গল্পঃ ভদ্র অভদ্র,Bhodro Abhodro

গল্প
 

Ami Mishuk | আমি মিশুক গল্পঃ ভদ্র অভদ্র,Bhodro Abhodro














গল্প

ভদ্র অভদ্র  

ভদ্র হবার অনেক জ্বালা। রাগ হলেও খারাপ কথা বলা যায় না। সারাদিনে ক্রমাগত রাগ গিলে যেতে হয়। তারপর রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুধু ছটফট আর ছটফট।

সত্যি কী ভাবে এরা! সব প্রশ্নই করা যায়! সব থেকে পাজি ঐ গরুর ডাক্তারটা। কবে রিটায়ার করেছে , এখনও মরার নাম নেই। বিকেল হলেই হাঁটার নাম করে স্টেশন। কিন্তু হাঁটা তো গৌণ , চেনা অচেনা একটা লোক ও পাশ দিয়ে যাবার উপায় নেই। কৌতূহলী দৃষ্টি একেবারে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। অনেক সময় অচেনা লোক নিজের থেকেই নাম ধাম গন্তব্য বলে চলে যায়।

কানাই যেহেতু মাসে বেশ কয়েকবার বাড়ি আসে। আর ফেরে এই সন্ধের ট্রেনে , তাই এই হাঁটুরেদের পাল্লায় ওকে পড়তেই হয়। পিছন ঘুরে স্টেশনের রেলিং ধরেও দেখেছে। অন্যরা না হলেও গরুর ডাক্তার ঠিক চিনে ফেলে। আর সেই একই প্রশ্ন। কখন এসেছিলি , এত তাড়াতাড়ি ফিরছিস যে , বৌমা এল না ইত্যাদি। ট্রেন যদি কোনও কারণে লেট থাকে তবে আর দেখতে হবে না। এমন সব প্রশ্ন করবে যার উত্তর দেওয়াও যায় না, আবার না দিলেই সেই অভদ্রতা।

সেদিন তো চারজনই ওকে বেড় দিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

-‘কোথায় ফ্ল্যাট যেন তোর?’ প্রথমেই গোষ্ঠ পালের চুরাশি কি পঁচাশি বারের রিপিট করা প্রশ্ন। তবু জবাব দিতেই হবে,কারণ কানাই ভদ্র। 

এবার গরুর ডাক্তারের মোক্ষম জায়গায় ঘা। – ‘ ছেলেপুলে কটা?’ এটাও কম করে বার পঁচিশেক হল। বরাবর যেমন বলে সেদিনও সেই কথাই বলেছিল কানাই।

-‘ ডাক্তার দেখাস নি?’ সেই একই পালটা প্রশ্ন বলাই মন্ডলের।

এরপরে গরুর ডাক্তারের একেবারে নতুন সিলেবাস বহির্ভূত প্রশ্ন। -‘কার দোষ? তোর না বউয়ের?’

এ প্রশ্নে কানাই ঘামতে শুরু করে। ওর মনে হয় , মুখের উপর বলে দেয়– ‘সেটা আপনাকে বলব কেন ?’ পরে দেখে ব্যাপারটা অভদ্রতা হয়ে যাবে। একটু চুপ করে থেকে বলে – ‘ ও অনেক জটিল ব্যাপার, বোঝানো যাবে না।’ 

বোঝানো যাবে না, এমন জটিল ব্যাপার ওদের কাছে হয় নাকি? বিশেষ করে ছেলেপুলে না হলে কারও একজনের দোষ তো থাকবেই। অনেক কথায় উঠতে পারত, জটিল ব্যাপারের সূত্রে। কিন্তু ট্রেনটা সেদিন বাঁচিয়ে দেয়। স্টেশনের আগে পুলটার উপর এসে জোরে হর্ণ দেয় এসময়। সেই হর্ণ শুনে হাঁটুরে  চার বুড়ো ওকে ছেড়ে পিছিয়ে যায় বসার জায়গাটার দিকে।

