Blog

গল্পঃ পদবি


গল্প
পদবি
বছর পঁচিশের লম্বা ছেলেটি বলল-‘আপনার রহস্য উপন্যাস ‘মেজবাবুর প্রত্যাবর্তন’ এবার ‘পাঁচকড়ি দে’ পুরস্কার পেয়েছে,এজন্য অভিনন্দন।’
মুখে হাসি টেনে অনিমেষ বলল-‘ধন্যবাদ।’
ছেলেটি বলল-‘আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই,আমাদের ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকার তরফ থেকে।
পুরস্কারটা পাবার পর থেকেই সাক্ষাৎকার নেবার ধুম পড়েছে। অনিমেষ তাই সম্ভাব্য প্রশ্ন ও উত্তর একটা কাগজে লিখে জেরক্স করিয়ে রেখেছে। ‘একটা লম্বা ছেলে দেখা করতে এসেছে’ ছেলের কাছে শুনে সেই জেরক্সের একটা কপি পাঞ্জাবির পকেটে নিয়েই দোতালা থেকে ও নেমেছিল। ‘কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই’ শুনে কপিটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করল অনিমেষ।
ছেলেটির হাতে দিয়েই বলল-‘এতেই সব লেখা আছে,যদি ছাপতে চান এটাই-’
ছেলেটি প্রশ্ন-উত্তর লেখা কাগজটির দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে বলল-‘এটা দিলেন,নিশ্চয়ই কাজে লাগবে আমাদের। কিন্তু এর বাইরেও আমার একটা প্রশ্ন ছিল,যদি শোনেন-’
অনিমেষের এটা লেখার সময়। তাই ‘একটা প্রশ্ন ছিল’ শুনে একটু বিরক্তই হল। তবু মুখে যথাসম্ভব হাসি রেখে বলল-‘বেশ তো করুন না!’
ছেলেটি বলল-‘আপনার সব কটা রহস্য উপন্যাসই আমি পড়েছি। আপনার একটা রহস্য উপন্যাস সমস্যা ও সমাধানের পদ্ধতির দিক দিয়ে এতটাই আলাদা যে লেখকের নাম এবং গোয়েন্দা শোভন পাত্রকে দেখে আমাদের চিনতে হয় এটা আপনার লেখা।’
অনিমেষ খুশি হল এক তরুণের কাছ থেকে এরকম প্রশংসা শুনে।
ছেলেটি বলল-‘তবে,লেখক ও গোয়েন্দা শোভন পাত্রকে না দেখেও মনোযোগী পাঠক কিন্তু আপনার উপন্যাসকে আপনার বলেই চিনতে পারবেন আর একটি বিশেষত্বে।’
অনিমেষ বলল-‘দেখুন প্লট,কাহিনি এসব বিভিন্ন উপন্যাসে বিভিন্নরকম হলেও লেখার বুনন,ভাষা এগুলো তো একজন লেখকের সবক্ষেত্রে প্রায় একই রকম হয়ে থাকে। ওসবগুলো দেখে মনোযোগী পাঠক তো বুঝতে পারবেই যে এটা কোন লেখকের লেখা।’
ছেলেটি একটু হেসে বলল-‘আমি ওসব সূক্ষ্ম বিচারপদ্ধতির কথা বলছি না। আপনার প্রতিটি লেখায় অন্য একটি স্থুল মিলও আছে। আমার বক্তব্য সেটা নিয়েই।’
-‘কীরকম?’প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও এখন ছেলেটিকে বেশ ভালই লাগছে অনিমেষের।
ছেলেটি বলল-‘আপনার প্রতিটি উপন্যাসে ‘প্রধান’ পদবিটা অ্যান্টি-সোশ্যালদের যে কোনও একজনের ক্ষেত্রে দেখা যায়ই। আপনার প্রথম উপন্যাস ‘নরবিলাসবাবুর উদ্যান’ থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘মেজবাবুর প্রত্যাবর্তন’ কোনও ক্ষেত্রেই এই নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি। আমার প্রশ্ন-কেন এরকম?’
অনিমেষ বেশ সপ্রশংস দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকাল। বলল-‘আপনি তো বেশ খুঁটিয়ে পড়েছেন আমার উপন্যাস-তা আপনার নামটা কী?’
ছেলেটি হেসে বলল-‘না না আমার পদবি ‘প্রধান’ নয় তা বলে। আমি-শ্রীকুমার সাধুখাঁ।’
অনিমেষ একটু লজ্জিত হল। ছেলেটির নাম জানতে চাওয়া যে ওর পদবিটা জানার জন্যই, এ ব্যাপারটা ও বুঝে ফেলেছে। থাক,আর বেশি সময় দেওয়া যাবে না ওকে,এই ভেবে অনিমেষ সরাসরি উত্তরে চলে এল। বলল-‘দেখুন সেভাবে কোনও কিছু ভেবে তো লেখা হয় না। কেউ তাঁর উপন্যাসে নায়ক-নায়িকার জন্য তিন অক্ষরের নাম রাখেন,কেউ দু’অক্ষরের। কেউ একটু প্রাচীন নাম,কেউ একটু আধুনিক নাম। ভিলেনদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেভাবেই ঘটে থাকে।’
-‘তাই বলে একই পদবি?’
