চোর
চোর

Ami Mishuk | আমি মিশুক চোর

সাড়ে ছশো স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাটে হরেক সমস্যা। তার মধ্যে একটা বড় সমস্যা, ছোটদের কাছ থেকে ওদের অনুপযোগী সব কথা আড়াল করা। ছোট জায়গা, না  চাইলেও বড়দের কিছু কথা ওদের কানে চলে যাবেই।

এই যেমন কদিন আমরা খুব আলোচনা করছিলাম চোর নিয়ে। ভোট আসছে, ভোট দিতে হবে। তাই একটু দেখেশুনে নেওয়া আরকি।

ছেলে গুগলমিটে ক্লাশ করছে। অঙ্ক ক্লাশ। অঙ্ক ওর পছন্দের বিষয়। তাই সেদিন আমাদের আলোচনা ক্ষোভে-বিক্ষোভে নিশ্চিন্তেই উপরে উঠে যাচ্ছিল মাঝেসাঝে। নিজেদের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী মানের অধঃক্রমে চোরদের সাজাতে গিয়ে হিমশিমও খাচ্ছিলাম দুজনে।

-‘ভোট কি দিতেই হবে?’

-‘এ আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার প্রয়োগ না করলে হয়!।

আলোচনা আমাদের দুজনের মধ্যে যখন এমন একটা নিরালম্ব অবস্থায়, সেসময় ছেলের গুগল মিট শেষ হয়। আমি আলোচনা ছেড়ে ছুটে গিয়ে আমার মোবাইলটা হস্তগত করি। এক ঘন্টা মোবাইল থেকে দূরে থাকা আজকাল কী যে কঠিন ব্যাপার! মনে হয় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবীর কত কিছু এই ঘন্টায় হাতছাড়া হয়ে গেল ভেবে আমার ব্রেন সারাদেহে হতাশার সিগন্যাল পাঠাতে থাকে।

মোবাইল নাড়তে নাড়তে ভোট কী, কাকে ভোট সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আরও গুলিয়ে যায়।

অঘটনটা ঘটে রাত্রি নটা নাগাদ। হারিয়ে যায় আমার মোবাইল।

সাতটার সময় বাজারে গিয়েছিলাম। বাইরে গেলে মোবাইল নিয়ে  যাই না। চার্জে বসিয়ে গিয়েছিলাম ওটাকে। ছেলের মা  এসময় টিভিতে সিরিয়াল দেখে। আজও দেখেছে। তাই এই দু’ঘন্টা বাড়ির একমাত্র অ্যান্ড্রয়েড বিশ্রামেই ছিল।

কিন্তু নটার সময় ফিরে দেখি মোবাইল বেপাত্তা। ব্যাপক খোঁজাখুঁজি হল। ছেলে সাড়ে সাতটায় উপরের  ফ্ল্যাটে মুখার্জিবাবুর কাছে ইংরেজি পড়তে যায়। মোবাইলটা ও-ই কিছু করল নাকি! আর একটা সন্দেহও মাথা চাড়া দেয়।

 নীলের পড়াশোনা যাতে ভাল ভাবে ওর মা দেখভাল করতে পারে সেজন্য রান্নার মাসি রাখা হয়েছে বেশ কিছুদিন। বিকেলেও মাসি আসে্। রুটি তরকারি করে দিয়ে যায়। আজ এসেছিল নাকি রাত্রি পৌনে আটটা নাগাদ। তাহলে কি রান্নার মাসিই…!

-‘তোমার ছোট ফোনটা থেকে একবার ফোন করে দেখো তো?’ আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

-‘ফোন করার ব্যবস্থা করেছ কি ওটাতে? কতবার বলছি! ইনকামিং বন্ধ আজ তিনদিন…’ ও-পক্ষের   রুক্ষ জবাব যেন তৈরিই হয়ে ছিল। চলে আসে যথাসময়ে।

ছেলে ফিরতে দশটা। মোবাইলটা সত্যি কোথায় গেল?

-‘মনের ভুলে বাইরে নিয়ে যাওনি তো?’

