ছোটদের গল্প     হারমোনিয়াম

·          

ঘরে চোর ঢুকেছে। আওয়াজ হচ্ছে খুটখাট। ঘরে রাস্তার আলো এসে পড়ে। তাই চোরকে দেখা কঠিন নয়। কিন্তু ডুগডুগি আর খঞ্জনী ঘুমে কাদা।

হঠাৎ বইয়ের তাকটায় হোঁচট খায় চোরটা। অমনি হুড়মুড় করে পড়ে যায় ওটা। এত জোর আওয়াজ,খঞ্জনী ডুগডুগি দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায়। চোরটাকে দেখে ডুগডুগি চেঁচাতে যাবে এমন সময় চোরটার করুণ গলা-‘চেঁচিয়ো না।আমি কিছু নিচ্ছি না তোমাদের। কিছু নেবার নেইও। যাচ্ছি-’

-‘আরে দিদি,চোর তো বাচ্চা ছেলে একটা।’

-‘তাইতো মনে হচ্ছে।’ বলে খঞ্জনী।

ডুগডুগি ছোট হলেও সাহসী বেশ। উঠে বসে বিছানার উপর। চোরটা তখন জানলা দিয়ে বের হতে যাচ্ছে। ওদের কোনও জানলাতেই শিক নেই। আগে মাটির বাড়ি ছিল।এখন কোনওরকমে পাকা দেওয়াল খাড়া করে উপরে টালি দিয়ে তৈরি হয়েছে বাড়ি। দুটো ঘর। একটাতে মা বাবা।একটাতে ভাইবোন।

ডুগডুগি কিন্তু চোরটাকে বেরোতে দেয় না জানলা দিয়ে। চোরের কোমরটা চেপে ধরে। চোর ডুগডুগির হাত ছাড়াতে জোর চেষ্টা করে। কিন্তু চেষ্টা করেও পারে না। একে তো চোর বেজায় ছোট। তারউপর  ডুগডুগির যোগব্যায়াম করা চেহারা।

চোর রণে ভঙ্গ দিয়ে দাঁড়ায়।-‘কী করতে চাও? মারবে,না পুলিশে দেবে?’

-‘ ভয় নেই,কোনওটাই করব না। বিছানায় এসে বসো। এত ঠান্ডায় এসেছ। আবার  ঠান্ডাতে যাবে কেন?’

চোর ডুগডুগির দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়।-‘সত্যি বলছ,কিছু করবে না?’

এবারে জবাব দেয় খঞ্জনী। বলে-‘ তুমি নিশ্চিন্তে এসে বসো। আমরা একেবারেই বড়লোক নই,সেটা তো টের পেয়েছ। তুমি মনে হয় ভুল করে এখানে ঢুকেছ। যাইহোক এত ঠান্ডায় আর যেয়ো না। বসো  এসে।’ 

চোর বিছানাতে এসে জড়সড় হয়ে বসে। -‘কী নাম তো্মার?’ শুধোয় খঞ্জনী।

-‘ফাউ।’ বলেই ফিক করে হাসে চোরটা।

-‘ফাউ আবার কারও নাম হয় নাকি?’ ডুগডুগি অবাক চোখে তাকায়।

ফাউ বলে-‘ সে আমি জানি না। একটা দোকানে কাজ করতাম। সেখানে মালিক আমাকে এই নামেই ডাকত। তবে আমার বোধহয় অন্য নাম একটা আছে। আবছা মনে পড়ে সে নাম ধরে আমার মা আমাকে ডাকত।’

-‘ডাকত মানে? তোমার মা আর নেই নাকি!’ খঞ্জনী উঠে বসে বিছানার উপর।

ফাউ বলে-‘ হয়ত আছে,হয়ত নেই।’

-‘মানে?’

-‘মানে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম যখন সবে একটু আধটু হাঁটতে পারি তখন। কোথায় বাড়ি কিছুই তো জানতাম না। তারপর এখানে সেখানে। একটু বড় হতে ওই দোকানে।’

-‘তা দোকান ছাড়লে কেন?’

-‘মালিক খুব মারে। এখন স্টেশনে থাকি।আর এইসব করি-’

খঞ্জনীর চোখ ইতিমধ্যেই জলে ভরে গেছে। বলে-‘তোমাকে আর ছাড়ছি না। তু্মি আমাদের সঙ্গেই থাকবে আজ থেকে।’

-‘আমাকে রাখলে তোমার মা বাবা কিছু বলবে না?’

ডুগডুগি বলে-‘আমার মা বাবা খুব ভাল মানুষ। আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলেন না।’

কথায় কথায় ভোর হয়ে এসেছে। ফাউ খঞ্জনীর দিকে তাকিয়ে বলে-‘অনর্থক তোমাদের বোঝা বাড়াতে চাই না। আমাকে এবার যেতে দাও।’

খঞ্জনী চোখ পাকিয়ে বলে-‘গিয়ে দ্যাখ তো তুই!’

ফাউকে জড়িয়ে ধরে ডুগডুগি। বলে-‘কী একটা নাম আছে না তোর? বলছিলি,আবছা মনে পড়ে সে নাম!’

দুজনেই ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’তে নেমে এসেছে। এই আপনার ছোঁয়া ফাউকে যেন দুলিয়ে দেয়।

ফাউ বলে-‘সে নাম শুনেও কিন্তু  তোমরা হাসবে।’

-‘তবু বল।’

-‘হারমোনিয়াম।’ ফিক করে হাসে ফাউ।

এদিকে নামটা শুনেই ডুগডুগি আর খঞ্জনী চেঁচিয়ে ওঠে একসঙ্গে। ‘মা,বাবা শিগগির ওঠো। আমাদের  হারমোনিয়াম ফিরেছে,হারমোনিয়াম।’

ওঘর থেকে ছুটে আসে খঞ্জনীদের বাবা মা। তবলা আর বাঁশি।তখনও অন্ধকার পুরো কাটেনি। আলোটা এসে জ্বেলে দেয় মা। এতবছর পরেও ছেলেকে চিনতে অসুবিধা হয় না। হারমোনিয়ামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে-‘এতদিন কোথায় ছিলি তুই! গঙ্গাসাগরের মেলায় তোকে হারিয়ে কত খুঁজেছি! না জানি কত কষ্টে তোর দিন কেটেছে বাবা।’

হারমোনিয়ামকে হারিয়ে বাবা তবলার মুখ এতদিন তবলা হয়েই থাকত। আজ হাসি ফেরে। বাবা বলে-‘হারমোনিয়াম না হলে বাড়ির বাজনাটা কি পুরো হয়?’

এসময় ডুগডুগি বলে-‘ বাবা হারমোনিয়াম ফিরল, এবার স্কুলটা ফিরবে না?’

বাড়ির সবাই জানে স্কুলটা বাবার কত প্রিয়। বাড়ির সবার নাম এমনিতে তো এরকম নয়! নানান বাজনার নামে শুধু ছেলেময়েদেরই নাম রাখেনি বাবা । স্ত্রীর দিতিপ্রিয়া নামটাও বদলে দিয়েছে বাঁশিতে।

ডুগডুগির কথা শুনে বাবা বলে ওঠে-‘স্কুল আবার আজ থেকেই চালু।’   

কথাটা শুনেই ডুগডুগি ছুটে যায় বাইরে। বাবার বাজনাস্কুলের সাইনবোর্ডটা কাঁঠালগাছটায় উল্টো হয়ে  আছে বহুদিন। সেটা সোজা করে দিয়ে আসে।