-‘বাপি,ওই যে মোটাটা আন্টির সঙ্গে এদিকে আসছে ,ওর নাম লাল । ’-‘চিনিস ওকে !`পরমেশের গলায় ছদ্ম-বিষ্ময়।-‘চিনব না?আমাদের ক্লাসেই তো পড়ে। এক নম্বরের পাজি ।’দুলে দুলে বলে হলুদ ।-‘ও ভাবে কারও সম্পর্কে বলতে নেই মামণি!’পরমেশ হলুদের মাথায় হাত বোলায়।-‘তুমি জান না বাপি ,ও সবার টিফিন কেড়ে খায়।আমারও খেয়েছে দুদিন।’হলুদের কথায় পরমেশকে এবার একটু চিন্তিত লাগে। মেয়ের এত বিরূপতা থাকলে তো খুব সমস্যা! পরমেশ হলুদকে কোলে তুলে নিয়ে বলে –‘সবাই কি তোমার মত শান্ত হবে মামণি?তুমি বরং এবার থেকে  তোমার টিফিনের কিছুটা ওকে আগেই দিয়ে দিয়ো ।’হলুদ রুক্ষ স্বরে বলে ওঠে-‘আমার বয়েই গেছে।’পরমেশ চিন্তায় পড়েছিল।এবার গাড্ডায় পড়ে। এই পার্কেরই কোথাও না কোথাও বেশ কিছুটা সময় হলুদকে লালের সঙ্গে আজ কাটাতে হবে। না হলে ছুটির এই দিনটাই বৃথা যাবে। কিন্তু এ মেয়েকে লালের সঙ্গে ভেড়ানো  তো মনে হচ্ছে সহজ হবে না!ওদিকে মিতুল এমনভাবে পায়চারী করছে যে মনে হচ্ছে পরমেশদের চেনেই না। ওর এরকম আচরণই অবশ্য করার কথা। এবং পরমেশেরও। না হলে লাল বা হলুদ বাড়ি গিয়ে তো বলে দিতেই পারে যে পার্কে আজ ওদের সঙ্গে একজন চেনা মানুষের দেখা হয়েছে। তখন?কে চেনা মানুষ,কীরকম চেনা মানুষ কমবেশি এইসব জেরার মুখোমুখি দুজনকেই হতে হবে। সত্যি কী ফ্যাসাদেই  না পড়া গেছে!অথচ,কত প্ল্যান করেছিল দিনটাকে নিয়ে!এমনিতে স্কুলে তো কেবল দেখাই হয়,সেভাবে কথা হয় না।কলিগদের যা শ্যেনচক্ষু!ওদিকে ছুটির দিনগুলো  বেশিরভাগ ছুটতেই  চলে যায়। বাড়ির হাজারো কাজ। মিতুলের আবার ছুটির দিনের স্পেশাল রান্না থাকে।এরই মধ্যে এক আধটা ছুটির দিন ঘিরে মিতুলের সঙ্গে লুকোনো ফোনফোনি  হয়।তারপর দুজনেরই চলে ছুটির দিনের কাজ আগেভাগে সেরে নিয়ে বাড়ি থেকে ছাড়া পাওয়ার অজুহাত খাড়া। অজুহাত সফল হ্য়,বিফলও। এবারে কী হবে কেউ জানে না।মিতুল বলেছিল-‘বাইরে আসার সলিড বাহানা  তৈরি করে ফেলেছি ।’-‘কী রকম?’-‘অলকেশকে বলেছি,সহকর্মীর মেয়ের জন্মদিন। খাব না কিন্তু দুপুরের পর যেতে হবে একবার। তুমি লালকে সামলাবে ।’-‘আমি কী বলব?’শুধিয়েছিল পরমেশ।-‘ভাব কিছু।’পরমেশ বলেছিল-‘আমিও সহকর্মীর ছেলের জন্মদিন টন্মদিন কিছু বলে দেব ।’-‘শুভ্রা জানতে চাইবে না,কোন সহকর্মী?’-‘সে সমস্যা তো তোমার অলকেশকে নিয়েও আছে।’-‘না,অলকেশকে নিয়ে অতটা সমস্যা নেই। ও হয়ত নামটাই জানবে।কিন্তু তোমার মুখ থেকে শুভ্রা সম্পর্কে যা জেনেছি তাতে মনে হয়  শুভ্রা তোমার কাছ থেকে সহকর্মীর নাম জেনে,তোমার অন্য সহকর্মীকে ফোন করে ব্যাপারটা সম্পর্কে কনফার্মড হতে চাইবে।কী ঠিক কিনা?’-‘ঠিক।–কিন্তু তাহলে বলাটা কী যাবে?’একটু ভেবেছিল মিতুল । তারপর বলেছিল –‘ব্যাপারটা তোমার ছাত্রদের উপর চাপালে কেমন হয়?