চল পানসিঃইতিহাসের স্পর্শ পেতে নালন্দায় ethihaser sporsho pete nalanday
চল পানসিঃইতিহাসের স্পর্শ পেতে নালন্দায় ethihaser sporsho pete nalanday

চল পানসিঃ ইতিহাসের স্পর্শ পেতে নালন্দায়
(ethihaser sporsho pete nalanday)

ইতিহাসের স্পর্শ পেতে নালন্দায়

ছোটবেলায় বাড়ির বড়দের কাছে রাজা-রাজড়ার গল্প শুনে সেই যে ইতিহাস পিছু নিয়েছে আজও তার হাত থেকে ছাড়া পাইনি। কথাটা এভাবে বললাম ঠিকই,কিন্তু এটা আসলে ব্যাজস্তুতি। কেননা,ইতিহাসকে বার বার স্পর্শ করে আমি আনন্দিতই হই না ধন্যও হই।

ইতিহাস ঘিরে এই মুগ্ধতা আমাকে সেবার হাজির করল নালন্দায়। ডিসেম্বরের শেষদিক। তবু ততখানি ঠান্ডা নেই বিহারে। ঘোরার পক্ষে যা বেশ সুবিধাজনকই মনে হল।

আমাদের ছ’জনের দল। হাওড়া থেকে দুন এক্সপ্রেসে প্রথমে গয়া তারপর সেখান থেকে রাজগীর ঘুরে অবশেষে এসে পৌঁছলাম নালন্দায়। তখনও রাজগীর অবশ্য আমরা ত্যাগ করিনি। ঠিক হয়েছে,নালন্দা ঘুরে আবার ফিরব রাজগীরেই। তারপর সেখান থেকে আবার বাড়ির দিকে,বাসে।

রাজগীর থেকে নালন্দা পনেরো কিমি দূরত্ব। কন্ডাক্টেড ট্যুরের বাস রয়েছে। আমরা স্বাধীনভাবে ঘুরতে চাই। তাই ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম।

ভেবেছিলাম নালন্দা দু’তিন ঘন্টায় দেখে নিয়ে আশেপাশের আরও কিছু জায়গা ঘুরে নেব। কিন্তু নালন্দায় গিয়ে একেবারে মজে গেলাম, টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতেই এক প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় তার হারানো ঐশ্বর্যের স্মৃতি দিয়ে অবশ করে ফেলল। 

আমাদের গাইড নালন্দা নিয়ে বই লিখেছেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল একদা দশ হাজার ছাত্র এবং দু’হাজার শিক্ষকের আবাসিক এই শিক্ষামন্দিরের সুনাম শুধু দেশে নয়,দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

চিন,তিব্বত এইসব জায়গা থেকে বহু ছাত্র এখানে পড়তে আসত। হিউয়েন সাঙ এখানে দু’বছর ছিলেন। আর এক পরিব্রাজক ইৎসিং নাকি এখানে দশ বছর থেকে বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করেন।

ধর্ম,দর্শন,জ্ঞান,বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এখানে পড়ানো হত। গাইডের কথা শুনতে শুনতে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম প্রাচীন সেই বিদ্যামন্দিরের রূপ। এখনকার ছাত্র-কলরব মুখরিত শিক্ষানিকেতনের সঙ্গে তার মিল না থাকারই কথা।

ছাত্রদের থাকার ঘর গুলোয় ঢুকে যেন শিহরণ খেলে গেল। সঙ্গীরা একটু অন্যদিকে যেতেই একা একটা ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সন্তর্পণে ঘরে শয়নের জন্য নির্দিষ্ট উচ্চস্থানে গিয়ে বসলাম। নিজেকে মনে হল,’ক্ষুধিত পাষাণে’র সেই গল্প কথক। মনে হল,দেহহীন দ্রুতপদে কে যেন চলে গেল আর যাবার সময় শব্দহীন উচ্চারণে বলে গেল-‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।’ 

কোনও এক পূর্বজন্মে আমিও কি এসেছিলাম এখানে? ওই যে প্রশস্ত আঙিনা যেখানে বসে ছাত্রেরা নিত ধাতুবিদ্যার পাঠ,হয়ত ওখানে আমিও একসময় বসেছি নিয়মিত। নিজের হাতে  তৈরি করেছি  ধাতু পাত্র।

-‘চলো ওদিকটাতে যাই!’ সঙ্গীর ডাকে সম্বিত ফেরে। টাল খাই। মনে হয় যেন হাজার -বারশো বছরের একটা ঘুম অকষ্মাৎ টুটে গেল। মুহূর্তের জন্য হলেও ভীষণ রিক্ত লাগল নিজেকে।

গাইডের মুখে শোনা গেল,গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তের সময়ে নালন্দার যাত্রা শুরু। একশোটির বেশি গ্রামের রাজস্ব দিয়ে চলত এর বিরাট খরচ। পরবর্তীকালে হর্ষবর্ধন,পাল রাজারা এগিয়ে এসেছিলেন নালন্দার সাহায্যার্থে। তাঁদের আমলে  এর সম্প্রসারণ, সংস্কারও হয়। পাল যুগের শেষ থেকেই শুরু হয় নালন্দার অবরোহন। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে এই শিক্ষায়তনের গৌরবময় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটে।

পুরো চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এর বিস্তৃতি। জানা গেল্‌ ১৪ হেক্টর জমি জুড়ে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। খনন কার্যের ফলে এগারোটি মঠ,ছ’টি বড় মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। 

প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে রয়েছে নালন্দা আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম। সেখানে গিয়ে নালন্দা রাজগীরে উৎখননে প্রাপ্ত নানা মূর্তি,সিল,পাত্র ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় ঘটল।

প্রায় সারাদিন কাটিয়েও ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। বুদ্ধ,মহাবীরের পদধূলি ধন্য নালন্দাকে তবু বিদায় জানাতেই হল। চড়ে বসলাম আমাদের গাড়িতে। আর মনে মনে বললাম-‘নালন্দা,আবার আসব!’

Product

  •  

Leave a Reply