Blog



গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক(ন্যাড়া নজর)
ন্যাড়া নজর
দেখার যে নানান রকমফের আছে,এটা কোনও নতুন কথা নয়। গানের লাইনেই তো আছে-‘তুমি দ্যাখো নারীপুরুষ/আমি দেখি শুধুই মানুষ।’ তবে ন্যাড়া নজরের ব্যাপারটাই আলাদা। এখানে দেখার স্বচ্ছতা আর বক্রতা মিলেমিশে একাকার। সেজন্য এখানে যেমন কষ থাকে,তেমনি থাকে রসও।
ন্যাড়া নজরের লোকদের কথাবার্তা স্বাভাবিকভাবেই বেশ মজাদার। যেমন প্যাঁচানো,তেমনি উইটের ছড়াছড়ি। অনেকটা মিছরির ছুরির মত অন্তরে সেঁধিয়ে যায়।
আমাদের সাহিত্য মানে বাংলা সাহিত্য তো ন্যাড়া নজরের কারখানা। দীনবন্ধু,বঙ্কিম,কালীপ্রসন্ন,প্যারীচাঁদ তো বটেই অন্যান্য অনেকেই যখনই সুযোগ পেয়েছেন,নজরের সামনে থেকে কাব্যি কল্পনা সরিয়ে একেবারে ন্যাড়া চোখে চারপাশে তাকিয়ে প্রচুর রস ও কষের উৎপাদন ঘটিয়ে কখনও আমাদের মনের,কখনও আমাদের সমাজের আবার কখনওবা যুগপৎ দুইয়েরই সন্তোষ এবং/অথবা কল্যাণ বিধান করে গেছেন।
বিদ্যাসাগরের কথাই ধরা যাক। সাহায্য চাইতে আসা দরিদ্র ব্রাহ্মণটি যেই বললেন-‘মহাশয় আমার বড় দুরাবস্থা,অমনি তাঁর ন্যাড়া নজর বলে উঠল-‘সে তো আকারেই বোঝা যায়।’ শ্লেষটা দরিদ্র ব্রাহ্মণ ধরতে পেরেছিলেন কিনা জানি না,তবে আমরা কিন্তু আজও বর্ণপরিচয়ের স্রষ্টার এই ন্যাড়া নজরের সামনে ‘দুরবস্থা’ বানান বড় যত্নে সামলাই। বিদ্যাসাগরের ন্যাড়া নজরের উদাহরণ প্রচুর। তাঁর অপকার করা জনৈকের উদ্দেশে,’আমি তো তার কোনও উপকার করিনি’ আজ তো প্রায় প্রবচনে পরিণত।
ন্যাড়া নজর বলতেই আমরা বুঝি,একদল সমালোচক। সমালোচকের নজরে স্বচ্ছতা,বক্রতা বিরল নয়,কিন্তু স্বচ্ছতা তো অনেকসময়েই দেশকাল ও ব্যক্তি নির্ভর। তাই এককালের স্বচ্ছতা অন্যকালে কলকে নাও পেতে পারে। এবং সমকালেও ব্যক্তি নিন্দিত হতে পারেন।
তা এসব যা-ই হোক সমকালে আলোড়ন সৃষ্টি করা ‘সোনার তরী’ কবিতার দ্বিজেন্দ্রলালকৃত সমালোচনাটি সেদিন কিন্তু ছিল অনবদ্য এক ন্যাড়া নজর। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখছেন-‘কৃষক ধান কাটিতেছে বর্ষাকালে, শ্রাবণমাসে।কিন্তু বর্ষাকালে ধান কেউই কাটে না। বর্ষাকালে ধান রোপন করে…শ্রাবণ মাসে ‘এল বরষা’ কিরূপ? বঙ্গদেশে আষাঢ় মাসেই বর্ষা আসে। তাহার পর ‘একখানি ছোট ক্ষেত’ হইতে ‘রাশি রাশি ভারা ভারা’ধান হইয়াছে।ক্ষেত বড়ই উর্বরা!’
‘সোনার তরী’ কবিতায় আছে-‘পরপারে দেখি আঁকা/তরুছায়া-মসী-মাখা/গ্রামখানি মেঘে ঢাকা/প্রভাতবেলা-।’ দ্বিজেন্দ্রলালের অভিমত-‘মেঘেঢাকা গ্রামে তরুছায়া হয় না,অন্তত এপার হইতে তাহা দেখা যায় না। রৌদ্র হইলেই ছায়া হয়।’
এ সমালোচনার সামনে কাব্যের যেন একেবারে জোড়হাত করে বিদায় নেবার অবস্থা!