শুভ্রা অতদূর নিশ্চয় যেতে পারবে না ।’-‘তা না হয় চালালাম। কিন্তু কী চালাব !’পরমেশ যেন নিজের মনেই উত্তরটা খুঁজছিল।তারপর হঠাত্‍-‘ইউরেকা’ বলে লাফিয়ে উঠেছিল-‘কয়েকটা ছেলে প্রজেক্টের মাল কিনতে আসবে।ওদের একটু হেল্প করতে হবে।–কী চলবে না ঢপটা!’মিতুল হেসেছিল।–‘চলতে পারে।’ঢপটা কিন্তু শেষঅব্দি চলেনি।মিতুলেরটাও নয়। না অবিশ্বাস জাতীয় কিছু নয়।অলকেশের মাছধরার শখ।হঠাত্‍ ওর মাছধরার সঙ্গী চণ্ডীদা নাকি খবর পাঠিয়েছে কোথায় মাছ ধরতে যাবে। আর অলকেশকে কে বাড়িতে রাখে!অতএব লালের দায়িত্ব নিতে হয়েছে  মিতুলকে।ওদিকে শুভ্রার খুড়তুতো দিদি হঠাত্‍ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল।প্রেগন্যান্ট ছিল। ডেট ছিল বেশ কয়েকটা দিন পরে।কিন্তু এ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে যা হয়। ডাক্তার রিস্ক নিতে চাইল না। নার্সিংহোমে আজ সকালেই ভর্তি করাতে হল।দুপুরের পর ওটি।সব কিছু ফেলে শুভ্রাকেও তাই যেতে হয়েছে ওখানে। হলুদকে ওসব যায়গায় নিয়ে যাবার পক্ষপাতী নয় শুভ্রা। সুতরাং পরমেশের উপর দিয়ে গেল হলুদের ভার।শেষ মূহুর্তে ফোনে তাই আবার কিছুটা পরিকল্পনা বদল করতে হল।লাল একটা বল নিয়ে এসেছে।মিতুল কিছু বলে থাকবে। লাল ডাকল হলুদকে। -‘খেলবি?’দুদিকে ঘাড় বেঁকাল হলুদ।পরমেশ হলুদকে কোল থেকে নামিয়ে বলল-‘যাও না!একই ক্লাসে পড় যখন,তখন তো বন্ধু। খেলো গে ওর সঙ্গে!’হলুদ এবার ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল।তারপর দুজনে  মেতে উঠল খেলায়।পরমেশ নিশ্চিন্ত। এবার বসতে হবে। বসার জন্য  পরমেশ এমন একটা বেঞ্চ বাছল,যেখান থেকে লাল হলুদের খেলাটাও দেখা যায় আবার একটু আড়ালও  হয়।মিতুল বেঞ্চে বসেই বলল-‘খেয়েছ কখন?একটু চা খেলে হয় না!’-‘চা!মেঘলা মেঘলা দিন,কফি কেন নয়?’-‘বেশ কফিই হোক ।’কফিওলার কাছ থেকে মিতুল দুকাপ কফি নিল। পরমেশ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল-‘এই নতুন জামাটা পরে কেমন লাগছে কিছু বললে না তো!’মিতুল বলল-‘এই মেরুন রংয়ে তোমাকে কিন্তু বেশ মানায়। তুমি যখন কলেজে পড়তে তখনও তোমার মেরুন রংয়ের একটা শার্ট ছিল। মনে আছে?’-‘তা আর মনে থাকবে না!নাম না লিখে প্রথম প্রেমপত্রে তো তুমি ‘মেরুন যুবক’ বলে সম্বোধন করেছিলে ।’-‘আর তার উত্তরে?’পরমেশ হেসে ওঠে।–‘সবুজ কন্যা ।’-‘সেও তো একটা সবুজ শাড়ির জন্যই ।’-‘তুমি আজও সেই সবুজ শাড়িই পরে এসেছ ।’একটা ভারি নিঃশ্বাস পড়ল পরমেশের। মিতুল ঝাউগাছটার দিকে তাকিয়ে বলল-‘সব প্রেম সফল হয় না,আমাদেরটাও  হয়নি। চুকেবুকেই তো গিয়েছিল।কেন যে আবার তোমার সঙ্গে -’পরমেশ হাসে। -‘বিধাতার ইচ্ছা বোধহয় অন্যরকম। তাই এস এস সি তোমাকে নিয়ে এসেছে আমারই স্কুলে।’