ছোটদের গল্পঃ পুজোর মালা

ছোটদের গল্প

পুজোর মালা

 

খবরটা বেশ কয়েকদিন আগেই কানে এসেছিল। কিন্তু তাতে খুব একটা গুরুত্ব দেননি বরদাবাবু। গুরুত্ব দেবেনই বা কেন? বাড়ির গেটের ঠিক আগে দু পাশে শিউলিগাছের তলা যে শরৎ পড়তেই ফুলে ফুলে ঢাকা। বাজারে যদি ফুল না ও পাওয়া যায়, এ দিয়েই তো কাজ চালানো যাবে। ৷

নিশিকান্ত এ বাড়ির একমাত্র পুরোনো কর্মচারী। তালপুকুরে ঘটি না ডুবলেও দুর্গাপুজোর মতো কিছু পুরোনো ঐতিহ্য যেমন এ বাড়িতে টিকে আছে,তেমনি টিকে আছেন নিশিকান্তও। বন্যার জন্য আশেপাশের বাজার থেকে ফুলের উধাও সংবাদ তিনিই বয়ে এনেছেন। বরদাবাবুর মত শিউলিগাছ দুটোর ভরসায় নিশিকান্তও রয়েছেন,কিন্তু সে বাবদে তাঁর চিন্তাও কিছু কম নেই।
বিশেষ করে ভয়, মল্লিকবাড়ির ছোট ছেলেটাকে। ও একটা দল গড়েছে। সারাদিন শুধু পাড়া জুড়ে ওদের দুষ্টুমি। কারও গাছের ফলপাকুড় ওদের জ্বালায় ঠিকঠাক রাখার জো নেই। এ বাড়িতে এখনও ঢোকেনি,কিন্তু কখনও ঢুকবে না তা বলা যায় না। এবারে ফুলের যা অভাব,তাতে ওদের পাডার বারোয়ারির জন্য ওরা এবারে এখানে ঢুকতেই পারে।সেক্ষেত্রে এ বাড়ির পুজোর ফুল নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে।

বরদাবাবু সন্ধেয় নিশিকান্তকে ডেকে খোঁজখবর নিলেন পুজোর ব্যবস্থাদির ব্যাপারে। নিশিকান্ত বললেন-‘সব ঠিক, তবে-‘
-‘তবে কী’?

নিশিকান্ত ফুলচুরির আশঙ্কার ব্যাপারটা বরদাবাবুর কানে তুলতে গিয়েও তুললেন না। এখনও পুরোনো মেজাজটা রয়ে গেছে। আর সে মেজাজের সঙ্গী হবার জন্য ঘরে একটা পুরোনো বন্দুকও ঝোলানো আছে। বলা যায় না, উনি হয়ত বন্দুক নিয়েই সারারাত বসে গেলেন ওখানে। ছেলেগুলো সত্যিসত্যি যদি ফুলচুরি করতে আসে তবে রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়।
বরদাবাবুর কথার উত্তরে নিশিকান্ত পাংশু মুখে শুধু বললেন -‘ফুল’।

বরদাবাবু বললেন -‘ফুল যে অমিল, তা জানি তো। কিন্তু শিউলির গাছ দুটো তো আছে’।
নিশিকান্ত আবারও নিজের দুশ্চিন্তাটা বরদাবাবুর কাছে গোপন করলেন।
তারপর বরদাবাবুকে কিছু না জানিয়ে পঞ্চমীর রাতটা একরকম ফুলগাছ পাহারা দিয়েই কাটিয়ে দিলেন। দেখা গেল ওঁর অনুমান ভুল। ফুলচুরি করতে কেউ এল না। ষষ্ঠীর রাতটাও প্রায় না ঘুমিয়েই পার করলেন নিশিকান্ত। কিন্তু না, সেদিনও ফুলচুরির ঘটনা ঘটল না।

