গল্পঃ নব পথের পাঁচালী
গল্প
নব পথের পাঁচালী
কে মরবে? অপু না দুর্গা? দুর্গা একবার মরেছে,তাই আবার দুর্গার মৃত্যু হোক আমি চাই না। তাহলে কি অপু? হেসে ফেলি নিজের অজ্ঞতায়। যাকে নিয়ে উপন্যাস,মারা যাবে সে-ই! নিজেকে ধমকাই রেলস্টেশনের বেঞ্চিতে বসে। মৃত্যু কেন? মৃত্যু ছাড়া কি হতে পারে না এই নতুন পথের পাঁচালী? হবে,নিশ্চয় হবে। দুর্গাকে মেরে বিভূতিবাবু আমাদের বড্ড কাঁদিয়েছেন! আমি দুর্গাকে বাঁচিয়ে, অন্যভাবে নির্মাণ করে পাঠকদের আনন্দ দিতে চাই।
রোজ বিকেলে চারটে হলেই বসি এই রেলস্টেশনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করি ওদের। প্রথম দিন থেকেই ওদের মনে হয়েছে অপু দুর্গা। ছোট্ট একটা ভাইয়ের ছোট্ট একটা দিদি,অপু দুর্গা ছাড়া আর কী-ই বা মনে হতে পারে? আর তাইতো,মেয়েটির নাম দূর্বা জেনেও ডাকি দুর্গা বলে। ছেলেটির নাম পুপু জেনেও ডাকি অপু বলে। নাম নিয়ে অহংকার ওদের পোষায় না। যে যা নামে ডাকে তাতেই সই। প্রথম প্রথম আমার ডাক শুনে অবাক হত। এখন আমার দেওয়া নামেই সাড়া দেয়। কাছে আসে। প্রশ্নের উত্তর দেয়।
ওদের ধামা ভরতি খইয়ের প্যাকেট। মা ভাজে খই। ভাইবোন মিলে খই থেকে ধানের কুটো ছাড়ায় বাড়ির দাওয়ায় বসে রাত্রে। তারপর তাতে বিট লবন মিশিয়ে দেয় মা। অবশেষে সবাই মিলে প্লাস্টিক প্যাকেটে পুরে আগুনে মুখ বন্ধ করে। কীভাবে কী হয়,এসব ফিরিস্তি দুর্গা যখন স্টেশনে লোক থাকে না,আর যখন ট্রেন চলে যাবার পর শুনশান হয়ে যায় পুরো চত্বর,তখন কোনও কোনও দিন আমাকে শোনায়। অপু তখন চুপটি করে বসে থাকে। এসময় ওর হাতে কখনও থাকে রাস্তা থেকে কুড়োনো রঙিন কাগজের একটা টুকরো। তা চোখে দিয়ে তাকায় আমার দিকে,ওর দিদির দিকে আবার কখনও সামনের দিকে। ওর চোখে বিষ্ময়,আনন্দ ঝিলিক দিয়ে যায়।
ট্রেন স্টেশনে আসবার কিছু আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় ওদের তৎপরতা। চৌদ্দ বছরের কিশোরী দুর্গা খইয়ের প্যাকেট হাতে নিয়ে হাঁকতে থাকে-‘খই পাঁচ টাকা,খই পাঁচ টাকা।’অপু হাঁক দেয় না। তবে যাত্রীদের প্রতি ওর নীরব দৃষ্টি আমার কাছে আহ্বানের মতই লাগে।
বিক্রি খারাপ হয় না। স্টেশনে বসে ওদের কার্যকলাপ দেখি আর মাঝে মাঝে আমিও কিনি দু একটা খইয়ের প্যাকেট।
বিক্রি শেষে বেশ একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। ছুটে ছুটে যাচ্ছে দুর্গা। পিছনে অপু। কী ব্যাপার? ব্যাপার স্পষ্ট হয় যখন দেখি খানিক দূর গিয়ে দুর্গা স্বেচ্ছায় অপুর হাতে ধরা দিয়ে ট্যাঁক থেকে বের করে দেয় কিছু পয়সা। অপু সেই পয়সা নিয়ে দৌড়ে যায় সামনের এক মিষ্টির দোকানে। কিনে আনে একটা চৌকো সন্দেশ। অর্ধেকটা নিজের মুখে পুরে বাকি অর্ধেকটা দিদির মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে।
মফসসল শহরের লাগোয়া এই স্টেশনটার গুরুত্ব তেমন নেই। মিটার গেজ লাইন। সারা দিনে দুটো ট্রেন দুদিক থেকে এর উপর দিয়ে যায় ও আসে। মজার ব্যাপার দুটো ট্রেনেরই সকালে বিকালে দেখা হয় এখানেই। প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছাড়া দেখা যায় কিছু গুডস ট্রেন। ওগুলো থেকে লবন সার কখনও সখনও নামতে দেখা যায় এই স্টেশনে।
