গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক (সিনেমা ও বিভূতিভূষণ)

গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক

সিনেমা ও বিভূতিভূষণ

যে চলচ্চিত্র শিল্পমাধ্যমটি বিভূতিভূষণের বেশ কিছু অমর সৃষ্টির সঙ্গে সারা বিশ্বের পরিচিতি ঘটায়, সেই শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে বিভূতিভূষণের যোগ কতটুকু?

শুনলে অবাক লাগবে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে বিভূতিভূষণের যোগ এদেশে চলচ্চিত্রের শুরুর সময়টাতেও ছিল  অত্যন্ত নিবিড়। দেশি বিদেশি দুই ধরণের চলচ্চিত্রেরই রীতিমত ভক্ত ছিলেন তিনি।

বিভূতিভূষণের দিনলিপির পাতা ওল্টালে দেখা যাবে কলকাতার মেসজীবনে তাঁর যাতায়াত শুধু ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি, বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা,আর ‘বঙ্গশ্রী’র অফিসে সীমাবদ্ধ ছিল না। রীতিমত যাতায়াত ছিল থিয়েটার  সিনেমাতেও।

থিয়েটার সিনেমার মধ্যে পছন্দ বেশি করতেন সিনেমাই। তাঁর দিনলিপিতে উঁকি দিলে দেখা যাবে,কখনও নীরদবাবুর (নীরদ সি চৌধুরী) সঙ্গে তিনি রূপবাণীতে ইংরেজি সিনেমা দেখছেন,কখনও রাত্রিতে বঙ্গশ্রীর  অফিস থেকে ফেরার পথে film দেখতে ঢুকছেন Madan Theatreএ। আবার কখনও স্কুল ফেরতা ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে যাচ্ছেন ‘Abraham Lincon’ দেখতে।

শুধু কি দেখা? গতশতকের তিনের দশকে একটি চলচ্চিত্র সাপ্তাহিকের তিনি সম্পাদকও হয়েছিলেন। ‘চিত্রা’   চলচ্চিত্রগৃহ প্রতিষ্ঠা হলে তার মালিক বীরেন্দ্রনাথ সরকার এবং সে সময়ের প্রবাসী সম্পাদক কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ের যৌথ উদ্যোগে বের হয়েছিল এই চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক। পত্রিকার নাম ছিল, ‘চিত্রলেখা’। ‘চিত্রলেখা’র প্রথম সংখ্যা বের হয়েছিল ১৯৩০ সালের ১৫ নভেম্বর।

এই পত্রিকার প্রচ্ছদকাহিনি করা হত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র পরিচালক,চিত্রাভিনেতা বা  চিত্রাভিনেত্রীদের নিয়ে। দেশের ও বিদেশের ছবির বিস্তারিত খবর থাকত ‘চিত্রলেখা’য়।

এই চলচ্চিত্র সাপ্তাহিকের সম্পাদক হিসাবে বিভূতিভুষণকে নির্বাচিত করা হয়েছিল আকষ্মিকভাবেই। কাগজ তৈরির প্রারম্ভিক পর্যায়ে কথা হয়েছিল,প্রবাসী প্রেস সংক্রান্ত কারও সম্পাদক হওয়া চলবে না। এই সময় কাকে সম্পাদক করা যায় এ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। বিভূতিভূষণ তখন প্রবাসীর লেখক। চলচ্চিত্রে অনুরাগী বিভূতিভূষণকেই দশ টাকা বেতনে নির্বাচিত করা হল সম্পাদক হিসাবে।

বিভূতিভূষণ এই পত্রিকার রথাগ্রে থাকলেও,সব কাজ করতেন অবশ্য সজনীকান্ত দাস। তবে একেবারে নিষ্ক্রিয় সম্পাদক ছিলেন না বিভূতিভূষণ। চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকার সম্পাদক তিনি হয়েছিলেন, অনেকটা এই শিল্পের সম্পর্কে হৃদয়ের এক চোরাটান থেকেই। আর সেই টানেই তিনি এখানে লিখেছেন চলচ্চিত্র বিষয়ে প্রবন্ধও। এতে পরিচয় পাওয়া যায় তিনি চলচ্চিত্রের কতটা সচেতন সমঝদার ছিলেন।

‘চিত্রলেখা’র আঠারোটা সংখ্যা বের হয়েছিল। তারপর আর্থিক কারণে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।

চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকার সঙ্গে সম্পাদক হিসাবে যুক্ত থাকার সময়ে নিজের বই সিনেমা হোক,এমন কল্পনা বিভূতিভূষণ করতেন কিনা জানা নেই। তবে সমসাময়িককালে বিভূতিস্নেহধন্যা সুপ্রভা চৌধুরী (দত্ত)কে ‘পথের পাঁচালী’র অভাবী লেখক মাঝে মাঝেই,কার কতহুলি বই সিনেমা হয়ে অভাব ঘুচেছে সে গল্প করতেন। এই সময় সুপ্রভা  প্রশ্ন করতেন,তিনি কেন সিনেমার জন্য বই দেন না। উত্তরে বিভূতিভূষণ নাকি বলতেন, ‘আমি যে সিনেমা হবে ভেবে কিছু লিখতে পারিনে। আর ‘পথের পাঁচালী’ তো কেউ আর ছবি করবে না!’

কিন্তু, বিভূতিভুষণের জীবদ্দশাতেই ১৯৪৪ সালে ,সিগনেট প্রেসের ‘আম আঁটির ভেঁপু’র সচিত্র সংস্করণ অলঙ্করণ করতে করতে ডি যে কিমার কোম্পানির এক তরুণ কমার্সিয়াল আর্টিস্ট ওই বই নিয়ে ছবি করারই স্বপ্ন দেখেছিলেন। এর পরের ঘটনা ইতিহাস। যে বই নিয়ে বিভূতিভূষণ ছবি হবার কথা ভাবতেও পারেননি সেই বই নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের তৈরি ছবি হয়ে গেল বাংলা তখা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলস্টোন।

 বিভূতিভূষণ অবশ্য তখন পরপারে।