Blog
গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক
অভিনব পাওনাদার
সেদিন কলেজস্ট্রিটে এক অভিনব পাওনাদারকে দেখা গেল। সাধারণত পাওনাদারের ভয়ে ঋণী ব্যক্তিকে গা ঢাকা দিতে দেখা যায়। কলেজস্ট্রিটে সেদিন উল্টো দৃশ্য। ঋণী ব্যক্তিকে দেখে পাওনাদারই ছাতা দিয়ে নিজের মুখ আড়াল করার চেষ্টা করছেন।
পাওনা টাকার পরিমাণও কম নয়। গত শতকের তিনের দশকের শেষ দিক সেটা। পাওনা টাকা পাঁচশোর মূল্য তাই অনেকটাই।
পাওনাদার ব্যক্তিটি আর কেউ নন। বিভূতিভূষণ। ঋণী ব্যক্তিটিও উচ্চশিক্ষিত,আদর্শবাদী,বিলাতফেরত। নাম অশোক গুপ্ত। বিকলাঙ্গ,অপরিণতবুদ্ধি শিশুদের নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল অশোক গুপ্ত ও তাঁর স্ত্রীর। এজন্য দরকার গ্রাম্য নির্জন একটা পরিবেশ। পছন্দ হয়েছিল ঘাটশিলার এক জনহীন স্থান। তৈরি করেছিলেন ছোট্ট একটা বাড়ি।
অশোক গুপ্তের সঙ্গে বিভূতিভূষণের পরিচয় ওই সময়েই। বিভূতিভূষণ তাঁদের সাধনার কথা শুনে শুধু তাঁদের উৎসাহই দেননি। আর্থিক দুরবস্থা তখন লেখার দৌলতে অনেকটাই তাঁর ঘুচেছে। অশোক গুপ্তকে তাঁদের আর্থিক অসুবিধার জন্য পাঁচশো টাকা ধারও দিয়েছিলেন।
এই ধার গুপ্তসাহেবের মনে না থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি নানাভাবে জড়িয়ে পড়লেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানও একসময় নিঃশেষ হয়ে গেল। স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ল তাঁর।
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিভূতিভূষণ গুপ্তসাহেবের খোঁজ নিতে পারলেন না। পাছে গুপ্তসাহেব ভাবেন,টাকার জন্যই এই খোঁজ।
এরপরের ঘটনা ওই কলেজ স্ট্রিটের। কিন্তু ছাতা দিয়ে মুখ আড়াল করার আগেই সেদিন অশোক গুপ্ত দেখে ফেলেছিলেন বিভূতিভূষণকে।
-‘বিভূতি না!’ বলেই এগিয়ে এসে বিভূতিভূষণের হাতটা ধরে ফেললেন তিনি। বললেন-‘আমার একটা উপকার করতে হবে। না বললে হবে না। বল করবে!’
মানুষটির উপর বিভূতিভূষণের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। বললেন-‘নিশ্চয় করব। বলুন দাদা।’
-‘আমাকে ঋণমুক্ত করতে হবে। তোমার পাওনা টাকার বিনিময়ে ঘাটশিলার ওই বাড়ি নিয়ে।’
বিভূতিভূষণ প্রচন্ড আপত্তি জানালেন।-‘তা কেমন করে হবে? একখানা বাড়ির দাম পাঁচশো টাকার অনেক বেশি!’