-‘এইমাত্র দুবার খই বিক্রি। এতে চলে?’ জিজ্ঞেস করি দুর্গাকে।
দুর্গা বলে-‘তা কেন? মা-ও তো কাজ করে-সামনের একটা কাচ ফ্যাক্টরিতে।’
-‘বাবা নেই?’ শুধোই।
ছল ছল করে ওঠে দুর্গার চোখ। বলে-‘না।’
হরিহর নেই! একটু চিন্তায় পড়ি আমি। আসলে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ এতটাই এখনও বশ করে রেখেছে যে নতুন পথের পাঁচালীকে পুরোনোর পথ ধরেই ভাবি। সেখানে হরিহরের অনুপস্থিতি। মনকে প্রবোধ দিই,হরিহর নেই,কিন্তু আমি তো দুর্গাকে পেয়েছি। সুতরাং-
-‘অপুকে স্কুলে দিলি না?’ কথা ঘোরাই।
-‘পয়সা কোথায়?’ দুর্গা বলে।
আমি বলি-‘এখন তো পয়সা লাগে না। ওই তো সামনেই স্কুল,পাঠাতে পারিস না ভাইটাকে? তুই পড়িসনি,ভাইটাকেও কি মূর্খ করে রাখবি নাকি?’
দুর্গা বলে-‘আমাদের ঘরে কি লেখাপড়া হয়? আর কদিন বাদে মা ওকে লাগিয়ে দেবে চায়ের দোকানে।’
-‘চায়ের দোকানে!’রঙিন কাগজের টুকরো চোখে দিয়ে অপুর চারিদিকে তাকানো,বিষ্মিত হওয়া চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই অপুকে চায়ের দোকানে!
দুর্গা উদাস চোখে দূরের দিকে তাকিয়ে বলে-‘বসে বসে আর কতদিন খাবে?’
নিয়ম করে রোজ বিকেলে স্টেশনে বসি। দুর্গা আসে খই নিয়ে। অপুও আসে পিছুপিছু। অপুর নাকি এই মাসটাই শেষ। এর পরের মাস থেকেই চায়ের দোকান। কিন্তু এদের নিয়ে আমারও কিছু প্ল্যান মনে এসেছে। নতুন পথের পাঁচালী শুধু দেখব আর লিখব এতেই আমি দায়িত্ব শেষ করতে চাই না। নতুন পথের পাঁচালীর নতুনত্বে আমি নিজেরও কিছুটা ভূমিকা রাখতে চাই।
ঠিক করেছি,অপুর দায়িত্ব নেব আমিই। আর দুর্গা ও ওর মায়ের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ক্ষুদ্রশিল্প বা ওই জাতীয় কোনও কোঠায় একটা লোনের ব্যবস্থা করে দেব। ব্যবসাটা করছে যখন,করবে ভালো ভাবেই।
সেদিন ছিল শনিবার। দুই ট্রেনই লেট। আর অসম্ভব ভিড়ও স্টেশনে। ওদের এক ধামা খই নিমেষে হাওয়া। শীতকাল। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। দুর্গা অপুকে আমার কাছে বসিয়ে ছুটল আরও খই আনতে।
দু নম্বর লাইনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মালগাড়ি। মালগাড়ির দুটো বগির মাঝ দিয়ে ওকে উঠে পার হতে হবে। জায়গাটা অন্ধকার। আর কী দুর্দৈব,লোডশেডিংও হঠাৎ।
-‘সাবধানে পার হোস।’ দুর্গাকে বলি চেঁচিয়ে।
দুর্গা সাবধানেই পার হয়। কিন্তু ফেরে না। ফেরে না তো ফেরেই না। এদিকে ট্রেনের শব্দ ভেসে আসছে। অপুর মুখ চিন্তাকুল।
-‘আরে কী হল,তোর দিদি আসছে না কেন বল তো? বাড়িতে কিছু হল না তো!’ অবাক আমিও।
ঝিকঝিক শব্দ তুলে ট্রেন এল। দুদিক থেকেই। নামল অনেক যাত্রী। স্টেশনের প্যাসেঞ্জার নিয়ে দুই ট্রেন ছেড়েও দিল। দুর্গা এলো না। শুনশান হয়ে গেল স্টেশন। তবু দুর্গা এলো না।
-‘চল তোদের বাড়ি।’ অপুকে নিয়ে হাঁটা দিলাম ওদের বাড়ির দিকে। আমি আগে একবারই গিয়েছি। পথ তাই খুব ভালো চিনি না। অপুই চিনিয়ে নিয়ে গেল।
গিয়ে দেখলাম,রান্না চাপিয়েছে ওদের মা,সর্বজয়া। নিরুদ্বেগ মুখ।
-‘খই নিতে এসে দুর্গা আর স্টেশনে গেল না যে!’
