Blog



গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক
বরণীয়দের না-ক্রিয়া
বিদ্যাসাগর তখন চন্দননগরে অবস্থান করছেন। হিতবাদীর সহ সম্পাদক চন্দননগর নিবাসী যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় গিয়েছেন বিদ্যাসাগরের কাছে।
যোগেন্দ্রকুমারের তখন যুবক বয়স। পিতার সূত্রে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচয়। প্রায় প্রায়ই চলে যান বিদ্যাসাগরের কাছে। খুঁটিয়ে দেখেন বিদ্যাসাগরের ঘর গেরস্তালি । এর মধ্যে সবচেয়ে অবাক লাগে বিদ্যাসাগরের বসার চেয়ারটাকে দেখে । বাড়িতে তো সারাদিন খালি গায়েই থাকেন। আবার প্রতিদিন তেলও মাখেন সারা গায়ে। অথচ বসার চেয়ারের পৃষ্ঠদেশের বার্নিশ মলিন না হয়ে কীভাবে এমন অটুট থাকে!\
সেদিন প্রশ্নটা করেই ফেললেন বিদ্যাসাগরকে।
যোগেন্দ্রকুমারের প্রশ্ন শুনে বিদ্যাসাগর হেসে বললেন-‘হেলান দিয়ে বসলে তবে তো রং চটবে। আমি কখনও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি না। এতদিন আসছিস,দেখিসনি!’
চিরকাল শিরদাঁড়া সোজা করা মানুষের উপযুক্ত কথাই বটে!
বরণীয় মানুষদের জীবনে এমনই অনেক ছোটখাট ইচ্ছাকৃত না-করা কাজ থাকে। আমরা সাধারণত তাঁদের করা কাজগুলোকেই বেশি দেখি। তাঁদের ইচ্ছাকৃত না-করা ছোটখাট কাজগুলো বেশিরভাগ সময়ে সামনেই আসে না। অথচ তাঁদেরও না -করা কাজগুলোর কোনওটার পিছনে থাকে ব্যক্তিগত নীতি আদর্শ আবার কোনওটার পিছনে থাকে নিজের জীবনের কোনও ঘটনা। এই না-করা কাজ দিয়ে তাঁদের জীবনকেও কিন্তু অনেকটা ছোঁয়া যায়।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রেরও এমন একটা অপছন্দের কাজ ছিল আদালতের বাইরে আদালতের কোনও কথা বা সুপারিশ না শুনতে চাওয়া। এ ব্যাপারে বঙ্কিম ছিলেন রীতিমত কঠোর।
বঙ্কিম তখন হুগলির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাড়ি থেকে নৌকো করেই হুগলি যান। সেদিন এক আত্মীয় এসেছিলেন কাঁঠালপাড়ায়। বঙ্কিমকে বললেন তাঁর সঙ্গে হুগলি যাবেন। একে আত্মীয়,তায় বঙ্কিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে যথেষ্ট। নৌকোয় নিয়ে যেতে সানন্দেই রাজি হলেন বঙ্কিম।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধল কিছুটা যেতে। বঙ্কিমের হাতে থাকা একটা মোকদ্দমার প্রসঙ্গ তুলে আত্মীয় সহযাত্রী বঙ্কিমের কাছে সুপারিশ করলেন,যেন আসামীদের কড়া শাস্তি দেওয়া হয়। এবার বঙ্কিমের ভিন্নমূর্তি বেরিয়ে এল। মাঝিকে চীৎকার করে বললেন-‘নৌকা ভেড়াও।’
কাছাকাছি একটা চর ছিল। মাঝি তাড়াতাড়ি সেখানে নৌকো ভেড়াল। বঙ্কিম মাঝির দিকে চেয়ে বলে উঠলেন-‘লোকটাকে ওই চরে নামিয়ে দে।’
মাঝিকে আর নামাতে হল না। বঙ্কিমের হাবভাব দেখে সহযাত্রী নিজেই লাফ দিয়ে চরে নেমে গেলেন। পরে অন্য নৌকো ধরে তীরে এসে নামলেও কাঁঠালপাড়ার পথ আর নাকি মাড়াননি আত্মীয়টি।
