চল পানসিঃ মায়াপুর ভ্রমণ

 

Ami Mishuk | আমি মিশুক চল পানসিঃ মায়াপুর ভ্রমণ

চল পানসি

মায়াপুর ভ্রমণ          

নদিয়া জেলার লোক হয়েও এখনও মায়াপুর দেখনি! বয়স্ক সহকর্মীর এই শ্লেষ সেদিন এতটাই তাতিয়ে দিল যে ঠিক করলাম,আর দেরি নয়। সামনে যে কোনও একটা ছুটির দিন পেলেই বেরিয়ে পড়ব মায়াপুরের উদ্দেশে।

মায়াপুর  আমার বাড়ি থেকে খুব দূরের রাস্তা নয়। ট্রেন আর বাস মিলিয়ে ঘন্টা দেড়েকের পথ। কিন্তু একদিনের সফর। ট্রেন বাস করলে বেড়ানোয় কাটছাঁট করতে হতে পারে। সেজন্য  ভাড়া করা চারচাকার সওয়ারি হওয়াই সাব্যস্ত হল।

মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরের কাছে গাড়ি পার্কিং-এর  ব্যবস্থা আছে। সেখানে গাড়ি পার্কিং করে টো টো নিয়ে বেরোলাম মায়াপুরের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে। ইতিহাস ভালবাসি। তাই প্রথমেই গেলাম বামুনপুকুর বাজার ছাড়িয়ে বল্লাল সেনের নামাঙ্কিত ঢিপিটি দেখতে। স্থানীয় লোকের কথায় এটি বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। ঐতিহাসিকরা অবশ্য নিশ্চিত হতে পারেননি আসলে এটি কী ছিল । অন্তত তিনবার এই ইমারত  নতুনভাবে নির্মিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকদের অনুমান। ঢিপি-পার্শস্থ সাইনবোর্ড থেকে জানা গেল  গত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে এখানে খননকার্য শুরু হয়। বেশ মনোরম,পরিচ্ছন্ন এলাকা। অনেকটা জায়গা জুড়ে এই বল্লাল ঢিপি। অনেকক্ষণ সময় এখানে কাটানো হল। মধ্য নভেম্বরেও রোদ বেশ প্রখর। সেই প্রখর রোদেও  দলের ছোট সদস্যেরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে খুব মজা করল এখানে।

বল্লাল ঢিপি থেকে এবার গন্তব্য চাঁদ কাজীর সমাধিক্ষেত্র। চৈতন্য-চাঁদ কাজী বিরোধ সকলেরই জানা  বিষয়। এখানে প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল সমাধিক্ষেত্রে একটি সুবৃহত্‍ গোলক চাঁপার গাছ। এটি নাকি চৈতন্যদেবেরই রোপণ করা।

চাঁদ কাজীর সমাধিক্ষেত্র থেকে আমরা এলাম শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য মঠ-এ যা চৈতন্যদেবের মাসির বাড়ি নামে পরিচিত। খুব সামান্যই পথ। টোটোতে উঠে বসতে না বসতেই বলা  যায় চলে এলাম। মঠের ভিতরে  খুব শান্ত পরিবেশ। গৌড়ীয় মঠগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে প্রাচীন। মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে মঠ প্রতিষ্ঠাতা ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুরের সমাধি। রয়েছে রাধা কুণ্ড আর শ্যাম কুন্ড। সেখানে   মাছেদের কেলি দেখার মত। অনেকেই মুড়ি ছিটিয়ে মাছেদের কাছে ডেকে আনছেন। এ ব্যাপারে আমাদের দলের  দুই খুদে সদস্যেরও প্রবল উৎসাহ। সঙ্গে মুড়ি ছিল না। কিন্তু ওদের উৎসাহকে মর্যাদা দিতে বাইরে থেকে কিনে আনা হল এক ঠোঙা মুড়ি।  

চৈতন্য মঠ থেকে টোটো এল চৈতন্যের জন্মস্থানে,যা যোগপীঠ নামে পরিচিত। চৈতন্যদেবের  জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মায়াপুর না নবদ্বীপ কোনটি? নরহরি কবিরাজের ‘ভক্তি রত্নাকর’ গ্রন্থে সরাসরি বলা  আছে–‘নবদ্বীপ মধ্যে মায়াপুর/যথা জন্ম হইল শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর।’ সুতরাং জন্মস্থানের ব্যপারে মায়াপুরেরই পাল্লা ভারি। যোগপীঠে রয়েছে শিশু নিমাইয়ের সঙ্গে তাঁর পিতামতার বিগ্রহ,রয়েছে প্রাচীন  গোবিন্দ মন্দির। একটি মত অনুযায়ী নিমগাছের তলায় জন্ম হয় বলে শচীদেবী ছেলের নাম দেন নিমাই। এখানেও একটি নিমগাছ রয়েছে। এটি  চৈতন্যদেবের জন্মস্থানের নির্দেশক হিসাবে পূজিত।

সবশেষে মায়াপুরের অন্যতম আকর্ষণ ইসকনের চন্দ্রোদয় মন্দির। পুরোটা ঘুরে দেখতে অনেক সময় লাগল।মন্দিরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল সামনের বাগানে বাহারি ফুলের শোভা। ঘুরে ঘুরে  দেখলাম  ইস্কনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদের পুষ্পসমাধি মন্দির,ভজন কুটির,চক্র ভবন,গদা ভবন,নামহট্ট ভবন,গোশালা ইত্যাদি। মন্দিরে প্রদর্শিত শ্রী কৃষ্ণের জীবন আখ্যান মুগ্ধ করল। এখানে দুপুরে স্বল্প মূল্যে ভোগের ব্যবস্থা আছে।আমরা মায়াপুরের অন্যান্য জায়গাগুলো দেখতে গিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার বাইরেই সেরে নিয়েছি। তাই খাওয়ার পাট আর নেই। এখন ইচ্ছে সন্ধ্যারতি দেখে বেরোব। তাই মন্দির পরিদর্শনের পরে ওখানে  কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সন্ধ্যারতি দেখার লাইনে।

 সন্ধ্যারতি শেষে কিছু কেনাকাটা। তারপর রওয়ানা। ঘড়িতে এমনকিছু বাজেনি।কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে অনেক রাত। ওদিকে চাঁদ উঠেছে উর্দ্ধ গগনে। গাড়ির পিছনের কাচ দিয়ে শহরটাকে আর একবার দেখি নিই। চাঁদের আলোয় মিঁয়াপুর থেকে নাম পাল্টে একদা মায়াপুর হওয়া জনপদ কেমন মায়াময় লাগে।

কীভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে নবদ্বীপ ধাম পর্যন্ত  ট্রেনে এসে ঘাট পেরিয়ে মায়াপুর যাওয়া যায়। সড়ক পথে কৃষ্ণনগর হয়েও যাওয়া যাবে।

কোথায় থাকবেন

ইস্কন মন্দিরের অতিথিশালা আছে। বাইরেও রয়েছে অনেক হোটেল।