আমার কথা শুনে সর্বজয়া অবাক।
এরপর খোঁজ খোঁজ। হ্যারিকেন নিয়ে,টর্চ নিয়ে।
রাত্রি নটা। দুর্গাকে পাওয়া গেল। পাওয়া গেল রেললাইন বরাবর উত্তরদিকে আধমাইল দূরে একটা আখের জমির পাশে। ছেঁড়া পোশাক। অজ্ঞান। কী হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হল না।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাড়াতাড়ি। চিকিৎসা হল। জ্ঞান ফিরল পরদিন। তাও স্পষ্টভাবে নয়। তার মধ্যেই জানাল জনা ছয়েক ছিল ওরা।
দুর্গা সেরে উঠল। থানা পুলিশ হল। আর তাতে যা হবার তাই হল। খবরের কাগজে লেখালেখির দৌলতে কয়েকদিন চলল ওদের জোর তৎপরতা। তারপর খবরের কাগজ থেকে খবর সরতেই সব চুপচাপ।
কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ।
পথ চিনে চিনে অপু এল এক সকালে আমার বাড়িতে। মুখ কালো।
-‘কী হয়েছে?’
-‘দিদি বিষ খেয়েছে।’ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অপু।
আমি স্তম্ভিত। বিষ খেল দুর্গা! কিন্তু কেন?
অগোছালোভাবে অপু যা বলল,তার মর্মার্থ, শুধু ধর্ষণেই সেদিন শেষ হয়ে যায়নি সব,ধর্ষণের চিহ্নও আজীবন বয়ে চলার বন্দোবস্ত করে গেছে পিশাচেরা। এই মাতৃত্বের লজ্জাতেই দুর্গা বেছে নিয়েছে ওরকম চরম পথ।
ছুটতে ছুটতে গেলাম অপুর সঙ্গে ওদের বাড়িতে। কয়েকজনের সাহায্যে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। কিন্তু ওকে বাঁচাতে পারলাম না। দুর্গা বাঁচল না।
অপু দুর্গা কেউ মরবে না,এভাবেই এগোচ্ছিল আমার নব পথের পাঁচালী দর্শন ও লিখন। অথচ দুর্গার সেই মৃত্যু হলই। বিভূতিবাবু দুর্গাকে বাঁচাতে পারেননি,এতদিন পরেও তাকে বাঁচানো গেল না। সেবারে ব্যাধিটা ছিল শারীরিক। আর এবারে? কী বলব ব্যাধিটাকে? সামাজিক? হয়ত তাই।
দুর্গার মৃত্যুর পরে বিভূতিবাবু এগিয়েছিলেন। কিন্তু আমি? গ্রীষ্মের এক ছুটির দুপুরে বেশ খর রৌদ্র। দাওয়ায় বসে নাড়াচাড়া করছি পান্ডুলিপির পাতাগুলো। হঠাৎ একটা হাওয়া দিল। সেই হাওয়ায় এলোমেলো উড়ে গেল কিছু পাতা।
যা বোঝার বুঝে গেলাম আমি। তাড়াতাড়ি সব পাতাগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে এসে ছিঁড়লাম কুটিকুটি। দাওয়ার নিচে ছিন্ন পান্ডুলিপি ফেলে ফস করে জ্বাললাম দেশলাই। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। পুড়তে লাগল নবপথের পাঁচালী। পুড়তে লাগল দুর্গা। পুড়তে লাগল আমাদের দেশকাল,আমাদের অগ্রগতি, উন্নতি,আমাদের আধুনিকতা…