-‘আগে যদি জানতাম তুমি এখানে আছ তাহলে নিশ্চয় পুরোনো স্কুল ছেড়ে এখানে,যতই যাতায়াতের সুবিধা হোক,আসতাম না ।’-‘বললাম তো ,সবই পূর্বনির্ধারিত ।’মিতুল হঠাত্‍ রেগে ওঠে।–‘খুব তো কৃষ্ণের বাণী দিচ্ছ। আর কিছুই কি পূর্বনির্ধারিত নেই?’-‘হয়ত আছে।’-‘তবে!’পরমেশ একমিনিট ভাবে। উষ্ণতাহীন দাম্পত্য আর কতদিন বয়ে নিয়ে যাবে!যত কঠিনই হোক শুভ্রার মোকাবিলা ওকে করতেই হবে।গা  ঝাড়া দিয়ে পরমেশ বলে-‘আমি রাজি।’মিতুল বলে-‘অলকেশ তো অফিসের সময়টুকু বাদে বন্ধুবান্ধব,মদ,মাছধরা এসব নিয়েই আছে।আমি ওকে ছাড়লে মনে হয় ও-ও আপত্তি করবে না।’-‘তবে সবার আগে আমাদের একজনকে স্কুলটা চেঞ্জ করতে হবে। দুজনে এক স্কুলে থেকে এসব করা যাবে না।স্কুল চেঞ্জ তুমি করতে পারবে  না।সদ্য এসেছ।আমার দশবছর হযে  গেছে।মিউচুয়ালে পারব। দেখতে হবে ট্রেন বা বাসে এক-দুঘন্টার ডিসট্যান্সে কাউকে পাই কিনা ।’পরমেশের এ কথার পরেই একটা কান্নার আওয়াজ।তাকিয়ে দেখে একটু দূরে মাটিতে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে হলুদ।-‘কী হল?’আশ্চর্য,লাল হলুদের কথা মনেই ছিল না কারও!এত পরিকল্পনায় একবারও উঁকি দেয়নি কেউ।এবার দৌড়ে গেল দুজনেই।লাল বলল-‘বলটা আমার পা  থেকে কাড়তে গিয়ে পড়ে গিয়েছে ।’হলুদ গোঙাতে গোঙাতে বলল-‘মিথ্যে কথা।বলটা ধরার আগেই আমাকে ও ধাক্কা দিয়েছে।’লাল এবার বড় ছেলের মত গলায় বলে-‘বেশ করেছি!আমার বলে খেলছে আর আমাকেই সমানে ‘মোটা’ ‘মোটা’ করে যাচ্ছে!’-‘তুইও তো আমাকে ‘তালপাতার সেপাই’ বলে ডাকছিস বারবার।’হলুদকে মাটি থেকে তোলে পরমেশ।হাঁটু ছড়ে গেছে।,এক্ষুনি ওষুধ লাগাতে হবে।মিতুল লালকে বকে। -‘তোমাকে বলেছিলাম না,পার্কে শান্তভাবে খেলবে।তবু তুমি -’মিতুল লালকে এসব বললেও হলুদের কাছে এগিয়ে এসে কোনও কিছু বলে না। পরমেশ কিন্তু এই অবস্থায় ওর কাছ থেকে হলুদের জন্য আর কিছু না হোক একটু সহানুভূতিসূচক  কথা আশা করেছিল।পরমেশ দেখল হলুদের শুধু হাঁটুই ছড়েনি,ফ্রকটাও কিছুটা ছিঁড়েছে।হলুদের কথাই ঠিক। ছেলেটা মহা পাজি।পরমেশ মুখে কিছু বলে না,কিন্তু কটমট করে তাকায় লালের দিকে।পরমেশের ক্রুদ্ধ চাহনিটা মিতুলও দেখেছে। ও কথা বলল না। লালকে নিয়ে সোজা হাঁটা দিল বাড়ির দিকে।লালের প্রতি পরমেশের দৃষ্টিটা ও হয়ত আশা করেনি।পরমেশ হলুদকে কোলে নিয়ে ওষুধের দোকানের দিকে এগোল।আজ কি কলকাতায় দুই প্রধানের মধ্যে লিগের কোনও খেলা ছিল?পরমেশ শুনতে পেল,রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে কারা বলাবলি করছে –‘মোহনবাগানকে জোর ধাক্কা দিয়েছে ইস্টবেঙ্গল ।’কোন কথা যে কোথায় লাগে!হলুদের হাঁটুটা আর একবার নিরীক্ষণ করে করুণ হাসল পরমেশ।

Leave a Reply