নিশিকান্ত সপ্তমীর রাতে ভাবলেন, পুরোটা সময় না জেগে রাতের প্রথম দিকটায় ঘুমিয়ে নেবে্ন। কারণ, ওঁর অনুমান, ফুল চুরি হলে হবে ভোরের দিকে। অ্যালার্ম দিয়ে নিশিকান্ত ঘুমোলেন। গত দুদিনের অনিদ্রা। অ্যালার্ম বাজল ঠিক সময়েই, কিন্তু নিশিকান্তর ঘুম ভাঙল না। যখন ঘুম ভাঙল, দ্রুত ছুটে গিয়ে দেখলেন,অঘটন ঘটে গেছে।
এখন উপায়? অষ্টমীর পুজো বলে কথা! বরদাবাবু ফুলচুরির ঘটনাটা শুনে রেগে আগুন। কারা চুরি করতে পারে, সে নিয়ে নিশিকান্তর অনুমানটা জেনে উনি থানায় যাবার জন্য তৈরী হলেন।
থানা পুলিশ বড় খারাপ জিনিস। আর তাছাড়া ওঁদের সে প্রতিপত্তিও নেই। পুজোটাই চলছে নমো নমো করে। থানা পুলিশ করা মানে শত্রু বাড়ানো।

নিশিকান্ত অবশ্য অন্য কথা বললেন – ‘ঠাকুরের ফুল যদি চুরি যায় সে-ও তো ঠাকুরেরই ইচ্ছা। আমরা কী করতে পারি!
নিশিকান্তর কথাটা শুনে কি মনে হল, দাঁড়িয়ে গেলেন বরদাবাবু। বললেন – ‘ঠিক আছে। ঠাকুরের যখন ইচ্ছে, তখন মায়ের গলা আজ খালিই থাকুক। পুজোর অঞ্জলিটা বেলপাতাতেই হোক। আর হ্যাঁ, ছেলেগুলো মন্ডপের সামনে এলে আমাকে দেখিয়ে দিয়ো।
অষ্টমীর পুজো শুরু হতেই নিশিকান্ত দেখলেন, মল্লিক বাড়ির ছোট ছেলে দলবল নিয়ে, নতুন জামাপ্যান্ট পরে মন্ডপে এসেছে। ওদের বারোয়ারি পুজোর ঢের দেরি, তাই হয়ত ঢাক বাজতে ছুটে এসেছে এখানেই। দলটা ছোট নয়। প্রায় ন দশটি ফুটফুটে কিশোর। সবারই বয়স নয় থেকে দশ। কেবল দলপতিটিই একটু বড়। মনে হয় বারো।
নিশিকান্ত ছেলেগুলোর দিকে বার বার চাইছেন দেখে, বরদাবাবু কিন্তু বুঝে ফেললেন সব। ‘- এরাই কি?’ নিশিকান্তকে ইশারায় শুধোলেন।

আর ঢাকতে পারলেন না। -‘হ্যাঁ, এরাই।’ ঘাড় নেড়ে মৃদু স্বরে জানালেন নিশিকান্ত।
বরদাবাবু ছেলেগুলোর দিকে ভাল করে দেখলেন। তারপর বললেন – ‘সব কটাকে ধরো, আমি আসছি। ‘
তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি। তবু মনিব। জনাচারেক লোকের সাহায্য নিয়ে নিশিকান্ত ধরলেন সব কটাকে।
বরদাবাবু বাড়ির ভিতর থেকে একটা বেত নিয়ে এলেন। নিশিকান্ত বাধা দিয়ে বললেন -‘পুজোর সময় মারামারি ‘
-‘ তুমি থামো।-এই তোরা আমার শিউলি গাছের ফুল চুরি করেছিস?’ বরদাবাবু স্থির চাইলেন ওদের দিকে।
সব কটা নিশ্চুপ।কাঁচুমাচু। বোঝা যাচ্ছে অপরাধী ওরাই।

বরদাবাবু বেত দিয়ে বাতাস কাটতে কাটতে বললেন, – ‘তোরা সবাই হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে দাঁড়া ঠাকুরের চারপাশে।’
বরদাবাবুর নির্দেশ মেনে ওরা সবাই সিংহবাহিনী দুর্গার মুর্তি ঘিরে দাঁড়াল হাত ধরাধরি করে।
বরদাবাবু বললেন -‘পুজো না হওয়া অব্দি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাক তোরা। ক্লান্ত লাগলে সবাই মিলে বসেও যেতে পারিস। কিন্তু এখান ছেড়ে যেতে পারবি না মোটেই। ফুল চুরির এটাই শাস্তি তোদের।’

ওরা অন্য শাস্তির ভয় পেয়েছিল। পরিবর্তে বরদাবাবুর এমন শাস্তি পেয়ে মনে হল, ওদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে।
পুজো চলছে। মুর্তি ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছেলেগুলো। বরদাবাবু নিশিকান্তর দিকে চেয়ে বললেন -‘ঠাকুরের এত সুন্দর মালা শিউলি ফুলেও হত কি!’