আজ আবার ওদের খপ্পরে বেশ ভালো রকমই পড়তে হবে। কারণ কানাই স্টেশনে পা দিয়েই শোনে , ট্রেন একঘন্টা লেট।গ্রামের স্টেশন তত উন্নত তো নয়।আড়াল আবডালও কম যে কোথাও সটকে যাবে।এই হাঁটুরে চার বুড়োর সঙ্গে এমনিতে ভদ্র ব্যবহার ও না করলেও পারে। কেউই কোনওদিন শুভানুধ্যায়ী ছিল না ওর, ওদের।

গোষ্ঠ পালের কথাই ধরা যাক। কাজকর্ম কোনও দিনই ছিল না। কিছু জমি জায়গার উপর ভর করে দিন গুজরান হত। মোটামুটি অভাবেরই সংসার। অথচ কীভাবে সংসারের হাল ফেরানো যাবে সেদিকে চিন্তা নেই। শুধু একটাই চিন্তা লোকের পিছনে কীভাবে কাঠি করা যায়। বাবা রিটায়ারমেন্টের আগে কানে প্রায় কিছুই শুনতে পেত না। প্রাইমারি শিক্ষক। সে সময় বাবার এক্সটেনশন পিরিয়ড চলছে।   এক্সটেনশন পিরিয়ডে শারীরিক সুস্থতা চাকরি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তখন বড় ফ্যাক্টর। এর উপর ছিল  বাবার কানের সমস্যা জানিয়ে ওই গোষ্ঠ পালের ডি আই অফিসে মাঝে মাঝেই পত্রাঘাত। একবার এনকোয়ারিও হয়। বাবা কোত্থেকে  কানের যন্ত্র এনে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে।

কানাইয়ের সঙ্গেও গোষ্ঠ পালের খারাপ আচরণের কম রেকর্ড নেই। একবার তো বিনা কারণে বাবাকে দিয়ে মারও খাইয়েছিল।শশাটা সেদিন সত্যিই ও কুড়িয়ে পেয়েছিল ওর শশার জমির অনেকটা দূরে। হতে পারে কেউ বেশ কটা শশা ছিঁড়ে চম্পট দেবার সময় তার অজান্তে ওটা বেড়ার ধারে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আড়াল থেকে কানাইকে শশা কুড়োতে দেখে গোষ্ঠ পালের দৃঢ় ধারণা, ওটা কুড়োনো নয় জমি থেকে চুরি। এরপর শুরু হয় গোষ্ঠ পালের পাড়া তোলপাড়। ভদ্রঘরের ছেলে শেষে শশা চোর! বাবার কাছেও আসে গোষ্ঠ পালের নালিশ। এরপর নাইনে পড়া কানাই ব্যাপক মার খায় বাবার কাছে।

বলাই মন্ডল ছিল রেশন ডিলার। কানাই তখন ওর দোকান থেকেই বাড়ির রেশন আনত। একদিনও বলাই মন্ডলের কাছ থেকে ও সুবাক্য শোনেনি। ওদের একটা রেশন কার্ডে নামের জায়গাটা জলে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এজন্য ভিড় বেশি থাকলে ‘ পরে আসবি যা’ বলে ওকে ঘুরিয়েও দিত বলাই মন্ডল।

আর রবিন হালসানাকে দেখলে তো মনে হবে , দুনিয়ার কোনও ব্যাপারেই ওর আগ্রহ নেই। বাস্তবে ব্যাপারটা কিন্তু একেবারে উলটো। খুব তুচ্ছ ব্যাপারেও ওর প্রচন্ড আগ্রহ। নাহলে ক্লাস নাইনে পড়া কানাইকে কবে কোথায় পন্ডিতমশাই বলেছিল–‘ তোর কেবল মু্খস্থ বিদ্যা’, সেটা রবিন হালসানার কানে   একদা ঢুকল তো ঢুকলই আর বেরোল না! এখন ওগুলোর আর তেমন মূল্য নেই , কিন্তু গড়ে ওঠার সেই সময়টাতে কেউ যদি বারবার পন্ডিত মশাই এর বলা কথাটা ইনিয়ে বিনিয়ে কানের পাশে দেখা হলেই বলে যেতে থাকে আর চেতাবনি দেয়– ‘ মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে পাশ করা যায়, ভাল রেজাল্ট করা যায় না’ , তবে ভেঙে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। মাধ্যমিকে ইস্কুলে সবচেয়ে ভাল করলে কানাই ভেবেছিল অবস্থাটা পাল্টাবে কিন্তু মানুষটা রবিন হালসানা। কানাইকে দেখে বলেছিল – ‘তুই দেখিয়ে দিলি, মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে কতদূর যাওয়া যায়!’

