Blog

গল্পঃসাহিত্য/সাহিত্যিক


মানিক ও অন্য দুই বন্দ্যোপাধ্যায়
আপনার পছন্দের উপন্যাস কোনটি? এমন প্রশ্ন বইপ্রিয় পাঠকদের নানা ওয়েব গ্রুপে মাঝে মাঝেই ওঠে। বই পাঠকদের একটা বড় অংশ প্রিয় বই হিসাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ অথবা ‘দিবারাত্রির কাব্য’এর নাম উল্লেখ করেন। বইদুটি বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবিতকালে মানিক তেমন পাঠকপ্রিয় লেখক ছিলেন না। এখন হয়েছেন এটা সুখের কথা।
প্রসঙ্গত বাংলা সাহিত্যের তিন দিকপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অবস্থানটা ঠিক কোন জায়গায়, একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। শুধু সাহিত্যিক মানিক নন,ব্যক্তি মানিকেরও।
তিনজনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বিভূতিভূষণ জন্মেছিলেন ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি করা জন্মপত্রিকায় এই তারিখটাই লেখা রয়েছে। তারাশংকরের জন্ম ২৩ জুলাই ১৮৯৮ এ । আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়এর জন্ম তারিখ হল ১৯ মে ১৯০৮। অর্থাৎ জ্যেষ্ঠের থেকে মানিক প্রায় ১৪ বছরের ছোট। আর তারাশংকরের সঙ্গে তাঁর বয়সের পার্থক্য দশ বছরের মত।
আগে দু-একটি গল্প লিখলেও বিভূতিভূষণের সাহিত্যজীবনের সূচনা হিসাবে দেখা হ্য় ১৯২৮ সালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশ থেকে। তারাশংকরের সাহিত্য জীবনের সূচনা কবে এ নিয়ে তিনি নিজেই ‘আমার সাহিত্য জীবন`এ লিখে গেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে ,১৯৩০ সালে যে দিন তিনি জেলখানা থেকে ছাড়া পেলেন,সেই দিনটাকেই তিনি চিহ্নিত করেছেন তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা-তারিখ হিসাবে। আর মানিকের ‘অতসীমামী’ ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশের সমসময়ে হলেও সাহিত্যের আসরে তিনি পাকাপাকি ভাবে আসেন ১৯৩৫ সালে। তার মানে তিনজনের সাহিত্যজীবনের সূচনা কিছুটা বয়সের ক্রম মেনেই।
পথ অবশ্য তিনজনের পুরোপুরিই আলাদা। সাহিত্যিক দেবেশ রায়কে অনুসরণ করে বিভূতিভূষণকে যদি বলা যায় ‘নিরন্তর অনুভব’,তবে তারাশংকর হবেন ‘নিরন্তর দেশ’। আর মানিক? তাঁকে নাম দেওয়া যেতে পারে ‘নিরন্তর মানুষ’।
স্বভাবে তিনজন তিনরকম। বিভূতিভূষণ আত্মভোলা ,সরল। শুধু বনজঙ্গল নয়, মানুষেরও সঙ্গপিয়াসী। সমসাময়িক বহু খ্যাতনামা ব্যক্তির সঙ্গেই বিভূতিভূষণের অন্তরঙ্গতা। আর তারাশংকর জানিয়েছেন গ্রাম থেকে শহরে আসার জন্য প্রথম দিকে তিনি একটু গুটিয়ে থাকতেন। পরে অবশ্য ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়। এই দুজনের থেকে মানিকের অবস্থান এক্ষেত্রেও আলাদা। তিনি মুখচোরা, অন্তর্মুখী। তাঁর মনের গঠনও ভিন্ন। সজনীকান্তের ভাষায় –‘মুখচোরা লাজুক ছেলে।কিন্তু ‘সরীসৃপ’ গল্পেই তাঁহার পোক্ত-পরিণত মনের পরিচয় পাইয়াছিলাম, সে মন সরল সাধারণ নহে,কুটিল জটিল অসাধারণ।’ এমন মানুষের বন্ধুসংখ্যা যে সীমিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বচ্ছলতার প্রশ্নে বড় বিভূতিভূষণ অনুকূল অবস্থায় এসেছেন সাহিত্যজীবনের প্রায় গোড়া থেকেই। তাছাড়া তাঁর নিজের একটা কর্মজীবন ছিল। নানা কাজ করলেও শেষে শিক্ষকতায় থিতু হয়েছেন। রোজগার যে পরিমাণই হোক,কাজ ছিল স্থায়ী। যদিও প্রথম দিকে অনেক দায় তাঁকে সামলাতে হয়েছে। ভাইকে ডাক্তারি পড়ানো, বোনকে দেখভাল।
আর তারাশংকর তাঁর কলকাতা বাসের প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধার মধ্যে পড়লেও পরে স্বচ্ছল হয়েছেন,গাড়িও কিনেছেন।
অন্যদিকে মানি্কের স্বচ্ছলতা কোনও দিন ছিল না। চাকরি করেছেন খুব কম দিনই। লেখার উপরই নির্ভরশীল ছিলেন সংসার চালাবার ব্যাপারে। সংসার যে চলত না,তা বলাই বাহুল্য। এর উপ্র ছিল তাঁর মৃগী ব্যাধি ও নেশাজনিত খরচ।