মাইকেল তাঁর সমালোচকদের মধ্যে মেদিনীপুরের হেডমাস্টারটির মতকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিতেন।সেই হেডমাস্টার রাজনারায়ণ বসুর ন্যাড়া নজর আবার ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ রাম লক্ষ্মনের জটাবল্কলের আড়ালে কোটপ্যান্টুলুন খুঁজে পায়। জানায়ও কবিকে।
চিত্তরঞ্জন দাশের ন্যাড়া নজরে ধরা পড়ে,রবীদ্রনাথের ‘এলেম আমি কোথা থেকে/কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে’প্রশ্ন কোনও শিশুর পক্ষে মাকে করা অসম্ভব।তাঁর মতে-‘ইহাতে কবি বোধহয় বুড়ো খোকার মতো আপনার মনকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন,আর …মায়ের মুখে তাঁহার নিজের বুলি বসাইয়া দিয়াছেন।’।
ওদিকে দ্বিজেন্দ্রলাল রবীন্দ্রনাথের ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ গানটিকে ‘লম্পট বা অভিসারিকার গান’ হিসাবে অভিহিত করলে প্রমথ চৌধুরী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ন্যাড়া নজর হেনে লিখলেন-‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ কথাটা ভারতবাসীর পক্ষে যে অপ্রীতিকর,তা আমি স্বীকার করতে বাধ্য। কেননা যামিনী গেলেও আমরা জাগবার বিপক্ষে। আমরা শুধু রাতে নয়, অষ্টপ্রহর ঘুমুতে চাই।’
সাহিত্যে ন্যাড়া নজরের ক্ষেত্রে ‘শনিবারের চিঠি’ তো বাংলাদেশে পথিকৃৎ হয়ে আছে। প্যারডি রচনায় সিদ্ধহস্ত সজনীকান্তের ন্যাড়া নজরে অনেকেই জেরবার ।জীবনানন্দের ‘ক্যাম্পে’র কথা বলা যাক। ‘ক্যাম্পে’ কবিতায় আছে ‘একে একে হরিণেরা আসিতেছে-সুন্দরী গাছের নীচে জ্যোৎস্নায়!/মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে।’ এ নিয়ে সজনীকান্ত লিখলেন-‘মেয়েমানুষ কি করিয়া নোনা হইল? নোনা ইলিশ খাইয়াছি বটে,কিন্তু কবির দেশে মেয়েমানুষের কি জারক প্রস্তুত হয়? কবি যে এতদিনে হজম হইয়া যান নাই,ইহাই আশ্চর্য!’
তবে সাহিত্য সমালোচকদের ন্যাড়া নজরের প্রতি-জবাবে লেখকদেরও ন্যাড়া নজর দুর্লভ নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘সে’ খুলে দেখুন। ‘সে’ কে বলাই হয় ‘ছদ্মবেশী শিশুসাহিত্য। এখানে শিশুসাহিত্যের মোড়কে তথাকথিত সাহিত্য সমালোচকদের একহাত নেওয়া বলতে যা বোঝায় তার উদাহরণ প্রচুর। তবে এই প্রসঙ্গে জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত ন্যাড়া নজরের লাইন-‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা-‘আজও সুপারডুপার হিট।
ন্যাড়া নজরের ক্ষেত্রে ব্যক্তি আক্রমণ অবশ্যই অভিপ্রেত নয়। কিন্তু তবু কি তা সব সময় আটকানো যায়! শরৎচন্দ্রের প্রিয় কুকুর ভেলি মারা গেছে। শোকে মুহ্যমান শরৎচন্দ্র। সেসময় অনেকেই শরৎচন্দ্রকে চিঠি লিখে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। শিবরামও চিঠি লিখলেন। তবে সেখানে রসিকতাচ্ছলে ব্যঙ্গের চাবুকটাও বেশ সক্রিয়। ‘বাতায়ন’ পত্রিকার সম্পাদক অবিনাশ ঘোষালের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের প্রীতির সম্পর্ক নিয়ে যে ঠাট্টা বিদ্রূপ সে সময় চালু ছিল,শিবরামের ন্যাড়া নজর দেখল সেটাই। শিবরাম লিখলেন-‘ভেলির বিনাশ নাই/ভেলি অবিনাশ।’
তবে ব্যক্তি আক্রমণে ‘শনিবারের চিঠি’ সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। একবার প্রমথ চৌধুরীকে আক্রমণের মাত্রাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে রবীন্দ্রনাথ ডাকে পাঠানো পত্রিকা গ্রহণ না করে ফেরত পাঠিয়ে দেন।