-‘সেটাও ঘটতে পারে বইকি।‘
ছেলেটি বলল-‘এই ঘটার পিছনে ভাল লাগা,মন্দ লাগার ব্যাপারটা তো তাহলে মেনেই নিচ্ছেন। তা আমি কি ধরে বেব ‘প্রধান’ পদবিটা আপনার কাছে বেশ অপছন্দের?’
-‘না,তা কেন? বললামই তো ব্যাপারটা অত সিরিয়াসলি ঘটে না। আমার তো অনেক বন্ধু আছে,যাদের পদবি ‘প্রধান’।’
-‘তাহলে কি ‘প্রধান’ পদবির কোনও লোকের দ্বারা আপনি জীবনে কোনো সময় ক্ষতিগ্রস্ত অথবা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন?’
অনিমেষ এক মিনিট স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দিল। তারপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল-‘সূর্যকিশোর প্রধান আপনার কেউ হয়?’
বছর পঁচিশের শ্রীকুমার সাধুখাঁ উঠে দাঁড়াল। বলল-‘অনুমান যখন খানিকটা করেইছেন,তখন পরিচয়টা দিয়েই ফেলি। সূর্যকিশোর প্রধান আমার দাদু। তবে ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকার পক্ষ থেকে আসার ব্যাপারটাও মিথ্যে নয়।’
অনিমেষ বলল-‘আসল পরিচয়টা এতক্ষণ গোপন রেখে ভাল করেননি। সূর্যকিশোর প্রধান আপনার দাদু বললে কি আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিতাম?
শ্রীকুমার বলল-‘বলা যায় না।পুরনো রাগ যেভাবে আপনি এখনও আপনার লেখায় ফুটিয়ে তুলছেন,তাতে পরিচয় দিলে ভাল ব্যবহার পাব এটা আশা করি কীভাবে?’
অনিমেষ বলল-‘সেই কবে উনি এক জুটমিলের ওয়ার্কস ম্যানেজার থাকার সময় ঈর্ষাবশত মিলের পার্সোনাল অফিসারকে ওয়ার্কার দিয়ে পিটিয়েছিলেন,সেসব কি আমার এখনও মনে আছে? তবু কেন জানি না,ভিলেনদের একজন না একজনের পদবি ঠিক ‘প্রধান’ হয়েই যায়।’
-‘পুরোনো সব ঘটনা যদি ভুলেই থাকেন তবে এখন থেকে ওই পদবিটা ভিলেনদের ক্ষেত্রে প্লিজ আর ব্যবহার করবেন না। জানেন,দাদু ভাবেন আপনি ‘প্রধান’পদবিটা ভিলেনদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন দাদুকে শাস্তি দিতেই। আর কটা দিনইবা বাঁচবেন দাদু?আপনার উপর অবিচার করছেন সেজন্য তো এখনও অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছেন। আপনার উপন্যাস বেরোলেই উনি কিনে পড়েন এই আশায় যে,এবার হয়ত আপনি ওঁকে ক্ষমা করেছেন।’ করুণ হয়ে আসে শ্রীকুমারের গলা।
অনিমেষ একটু চুপ করে থেকে বলে-‘আপনার অনুরোধ আমার মনে থাকল।’
সেদিন অনিমেষ দু’বার ফোন করল ওঁর প্রকাশককে। একবার,শ্রীকুমার যাবার পর সকাল দশটায়। আর একবার বিকেল চারটেয়।
দশটায় প্রকাশককে বলল-‘নতুব উপন্যাস ‘কীর্তিসিংহের কীর্তিনাশ’ পড়লেন? কেমন লাগল? ছাপার কাজ কবে শুরু করবেন? একটা সংশোধনী। বত্রিশ কি তেত্রিশ পাতায় ঠিক মনে পড়ছে না,শেষ প্যারায় ‘সাগরেদ হেলু প্রধান ঝাঁপিয়ে পড়ল’এরকম একটা বাক্য আছে। ওখানে ‘সাগরেদ হেলু প্রধান’ থেকে ‘প্রধান’টা কেটে দিন।’
দ্বিতীয়বার,চারটের ফোনে বলল-‘ভিতরে কাটাকাটি থাক। গদ্যেরও তো একটা ছন্দ আছে। ‘হেলু প্রধান’ এর জায়গায় ‘হেলু’ লিখলে পরের শব্দটা কেমন দূরদূর মনে হবে,খাপছাড়া শোনাবে। আপনি বরং উৎসর্গের জায়গাটাতে ‘অবনী সোম’ কেটে ‘সূর্যকিশোর প্রধান’ করে নিন।’