তিনজনেরই সাহিত্যজীবনের বেশ কিছুটা রবীন্দ্রনানাথের জীবদ্দশায়। বিভূতিভূষণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ হয়েছিল। কাছাকাছিও গিয়েছিলেন কয়েকবার। ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে তিনি ‘পরিচয়’পত্রিকায় যা লিখেছিলেন তা আজও ওই গ্রন্থ প্রসঙ্গে কোট করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে বিভূতিভূষণ তাঁর ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপি উৎসর্গ করে লেখেন-‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অমর আত্মার উদ্দেশে।’
তারাশংকরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তো নিবিড় যোগ। তাঁর ‘গ্রামের চিঠি ‘ থেকেই রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ পেয়েছেন। সেসময়ের গল্পকারদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বারেবারেই তারাশংকরের বিশিষ্টতার কথা উল্লেখ করেছেন।
এ ক্ষেত্রেও মানিক কিন্তু ভিন্ন পথের পথিক। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় মানিকের বারোটি বই বেরোয়। একটিও তিনি রবীন্দ্রনাথকে পাঠাননি। মানিকের প্রিয় কবি ছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য।
জ্যেষ্ঠ বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে মানিকের সম্পর্কটা কেমন ছিল? তিনজনেরই সাহিত্য পথ আলাদা। ব্যক্তিজীবনে চলার পথেও মিল নেই। তবু মানিক তারাশংকরের কিছুটা কাছাকাছি ছিলেন দুজনেই প্রগতি লেখক সংঘের সদস্য হওয়ায়।
বিভূতিভূষণ কখনও রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াননি। বিভূতিভূষণের কাছে মানিকের ভাবমূর্তির একটা ধাঁচ অবশ্য পাওয়া যেতে পারে তাঁর ডায়েরিতে কান পাতলে। যে সময়ে ফ্রয়েডে আচ্ছন্ন মানিক লিখে চলেছেন মনোবিকলনের গল্পকাহিনি ,সে সময় বিভূতিভূষণ ডায়েরিতে লিখছেন-‘বাংলার সমস্যা নয় যৌনসমস্যা। বাংলার সমস্যা রোগ, দারিদ্র্য, মূর্খতা-এই সব। সৌখীন যৌনসমস্যা হয়ত শহরে আছ –সে খুব বড় সমস্যা নয়।’
অন্যদিকে তারাশংকর বেশ স্নেহের চোখেই দেখতেন অনুজ সাহিত্যিকটিকে। মানিকের অতিরিক্ত মদ্যপান নিয়ে তিনি চিন্তিতও ছিলেন। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁকে বলতে শোনা যেত-‘ এইভাবে চললে ওকে আর বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। ’ অতুল গুপ্তকে ধরে,সরকারি মহলে প্রভাব খাটিয়ে মানিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা ও তাঁর পরিবারের ব্যয় বাবদ মাসিক টাকাও মঞ্জুর করিয়েছিলেন। মানিকও তারাশংকরকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। ডাকতেন ‘ তারাশংকরদা’ বলে। একবার হ্যারিসন রোডের মোড়ে নেশাগ্রস্ত মানিক তারাশংকরকে দেখে ধরা পড়ার ভয়ে কীভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন সে বর্ণনা গৌরীশংকর ভট্টাচার্যের ‘বিভূতিভূষণ তারাশংকর ব্যক্তিরূপ’ বইতে রয়েছে।
গৌরীশঙ্কর লিখেছেন, মানিকের নেশাগ্রস্ততা নিয়ে তারাশংকর চিন্তিতও ছিলেন খুব। এইভাবে চললে মানিককে যে আর বেশিদিন বাঁচা্নো যাবে না, পরিচিত মহলে তারাশংকর বলতেনও।
বিভুতিভূষণের সঙ্গে মানিকের দেখা হয়েছে কিনা সে সংবাদ পাওয়া যায় না। রুশতী সেন ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামের জীবনীগ্রন্থেও কিছু লেখেননি। তবে সজনীকান্তের ‘আত্মস্মৃতি’তে দেখা যাচ্ছে মানিক যেসময় সজনীকান্ত সম্পাদিত ‘বঙ্গশ্রী’তে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ ‘একটি দিন’, ‘একটি সন্ধ্যা’, ‘একটি রাত্রি’ নামে লিখছেন, সেসময় ‘বঙ্গশ্রী’র ‘বিচিত্র জগৎ’ সামলাচ্ছেন বিভূতিভূষণ। এই পর্বে দুজনের কোনওদিন দেখা হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
সমকালীন পাঠকপ্রিয়তায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন বিভূতিভূষণ। বিভূতিভূষণের ব্যাপারটা অনেকটা ছিল ‘এলেন,দেখলেন,জয় করলেন’এর মত। তারাশংকরএর শুরুটা ভাল হয়নি। প্রথম দিকে বই ছাপানো নিয়ে অনেক লাঞ্ছনাও সইতে হয়েছে।
মানিক সমকালে তাঁর প্রাপ্যমূল্য না পেযেছেন প্রকাশকের কাছ থেকে না বাংলাদেশের পাঠকদের কাছ থেকে। ফলে তাঁকে খেদোক্তি করতে হয়েছে-‘দুটি ডালভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না আসে।’