অশোক গুপ্ত নাছোড়।
বিভূতিভূষণ বললেন,-‘বেশ। কিন্তু পাঁচশোতে নয়। আর কত টাকা আপনাকে দিতে হবে বলুন।’
গুপ্তসাহেব বললেন, -‘না, আর কিছুই তোমাকে দিতে হবে না।’
এরপরে গুপ্তসাহেব রেজিস্ট্রি করে বাড়িটা দিয়ে দিলেন বিভূতিভূষণকে।
বিভূতিভূষণ বাড়ির নাম রাখলেন-‘গৌরীকুঞ্জ’। প্রয়াত স্ত্রীর নামে।
বিভূতিভূষণের অনেক অসামান্য সৃষ্টির সঙ্গে এই ‘গৌরীকুঞ্জ’ জড়িয়ে আছে। ছুটি পেলেই বিভূতিভূষণ ছুটে যেতেন ওখানে। সপরিবারে ওখানে থাকতেন ভাই নুটুবিহারীও।
এখানেই ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রয়াত হয়েছিলেন বিভূতিভূষণ।
তর্কযুদ্ধ
তর্ক বেঁধেছে তিন সাহিত্যিক বন্ধুর মধ্যে। একদিকে দুজন। অন্যদিকে একজন। একজনকে কিন্তু দুজন কিছুতেই পেরে উঠছেন না।
তর্কে পেরে না ওঠার সেই একজন ঘোরতর রবীন্দ্রবিরোধী। অন্য দুজন আবার উল্টো। প্রবল রবীন্দ্রভক্ত। রবীন্দ্রভক্ত দুজনের চেষ্টা রবীন্দ্র-বিরোধী বন্ধুটির মন থেকে তাঁদের প্রিয় মানুষটি সম্পর্কে সব বিদ্বেষ দূর করা।
ফলে শুরু হয়েছিল আলোচনা। রবীন্দ্রবিরোধী বন্ধুটির আরাধ্য দেবতা বঙ্কিম,রবীন্দ্রনাথের নামটাও তিনি শুনতে পারেন না,বাড়িতেও রবীন্দ্রনাথের প্রবেশ নিষেধ। তাঁর এক আত্মীয় রবীন্দ্রনাথকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে বই লিখেছেন,‘রবিয়ানা’। সেই বইয়ের কথা,তাঁরও কথা। ফলে তাঁর সঙ্গে দুই বন্ধুর আলোচনা রূপ নিয়েছে তর্কে।
তর্কটা চলছে কিন্তু কোনও ঘরে নয়। তর্ক চলছে রাস্তায়,পার্কে। হাঁটতে হাঁটতে,কখনও বা বসে। হাঁটা মানে মোটেই একটু আধটু হাঁটা নয়। হেদুয়ার মোড় থেকে বিডন স্ট্রিট ধরে চিত্পুরের মোড় পর্যন্ত কম রাস্তা তো নয়। এরপর সবাই মিলে ঢুকে যাওয়া বিডন গার্ডেনে। এবার তর্ক চলে বসে বসে। ইতিমধ্যে রাত বেড়েছে। জনবিরল হয়েছে পথ। তর্ক তবু থামে না।
একজন যাবে একদিকে। অন্য দুজন আর এক দিকে। কিন্তু তর্ক ছেড়ে একজন বাড়িমুখো হতেই অন্য দুজন তাঁর সঙ্গী হন। এভাবে চলে কিছুক্ষণ। সত্যি সত্যি যখন বিদায় পর্ব চুকে গিয়ে যে যার পথে, সেসময় কিছুটা রাস্তা এসে রবীন্দ্রবিরোধী মানুষটির মনে হয়,তূণের কিছু চোখা চোখা বাক্যবাণ তখনও ছোঁড়া বাকি। আর যায় কোথা? অমনি সেগুলো ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তিনি আবার সঙ্গ নেন বন্ধুদের।
বিডনস্ট্রিটের অর্ধেকটা উজিয়ে চলে আসেন বন্ধুদের সঙ্গে। তর্ক তবু অমীমাংসিত। রাত অনেক,অগত্যা তিনজনকে অতৃপ্ত মনে বাড়ি ফিরতে হয়। যেখানে থামা হয়েছিল,পরদিন আবার সেখান থেকে শুরু হয়। এভাবে চলে দিনের পর দিন। অবশেষে জয়। রবীন্দ্রভক্ত দুই ব্রাহ্ম বন্ধু রবীন্দ্রবিরোধী বৈদ্য বন্ধুটির মগজ ধোলাইয়ে সফল। এবং এতটাই সফল যে কেউ আর তাঁকে সেই জায়গা থেকে টলাতে পারে না।
একবার চেষ্টা করলেন শরত্চন্দ্র। বললেন-‘তুমি যদি আমাকে গুরু বলে মানো, তোমাকে একটা ফাউন্টেন পেন দেব।’ তিনি শরত্চন্দ্রকে বললেন-‘আপনি আমার শ্রদ্ধাভাজন,কিন্তু আমার গুরু রবীন্দ্রনাথ। আর কাউকে তো গুরু বলে মানতে পারব না।’
এই গুরুভক্তির কথা ধরা আছে তাঁর এক চিঠিতেও-‘সাহিত্য-মার্গে একমাত্র তাঁকেই বিরাট আদর্শের মতন সামনে রেখে পথ চলার চেষ্টা করেছি। শক্তির দীনতার জন্য বেশী দূর অগ্রসর হতে পারিনি ,তবু ত্যাগ করিনি তাঁকে অনুসরণ করবার প্রাণপণ চেষ্টা।’
রবীন্দ্রভক্ত যে দুই বন্ধু সেদিন এমন অবিস্মরণীয় মগজ ধোলাইয়ের কাজটি করেছিলেন তাঁরা হলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ও প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় । আর রবীন্দ্রবিরোধী থেকে রবীন্দ্রভক্ত হয়ে যাওয়া সাহিত্যিকটি হলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। বাংলা সাহিত্যে যিনি পরিচিত সব্যসাচী লেখক হিসাবে।