Blog
ভ্রমণ তাজমহল দর্শন

তাজমহল দেখব,এ সাধ বহুদিনের। সেবার পুজোর ছুটিতে লক্ষ্মীপুজো মিটতেই আমরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়েছিলাম আগ্রার উদ্দেশে। শিয়ালদহ আজমির এক্সপ্রেসে টিকিট। কিন্তু শুরুতেই বিধি বাম। শিয়ালদহ থেকে তে্রো ঘন্টা দেরি করে ছাড়ল ট্রেন। তারপরও বিপদ কাটল না। দেখলাম যে কোনও কারণেই হোক ট্রেনের গতি বেশ মন্থর। ট্রেনের যাবার কথা ছিল গয়া হয়ে,কিন্তু রেলপথের কী গন্ডগোল, ট্রেন চলল পটনা হয়ে। যখন আগ্রা পৌঁছলাম তখন ট্রেনের দেরির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চব্বিশ ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট। চার জন বড়োর সঙ্গে দুটো শিশু। একজন ছয়,একজন দুই। এত বিলম্বেও কিন্তু ওরা কাবু হয়নি। ছোটটির কাছে তো ট্রেনটা ওর ভাষায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘ট্রেনবাড়ি’।
হাতে সময় রয়েছে। তাই একদিন দেরির জন্য আমরা বড়রাও খুব একটা বিচলিত হইনি। এরকম তো হতেই পারে বলে মেনে নিয়েছি। আগে থেকে হোটেল ঠিক ছিল। রাত্রিটা হোটেলে কাটিয়ে,পরদিন বেরিয়ে পড়লাম তাজমহল দেখতে।
হোটেল থেকে খুব বেশি দূর নয়। অটোতেই পৌঁছে গেলাম তাজমহল। লম্বা টিকিটের লাইন। কিন্তু দ্রুতই মিলল টিকিট। গাইড আগেই আমাদের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। এবার তাঁরই সূত্রে এল ফটোগ্রাফার। গাইড বললেন,ফটো সব আগেই তুলে নিন। তাহলে বেরোবার সময় নিয়ে বেরোতে পারবেন। আমরা রাজি হলাম না। যা দেখতে এসেছি তা না দেখে নিজেদের ফটো তোলায় মত্ত হবার ইচ্ছে আমাদের নেই। ফটোগ্রাফার ফোন নম্বর দিয়ে বলে গেলেন,আমাদের সময় হলে তাঁকে যেন একবার খবর দেওয়া হয়। অনুরোধ করলেন অন্য ফটোগ্রাফার না নেবার জন্য।
গাইডের পিছু পিছু আমরা এগিয়ে চললাম। যে তাজমহল এতদিন দেখেছি ক্যালেন্ডারে, বইয়ের পাতায়, এখন সেই তাজমহলের একেবারে সামনে। স্বপ্ন না বাস্তব! রোমাঞ্চ সারা শরীরে।
গাইড বোঝাচ্ছিলেন,কোথা থেকে কী পাথর আনা হয়েছিল,নির্মাণ কাজের জন্য কতগুলো হাতি লেগেছিল এবং কত শ্রমিক,কত সময় লেগেছিল তৈরি করতে ইত্যাদি খুঁটিনাটি তথ্য। আমি শুনছিলাম,আবার শুনছিলামও না। আসলে তাজমহলের অপার্থিব সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝেই গাইডের কথা থেকে ছিটকে যাচ্ছিলাম। কয়েকশো বছর আগের এক পত্নীনিষ্ঠ বাদশাহের এই অসামান্য কীর্তি দেখে দলের অন্য সঙ্গীদেরও আমারই মত অবস্থা।
বাইরে থেকে কিনে নিয়েছিলাম পায়ে পরার প্লাস্টিক আবরণী। এবার জুতোর উপর তা চাপিয়ে উঠে পড়লাম তাজমহলের উন্মুক্ত আঙিনায়। পার্শ্বস্থ মসজিদটিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে দাঁড়ালাম তাজমহলের সমাধিকক্ষের ভিতরে প্রবেশ করবার লাইনে। একসময় ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে কিন্তু দু দন্ড দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। চলতে চলতে দেখা,আবার দেখতে দেখতে চলা। ভিতরে ফটো তোলা বারণ। কিন্তু শুনছে কে? অনে্ককেই ওই অবস্থাতেও ছবি তোলার জন্য মোবাইল তাক করতে দেখা গেল।
সমাধিকক্ষ থেকে বেরোলাম। আবার বাইরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। নীচে যমুনা। কিন্তু একী করুণ অবস্থা তার! বন্দী অবস্থায় শোনা যায় শাজাহান এই যমুনার জলে তাজমহলের প্রতিবিম্ব দেখে বন্দীত্বের বেদনা কিছুটা প্রশমিত করতেন। সে-যমুনার পলিতে জর্জরিত হতশ্রী দশা দেখে খারাপ লাগছিল।
নিচে নেমে প্লাস্টিকের আবরণী জুতো থেকে ছাড়িয়ে ফেলা হল আবর্জনা-পাত্রে। চারবাগ বাগান আর মাঝখানে উঁচু জলাধার সব জায়গাই ঘুরে ফিরে দেখলাম। উঁচু জলাধারের সামনে লম্বা জলাধারে তাজমহলের প্রতিবিম্ব। একজন সে-ছবি মোবাইল-বন্দী করল। কিন্তু আমরা যে তাজমহলে এসেছিলাম তার কিছু পাথুরে প্রমাণও তো রেখে দিতে হবে। তাজমহলকে সামনে পিছনে রেখে কিছু ছবি তোলা হয়েছিল মোবাইলে। আরও কিছু তোলা হল। ফোনে ডাকা হল সেই ফটোগ্রাফারকে পাকা হাতে আমাদের কিছু ছবি তুলে দেবার জন্য।
ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবু প্রেমের এই স্মৃতিসৌধ থেকে একসময় ফিরতেই হল। ফেরার সময় বার বার মনে চলে আসছিল,রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘শা-জাহান’ কবিতার সেই অবিস্মরণীয় লাইনগুলি-‘এক বিন্দু নয়নের জল/কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/এ তাজমহল।…’