Blog

গল্পঃ সাহিত্য/ সাহিত্যিক

ছবির রবীন্দ্রনাথ
chobir rabindranath
পরমাণুবাদের জনক জন ডালটনের নাম আমরা সবাই জানি। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও ডালটন দিয়ে একটি শব্দ আছে। ডালটনিজম। এটিরও মূলে ওই বিজ্ঞানীই। ডালটনিজম কিন্তু একটা রোগ। সাদা বাংলায় এর নাম লালকানা। অর্থাৎ লাল রং না দেখতে পারার রোগ।
কেন এমন নাম? আঠারো-উনিশ শতকের বিজ্ঞানী জন ডালটন নাকি ছিলেন প্রবলভাবে লালকানা। শোনা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে তিনি সকলের রক্তবর্ণ গাউন পোশাকটিকে দেখেছিলেন বটল-গ্রিন বা বোতল-সবুজ। তাঁর নাম থেকেই রোগটির অমন নাম হয়ে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর আরও একটা নাম আছে। প্রোটানপ। প্রোটানপ-আক্রান্ত রোগীকে বলা হয় প্রোটানপিক।
বিষয়,ছবির রবীন্দ্রনাথ। তবু বর্ণান্ধতা-সংক্রান্ত একটি রোগ নিয়ে দু চার কথা বলা কিন্তু একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ জন ডালটনের মত রবীন্দ্রনাথও ছিলেন প্রোটানপিক। ছবির রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আলোচনায় এটির অবতারণা জরুরীও। আসলে যে মানুষটি প্রায় সত্তর বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু করে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন,তাঁর দুর্বলতার জায়গাটা বলে নিলে ,তাঁর মহিমার দিকটা আরও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।
নির্মলকুমারী মহলানবিশ,রানী চন্দ,স্টেলা ক্রামরিশ,রোমা র্যোঁলা কবির এই লাল-সংবেদনহীনতা নিয়ে অনেককথা লিখে গেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ নিজে তো এ ব্যাপারে বলেইছেন। তাঁর নিজের কথায়, তিনি ‘সুবিখ্যাত লালকানা’।
আশ্চর্যের কথা, যে রং নিয়ে কবির চেতনায় এমন অসম্পূর্ণতা, সেই রঙের ব্যবহার তাঁর ছবিতে দুর্লক্ষ্য নয়। আর তাছাড়া সামগ্রিকভাবে রঙের এই অসম্পূর্ণতা নিয়েও তিনি যে তাঁর ছবিতে প্রবল প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছিলেন তার অনেকটা অবদান কিন্তু তাঁর রঙের ব্যবহারের কারণেই।
১৯৩০ এ প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়। এই প্রদর্শনী থেকেই পাশ্চাত্ত্যে ছবির রবীন্দ্রনাথের জয়যাত্রা শুরু । তাঁর ছবি দেখে পশ্চিমের কলা সমালোচকেরা বলেছিলেন,ছবিতে যে জিনিসটির তাঁরা অন্বেষণ করে চলেছিলেন,সেটি তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন টেগোরের ছবিতে।
এ দেশে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার ব্যাপারটিতে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কেউ কেউ ‘শেষ বয়সের বিলাসিতা’ বলে কটাক্ষও করেছেন। কিন্তু ছবি আঁকা রবীন্দ্রনাথের কাছে বিলাসিতা ছিল না,ছিল প্রাণের আরাম। তাছাড়া সাহিত্যে তিনি যা পারেননি,ছবিতে তা-ই তিনি করে দেখিয়েছেন।
সাধারণভাবে সাহিত্যে তিনি প্রবলভাবে বাঙালি,কিন্তু ছবিতে তিনি আন্তর্জাতিক। সাহিত্যে তিনি ‘মাধুর্যহীন রুক্ষতা’ কে প্রশ্রয় দেননি। কিন্তু ছবিতে সেটাই হয়ে উঠেছে তাঁর আশ্রয়। সমকালের সংকট,দ্বন্দ্ব,তাঁর ক্ষোভ,হতাশা রেখার টানে রঙের ব্যবহারে বারেবারেই ফুটে উঠেছে বীভৎসতায়,রুক্ষতায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে যাত্রা করেছেন সীমা থেকে অসীমে। ছবিতে তাঁর যাত্রা উল্টো দিক থেকে। অসীম থেকে সীমায়। যেজন্য তিনি কাটাকুটির ভিতর থেকে আকার বা ফর্ম বের করতে চেয়েছেন।
কিন্তু ভারতীয় ছবিতে তিনি কোনদিক থেকে আধুনিক? তাঁর আগে পর্যন্ত ভারতীয় ছবিতে একটা গল্প বলা হত। রবীন্দ্রনাথ এই প্রথা ভেঙে দেখালেন,ছবি কোনও গল্প বলে না। এই কারণে ছবিকে নাম দিয়ে নির্দিষ্ট করারও পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি।
সত্তর বছর বয়সে শুরু করে এঁকেছেন কমবেশি আড়াই হাজার ছবি। তাঁর সারাজীবন ধরে রচিত গানের সংখ্যার প্রায় সমানই বলা চলে। যে সময় থেকে এই বন্যার বেগে ছবি আঁকা,সেসময় তাঁর রচিত সাহিত্যেও কিন্তু এর ছাপ স্পষ্ট। তাঁর আগের লেখায় অনেকসময়েই এসেছে অতিকথন,পুনরাবৃত্তি। কিন্তু ছবি আঁকার কালে তাঁর লেখা ছবির মতোই মেদহীন।
সরাসরি তাঁর রঙের সংবেদন অসংবেদনও এসেছে লেখায়। উদাহরণ হিসাবে,’শামলী’র ‘আমি’ কবিতার কথা বলা যায়। তিনি যখন এই কবিতায় তাঁর চেতনার রঙে পান্নার সবুজ হওয়া আর চুনির রাঙা হয়ে ওঠার কথা বলেন,তখন এই ঘোষণা কিন্তু প্রোটানপিক কবির সত্যিকারের চেতনারই রূপ হয়ে ওঠে। অনেক সমালোচক সেকারণে তাঁর ‘রাঙা’কে নঞর্থকতার প্রতীক হিসাবেও দেখেছেন।