ভ্রমণঃ অক্ষয়বট দর্শন

যে গাছের নিচে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার অমৃতবাণী শ্রবণ করান,সেই গাছের উত্তরপুরুষকে চাক্ষুষ করব,এ ইচ্ছা বহুদিনের।সেবার পুজোর ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম কুরুক্ষেত্রের উদ্দেশে।
হাওড়া থেকে অমৃতসর এক্সপ্রেসে এসে নামলাম আম্বালায়। তখনও সকাল হয়নি। তবু যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সি,অটো সবই স্টেশনের বাইরে মজুত। একটা অটোই ভাড়া করা হল। শীত আসতে ঢের দেরি,তবু বেশ শীত করছিল আমাদের। অটো যখন কুরুক্ষেত্রে ঢুকছে,তখন সকাল হয়েছে। কুরুক্ষেত্রে ঢোকার মুখের প্রবেশদ্বারে নজরে পড়ল রথের সেই ভাস্কর্য যেখানে ধরা আছে,যুদ্ধবিমুখ অর্জুনকে নিয়ে সারথি কৃষ্ণের গীতার অমৃতবাণী পরিবেশনের দৃশ্য।
প্রথমেই মন নত হয়ে এল। এরপর হরিয়ানার এই ক্ষুদ্র শহরে প্রবেশ করে দেখা গেল, এই রথের ভাস্কর্য রয়েছে অনেক জায়গাতেই। বোঝা গেল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মধ্যে বিখ্যাত সেই হৃদয় পরিবর্তনকেই আধুনিক কুরুক্ষেত্র বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে চায়। উঠলাম এক ধর্মশালায়।সেখানে লোটাকম্বল রেখে ফ্রেস হয়ে বেলা দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম জ্যোতিসরের উদ্দেশে। জ্যোতিসর হল সেই জায়গা যেখানে কৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার অমৃতবাণী শ্রবণ করান বলে কথিত।
আবার একটা অটো করা হল। যাবার পথে দেখে নিলাম ব্রহ্মসরোবর। ব্রহ্মসরোবরের স্বচ্ছ জলে মাছেদের কেলি দেখলাম অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে। ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিস্কুটও খাওয়ানো হল মাছেদের। সূর্যগ্রহনের সময় এখানে স্নানের সুন্দর ব্যবস্থা আছে। পুরো সরোবরটাই বাঁধানো। ব্রহ্মসরোবরের বাঁধানো পাড় দিয়ে পুরোটা ঘোরা বেশ সময়ের ব্যাপার। আমরা কিছুটা গেলাম তবু।
অটোতে চালক ভাইয়ের কাছে জেনে নিলাম,কুরুক্ষেত্রের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান সম্বন্ধে। জানা গেল,গীতার জন্মভূমিতে রয়েছে মা কালীরও অধিষ্ঠান। হরিয়ানার একমাত্র সিদ্ধপীঠ ভদ্রকালী মন্দির। চালক ভাইয়ের মুখেই শোনা গেল, জ্যোতিসরে কুরুক্ষেত্র বিকাশ বোর্ড যে সুন্দর ঝিল বানিয়ে দিয়েছে তার কথাও।
জ্যোতিসর পৌঁছলাম বেলা বারোটা নাগাদ। দূর থেকেই আওয়াজ আসছিল মাইকের। কাছে গিয়ে বোঝা গেল,ধর্মকথার আসর বসেছে। যে গাছের উদ্দেশে আসা সে গাছ এখানে প্রসিদ্ধ অক্ষয়বট হিসাবে।
কিন্তু সেই পবিত্র অক্ষয়বটের সামনেটায় প্রবেশপথ জুড়েই চলছে ধর্মকথা। গাছের কাছে তাহলে কি যাওয়া যাবে না? ওখানকার শ্রোতারা সহযোগিতা করলেন। দূরে জুতো খুলে এসেছিলাম। খালি পায়ে তাঁদের সতরঞ্চির গা ঘেঁষে পৌঁছে গেলাম অক্ষয়বটের অন্য পাশে।
পুরো গাছটাই রেলিং দিয়ে এমনভাবে ঘেরা যে একটা পাতাও ছোঁয়া যাবে না। যে গাছের পূর্বপুরুষ,গীতার অমৃতবাণী পরিবেশনের সাক্ষী,খুব ইচ্ছে করছিল তার একটা পাতা সঙ্গে করে আনতে। তা না পেরে ফটো তোলা হল।। চারপাশের রেলিং-এ দেখলাম মনস্কামনার্থে সুতো বেঁধেছেন অনেকে। চারপাশে ঘোরা হল। পরিচ্ছন্ন বাঁধানো চত্বর। কিছুক্ষণ বসলাম সবাই। মনে পড়ল,মহাভারতের কথা। ‘ ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ…’। আর তার পরেই তো অর্জুনের মনের সেই আন্দোলন, আর গীতার সূচনা! অক্ষয়বটের দিকে তাকিয়ে বেশ একটা শিহরণ অনুভব করলাম।