-‘বাইরে?’ রি-উইন্ড করি বেরোনোর আগে থেকে পুরো বেরোনোটা। নাঃ, মোবাইল তো রেখেই  গিয়েছিলাম।

-‘নীল, ওর মুখার্জিস্যরকে কোনও কিছু দেখাতে নিয়ে যায়নি তো! দামি ফোন, টেনশন হচ্ছে খুব!’

-‘নীল উপরে নিয়ে গেলে বলত। আমার মনে হচ্ছে তুমি বাইরেই নিয়ে গিয়েছিলে ওটা। আর বাইরেই খোয়া গেছে। নীলের কাল আবার গুগল মিট আছে। এখন কী হবে?’ ভেঙে পড়ে ছেলের মা।

বাইরে মোবাইল না নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি কনফার্মড। নীল যদি না নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ওটা চুরি হয়েছে ফ্ল্যাট থেকেই। আর চোর…। এটা ভাবতে গিয়েও কিন্তু বেশ সমস্যায় পড়ি। মিনতিদি কাজ করছে ছ’মাস। একদিনও তো সেরকম কিছু…

নীল ফেরে দশটায়।

দুজনে হামলে পড়ি।–‘ মোবাইলটার ব্যাপারে কিছু জানিস? পাওয়া যাচ্ছে না।’

 নীল হাসতে থাকে।–‘তার মানে তুইই কিছু করেছিস?’ আমার গলা সপ্তমে ওঠে।

নীল খাটের নিচে বালিশ লেপ রাখার জায়গা খুলে মোবাইলটা বের করে।

অনেক কষ্টে আমি রাগ দমন করি। কিন্তু ওর মা ঘা-কতক বসিয়ে দেয় নীলের পিঠে।–‘বদমাস ছেলে, আমাদের একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ল! এই বয়সেই এত শয়তানি, বড় হলে এ কী হবে গো!’

নীল আমাদের রাগ দেখে থম মেরে গেছে। আমার রাগ কিন্তু তবু যায়নি। ওর দিকে কড়া চোখে চেয়ে শুধোই-‘এমন কেন করলি, বল!’

মাথা নীচু নীলের। আস্তে আস্তে ও বলে-‘দুপুরে তোমরা বলছিলে চোরদের তোমরা দেখতে পার না। সেজন্যই মোবাইলটা সরিয়ে রেখেছিলাম।’

-‘মানে!’

-‘আগে যে সময়টায় মাঠে খেলতাম, এখন সে সময়ে গুগুল মিট। তারপর বাবা আগে আমার সঙ্গে কত খেলা করত, বেড়াতে নিয়ে যেত। এখন বাবা গুগলমিটের সময়টা বাদে মোবাইল নিয়ে থাকে।  মোবাইলটা আমার বিকেলের খেলা চুরি করেছে, আমার কাছ চুরি করেছে বাবাকেও। তাই ভাবলাম, চোরটাকে-’

আমরা দুজনেই চুপ। কত চোর যে কত জায়গায় ঘাপটি মেরে থাকে! একটা চোর যে এখানেও…

-‘ছোট মোবাইলটায় কাল টাকা ভরে আনব। আর দেখি আমিও একটা ছো্ট মোবাইল-’ নীলের দিকে তাকাতে পারি না আমি।

নীলের মা বলে- ‘ নীলের বিকেলের খেলাটা বেশিদিন ও চুরি করতে পারবে না। স্কুল খুলে গেলেই বিকেল ফিরবে। কিন্তু বাবাকে চুরি করে নিলে সে ক্ষতি তো আর-’

যেটা ছাড়া আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, বড় ক্ষতির আশঙ্কায় এখন সেটার দিকে আমি অবজ্ঞার চোখে তাকাই।

খাওয়া আর শোওয়ার মাঝখানে নীল মোবাইলটা নিয়ে আরও একটা কান্ড করে। একটা ছোট কাগজে ‘মোবাইল ফর অনলাইন ক্লাস অনলি’ লিখে ওটার কভারে আঠা দিয়ে সেঁটে দেয়।

 

 

Leave a Reply