়িয়ে পড়লেন।-‘ও রাস্তায় তো আমি-‘
কৃশানু বলল-‘এত বছর পরে এখনও এত অভিমান ধরে রাখলে চলে!’
বরদা অবাক হয়ে তাকালেন কৃশানুর দিকে।
কৃশানু বলল-‘আমরা সব জানি। শুনেছি বাবার মুখে।’
বরদাকে নিয়ে কৃশানু প্রায় চলে এসেছে সেই মাঠের কাছাকাছি। বরদার মুখ অপ্রসন্ন। বেশ ছিলেন সেদিনের স্বপ্নটা নিয়ে। এখন আবার স্বপ্নটা খান খান হবে।
কিন্তু একী! বিষ্ময়ে চোখ বড় হয়ে গিয়েছে বরদার।
এদিকে ততক্ষণে কৃশানুর বয়সী এক দঙ্গল ছেলে ঘিরে ধরেছে ওকে।
কৃশানু বলে-‘অনেকদিনই আর কেউ ওখানে চাষ করত না। তোমার আসার খবর পেয়ে আমরা সবাই একজোট হয়ে ঠিক করি,যে মানুষটা আমাদের গ্রামের গর্ব,তাঁকে তাঁর ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া মাঠ আবার ফেরত দেব।-জানো কাকা,আমি সালমান,সুজন,আরিফরাই শুধু ঘাড়ে করে মাটি এনে এই মাঠ আবার তৈরি করিনি,ঘাড়ে করে এখানে মাটি ফেলেছে বাবাও।’
মানুষ জন্মভূমি ছেড়ে দূরে গিয়ে জন্মভূমিকে ভুলে যায়। অথচ এত ভালবাসা সেখানে জমা হয়ে থাকে!
বরদা টের পান,চোখের কোণে একটা জলের ফোঁটা ক্রমেই বড় হচ্ছে…