মেজাজের দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। রাগ হলেও যা করবেন যা বলবেন সবকিছুতেই কবিত্বের ছোঁয়া। একবার এক অনুষ্ঠানে কবির নিমন্ত্রণ। কবি সেখানে পৌঁছে দেখেন,সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠান হবার কথা,অথচ উদ্যোক্তাদের কারও পাত্তা নেই।
কবি কিছুক্ষণ বসে থেকে একটা চিরকূট লিখে একজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে এলেন। চিরকূটে লেখা- ‘এসেছিলেম, বসেছিলেম,দেখলেম কেউ নেই /আমার সাড়ে পাঁচটা জেনো পাঁচটা তিরিশেই।’ আসলে সময়ের ব্যাপারে কবি ছিলেন সাংঘাতিক পাংচুয়াল। লেটে চলা তাঁর পোষাত না। দৈনন্দিন জীবনে বৃহৎ এই না-ক্রিয়াটির জন্যই হয়ত শেষ বয়সে অ্যালার্মের ঘড়ি নিয়ে একটা মজার কবিতা শুনিয়েছিলেন রানী চন্দকে।-‘ওগো অ্যালারাম ঘড়ি/যারা বেলারাম বিছানায় থাকে পড়ি,/তাহাদের জাগাবার লাগি/তুমি রহ জাগি।’
আবার মেজাজের প্রসঙ্গে ফিরি। বঙ্কিমের সঙ্গে মেজাজের ব্যাপারে তারাশঙ্করের কিন্তু বেশ মিল। তারাশঙ্করের মেজাজ হারানোর একটা গল্প বলা যাক। তখন ‘সপ্তপদী’ লেখা চলছে। কিন্তু সেদিন লেখাটা ঠিক খুলছে না।প্লটের মধ্যে একেবারে ডুবে রয়েছেন।
গায়ে একটা বেগুনী রঙের নতুন তোয়ালে গেঞ্জি। ঘরের মধ্যে সমানে পায়চারী করছেন তারাশঙ্কর। এমন সময় ছেলে সনৎ অফিস যাচ্ছিলেন। যাবার পথে বাবার পায়চারীটার চেয়েও তাঁর বেশি নজরে পড়ল গায়ের গেঞ্জিটা।
সনৎ বলেই ফেললেন-‘বাবা গেঞ্জিটায় তোমাকে মানাচ্ছে না।’ তারাশঙ্কর ছেলের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাইলেন। তারপর দুহাত দিয়ে সজোরে টেনে ছিঁড়ে ফেললেন নতুন গেঞ্জিখানা। ছে্লেকে বললেন-‘এই নাও,এবার মানিয়েছে তো!’
সনৎ প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে বুঝলেন। ধ্যানের উপর আচমকা ঘা। সেজন্যই এমন আচরণ। আসলে বাবা তো এমনিই। লেখা নিয়ে ডুবে থাকার সময় তিনি যে বিন্দু মাত্র বিঘ্ন বরদাস্ত করেন না।
এবারে বিভূতিভূষণ। তাঁর না-ক্রিয়ার এই গল্প বিদ্যাসাগরের মতোই বস্তুকেন্দ্রিক। তবে এটি একটি ফল। আঙুর। যে ফলটি খাবার আবদার করেছেন মৃত্যুশয্যায় শায়িত পিতা,বড় পুত্রের কাছে। কতই বা বয়স তখন বিভূতিভূষণের! ১৮৯৪ এ তাঁর জন্ম আর এ ঘটনার সময়কাল ১৯১১।
বিভূতিভূষণ তখন বনগ্রামের বোর্ডিং স্কুলে পড়েন। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়েই ছুটে এসেছেন স্কুল থেকে। এসেই নিয়েছেন বাবার সেবা শুশ্রূষার ভার। এই সময়ে হঠাৎ বাবার এহেন ইচ্ছার প্রকাশ। কিন্তু আঙুর তখন এত সহজলভ্য ফল ছিল না।
হয়ত শহরে গেলে পাওয়া যাবে এই ভরসায় ক্লাস এইটের ছাত্রটি সেদিন বেরিয়ে পড়লেন বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে। অনেক চেষ্টায় যোগাড় হল। কিন্তু সে আঙুর আর বাবার খাওয়া হল না। বাড়ি ফিরে দেখলেন তার ঘাড়ে বিরাট সংসারের বোঝা চাপিয়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন বাবা।
সংসারে বোঝা নিয়ে পরবর্তীকালে জেরবার হলেও তা হাসিমুখেই সামলেছেন বিভূতিভূষণ। এরই সঙ্গে বাবার না-মেটা সাধও তিনি কখনও ভোলেননি। পরবর্তী জীবনে আঙুর তিনি কখনও চেখেও দেখেননি।