গরুর ডাক্তারের আসল নাম রুপেন সামন্ত। কিন্তু সবার কাছে উনি পরিচিত ‘হিউয়েন সাঙ’ নামে। এক নজর দেখলেই কিন্তু বোঝা যায় , কেন এমন নাম। ছোট্টখাট্ট চেহারার মানুষটা দেখতে কিন্তু সত্যিই ইতিহাস বইয়ের হিউয়েন সাঙ। কে যে এমন নামটা রুপেন সামন্তকে দিয়েছিল! একেবারে মার্ভেলাস তার অবলোকন। রুপেন সামন্ত অবশ্য এসব নাম টাম নিয়ে তেমন ভাবিত ছিলেন না। লোকের খুঁত বের করতেই ওঁর দিন চলে যেত। কানাইকে তো ও প্রায় জেরবার করে দিয়েছিল একবার। কানাই তখন ইলেভেন। মেয়েদের থেকে কানাই বরাবরই একটু দূরে দূরে থাকা পছন্দ করে। তবু সরিতা যখন ওর কাছে কোনও নোট ফোট চাইত , কানাই না করতে পারত না। কানাই সায়েন্স। সরিতা আর্টস। নোট দেওয়া বলতে ইংরেজি আর বাংলা। সেবার ওকে বাংলার একটা নোট দিয়ে কানাই বেশ ফেঁসে গিয়েছিল।  সরিতার মামস হয়েছিল। আসে না তো আসেই না। এদিকে পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। কানাই নোটটা আনতে ওদের বাড়ি গিয়েছিল। বাড়ি মানে পোস্ট অফিসের কোয়ার্টার। ওর বাবা ছিলেন পোস্ট অফিসের ক্লার্ক। সেদিন নোটটা নিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে হিউয়েন সাঙের খপ্পরে পড়ে গেল। হিউয়েন সাঙের গরুর ডাক্তারি পোস্ট অফিস লাগোয়া জমিতে। হিউয়েন সাঙ একটা গরুকে ইঞ্জেকশন দিয়ে তাকিয়েছিল গরুটার দিকে, এমন সময় কানাই ওখানে। মানে পাশ দিয়ে রাস্তা, ফিরছিল আর কি!

-‘হাতে খাতা,কোথায় গিয়েছিলি?’ হিউয়েন সাঙ তেরছা তাকায় ওর দিকে।

-‘সরিতার কাছে। একটা নোট ছিল আনতে।’ কানাই জবাব দেয়।

-‘এই বয়সে একটা মেয়ের সঙ্গে নোটের আদান প্রদান,ব্যাপারটা খুব সুবিধার মনে হচ্ছে না। তা নোটটা কীসের ?’

-‘বাংলার।’

-‘আমিও সেটাই সন্দেহ করেছিলাম। কারণ তুই তো সায়েন্স। পোস্ট মাস্টারের মেয়েটা তো আর্টস নিয়েছে।নোটের বিষয়টা কী শুনি!’

কানাই বলতেই পারত-‘আপনাকে বলব কেন?’ কিন্তু কানাই তখন থেকেই ভদ্র , তাই বলেই দিল- ‘বৈষ্ণব পদাবলী।’

আর যায় কোথা! হো হো করে হেসে উঠে হিউয়েন সাঙ বলল- ‘বৈষ্ণব পদাবলী আদান প্রদান হচ্ছে! তা তোমাদের পদাবলী কতদূর?’

-‘মানে?’

-‘মানে! গিয়েছিস তো অনেকক্ষণ। ভাবছিস দেখিনি? একটা নোট আনতে কতক্ষণ লাগে?’ 

কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়।সরিতার সঙ্গে ইংরাজির একটা প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছে। হিউয়েন সাঙের কথায় একটু থতমত খেয়ে যায় কানাই। তবু বলার চেষ্টা করে সত্যিটা। কিন্তু হিউয়েন সাঙ তা শুনলে তো? – ‘আর সাফাই গাইতে হবে না, ইলেভেনে উঠেই ডানা গজিয়েছে। প্রেম করতে শিখে গিয়েছ, তোর বাবাকে বলছি দাঁড়া!’ একেবারে কাঁদিয়ে দিয়েছিল কানাইকে।

হিউয়েন সাঙ সেদিন সন্ধেতে ওদের বাড়ি বইয়ে এসে নামিয়ে গিয়েছিল মিথ্যে অভিযোগের ঝুড়ি। কানাই এর সৌভাগ্য, বাড়ির কেউ এই অভিযোগের এক বর্ণও বিশ্বাস করেনি। তবে কানাই কিন্তু এই অভিযোগে একেবারে খান খান হয়ে গিয়েছিল। সরিতার সঙ্গে আর কথা বলার সাহসটুকুও সঞ্চয় করতে পারেনি।

দূর থেকে কানাই দেখল, কেন কেজানে আজ সেই হিউয়েন সাঙকে নিয়েই বাদবাকীরা ব্যস্ত। বাইরের দিকে তেমন ওদের নজর নেই। কানাই ওদের ভয়ে রেলিং-এ একেবারে লেপটে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এবার একটু হাত পা ছাড়িয়ে পায়চারি করা শুরু করে। পায়চারি করতে করতে একবার প্রায় ওদের পাশ দিয়েও চলে যায়। আশ্চর্য ,তবু কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। নীচু স্বরে হিউয়েন সাঙ কী বলছে, বাকিরা মন দিয়ে শুনছে। কানাই ভাবে হিউয়েন সাঙের বাড়িতে নিশ্চিত কিছু হয়েছে। 

একটু কৌতুহলী হয় কানাই। এতদিনে যতই উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে হিউয়েন সাঙ ওকে জেরবার করুক কানাই তো ভদ্র। এ অবস্থায় কিছু জিজ্ঞেস না করাটা অসৌজন্য।

-‘কেমন আছেন আপনারা?’ কাছে গিয়ে কানাই শুধোয়।

সবাই চুপ।

-‘কিছু কি হয়েছে?’

হিউয়েন সাঙ কানাইয়ের দিকে তাকায়। কানাই দেখে চোখের কোনে জল। হিউয়েন সাঙ ধীরে ধীরে বলে – ‘ তোমরা এখন সংসারের চালক। আমরা বাতিলের দলে। আমাদের দিয়ে আর কী হবে? তবু কানাই আর যাই হোক বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলোনা কক্ষনো।’

কানাইয়ের কিছু বুঝতে বাকি থাকে না ।

বলাই মন্ডল বলে– ‘ চয়ন তোমার নস্যির ডিবেটা ফেলে দিল, তার মানে তো নস্যিও নিতে পারনি সারাদিন। তোমার এতদিনের নেশা। আছ কেমন করে?’

-‘আর নেশা!’  হিউয়েন সাঙ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

ট্রেনের এখনও দেরি আছে। দ্রুত প্ল্যাটফর্ম থেকে নিচে নেমে যায় কানাই। ওখানে একটা মনোহারি দোকান নতুন খুলেছে। দোকানটা থেকে একটা নস্যির ডিবে কিনে আবার ফিরে আসে ওদের কাছে।

-‘এই নিন! নাকে দিন একটু।’ হিউয়েন সাঙের দিকে নস্যির ডিবেটা বাড়িয়ে দেয় কানাই।

হিউয়েন সাঙ এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তবু নেশা বলে কথা। কুন্ঠার সঙ্গে হলেও নস্যির ডিবেটা নেয়। ট্রেন আসে ঝমঝম করে। কানাই উঠে বসে।

নস্যির ডিবে কিনে দেওয়াটা কি ঠিক হল? ট্রেনে উঠে মনটা খচখচ করে কানাইয়ের। কানাই কখনও অভদ্র হয়নি। অথচ আজ …. ! করুণার চেয়ে অভদ্রতা আর কী হতে পারে!