Blog



প্রিয় লেখক
কবি ও সমালোচক মোহিতলাল
হার্টের ্ যন্ত্রণা। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। কিন্তু দৃঢ়চেতা মানুষটি যন্ত্রণা নিয়েও অবিচল। চোখেমুখে নেই কোনও ভয়ের চিহ্ন। সেদিন সকালে আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল কালো মেঘে। তা দেখে অসুস্থ শরীরেও উঠে বসেছেন। গুনগুন করে গেয়েছেন,’বহুযুগের ওপার থেকে আষাঢ় এল আমার মনে।’
মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে নার্স এলেন নাড়ি দেখতে। হাতটা নার্সের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন,’মজেসে চল রহে।’ তাঁর শেষ কথা।
অকুতোভয়,দৃঢ়চেতা এই মানুষটির নাম মোহিতলাল। মোহিতলাল মজুমদার। ১৮৮৮-এর ২৬ অক্টোবর থেকে ১৯৫২ এর ২৬ জুলাই,মোটামুটি চৌষট্টি বছরের নাতিদীর্ঘ এক জীবন।
মোহিতলালের প্রথম পরিচয়,তিনি কবি। দ্বিতীয় পরিচয়,সাহিত্য সমালোচক। দুই ক্ষেত্রেই তিনি কীর্তিমান। তাঁর কবিতা নিয়ে সমসময়ে,পরবর্তীকালে অনেক আলোচনা হয়েছে। সেসব কথা থাক। শুধু দুজনের কথা বলা যাক।রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। সাহিত্যে নবত্ব প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে মোহিতলালের কাব্যের অকৃত্রিম পৌরুষের উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,’তাঁর লেখায় তাল-ঠোকা পাঁইতারা মারা পালোয়ানি নেই। যথার্থ যে বীর সে সার্কাসের খেলোয়াড় হতে লজ্জা করে।’ আর তাঁর ‘শেষ শয্যায় নূরজাহান’ পড়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন,’আমার ‘কবর-ই- নূরজাহান’ ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’
অন্যদিকে,সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে মোহিতলালকে ‘সাহিত্যতত্ত্ববিদ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তাঁরই ছাত্র নীরদ সি চৌধুরী। নিজের কালের সাহিত্যস্রষ্টাদের নিয়ে,ব্যক্তিগত সম্পর্ককে প্রাধান্য না দিয়ে,আপন সাহিত্য আদর্শ দ্বারা চালিত হয়ে তিনি লিখে গিয়েছেন এত অজস্র সংবেদনশীল রচনা,সমকালে তো বটেই উত্তরকালেও তার তুলনা মেলা ভার।
ব্যক্তিগত জীবনে অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ ছিলেন মোহিতলাল। পুত্র মনসিজ লিখেছেন,ঘোড়ায় চড়া ছিল তাঁর হবি,তাঁরই আবার শখ ছিল ফুলের বাগানের। বহু অর্থব্যয় ও পরিশ্রম করে ঢাকায় বাসস্থানের সামনে ফাঁকা জায়গায় দুর্লভ গোলাপ ফুটিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধা,কিন্তু বেলুড়মঠে দীক্ষা নেওয়ার প্রশ্নে স্ত্রীকে বলে দেন,’ঈশ্বরই আমার গুরু। মানুষের কাছে দীক্ষা নেব কেন?’
নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ,গীতাপাঠ না-করে দিন শুরু করতেন না। কিন্তু বাড়িতে মুসলমান ছাত্রের রাত্রিবাসে,তাদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে ভাত খেতেও আপত্তি ছিল না তাঁর।
এরকমই নানা আপাতবিরোধী গুণের সমাবেশে উজ্জ্বল এক অদ্ভুত মানুষই ছিলেন মোহিতলাল। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কবিতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর কবিতার চালিকাশক্তিকে আখ্যায়িত করেছেন,’রূপকারী বিবেক’। শুধু কবিতার ক্ষেত্রে নয়,সব ক্ষেত্রেই কিন্তু সক্রিয় ছিল তাঁর বিবেকই। তিনি বরাবর মেনেছেন বিবেকেরই অনুশাসন। ফলে ভিতরে ভিতরে তৈরি হয়েছিল বিরাট এক আত্মপ্রত্যয়।
এই আত্মপ্রত্যয় ঠিক না ভুল সে বিচার নিরথর্ক,কিন্তু তিনি সর্বদাই থেকেছেন,আপন সিদ্ধান্তে অটল। গান্ধীজি যেদিন মারা গেলেন,সারা রাত ঘুমোননি। গান্ধী সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন নিয়ে তর্ক করেছেন নিজেরই সঙ্গে। অবশেষে পরের দিন,বিকেলে বন্ধুদের জানিয়েছেন,’এখন আমি নিশ্চিন্ত,আমার ধারণা বদলাবার কোনও প্রয়োজন নেই।’
আত্মপ্রত্যয় তাঁকে আপোস করতে শেখায়নি। সাহিত্য সমালোচনায়,দেশ-কাল সম্পর্কিত নানা লেখায় চটিয়েছেন অনেককেই। ফলে ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়েছেন। তবু মনোবল হারাননি। এমনকী,শেষ জীবনেও। নিদারুণ অর্থসঙ্কট তখন। তবু ব্রতের মত লিখে গিয়েছেন অজস্র বই। সমালোচনা সাহিত্য যেগুলো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। কলকাতার একই মেসে থাকা সজনীকান্ত মোহিতলালকে সুললিত উচ্চকন্ঠে তাঁর নিজের লেখা কবিতা পাঠ করতে শুনেছেন। শুধু নিজের কবিতা নয়,ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তেও। বিশেষ প্রিয় ছিল ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’।নিজেকে ট্র্যাজিক হিরো ভাবতেন। তাই গভীর আবেগে চেঁচিয়ে পড়তেন-‘যে পক্ষের পরাজয়/সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে কোরো না আহ্বান/ জয়ী হোক,রাজা হোক পান্ডবসন্তান/ আমি রব নিস্ফলের,হতাশার দলে।’
কর্মের চক্করে পরে সারাজীবন ঘুরেছেন যাযাবরের মত। প্রথমে শিক্ষকতা ক্যালকাটা হাইস্কুলে (নীরদ সি এখানকারই ছাত্র ছিলেন)। অল্প কিছুকালই এখানে ছিলেন। এরপরে মোহিতলাল যোগ দেন কানুনগোর কাজে। কর্মস্থল হয় উত্তরবঙ্গ। এখানে কিন্তু বেশ কিছুকাল অতিবাহিত করেন। এরপর আবার ফেরেন শিক্ষকতায়। এবারে কলকাতার মেট্রোপলিটন স্কুল। কর্মজীবনের শেষ পর্যায় অতিবাহিত করেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে।
প্রথম জীবনে সফল কবি। আর ঢাকায় গিয়ে দিক বদল হল। যুক্ত হলেন অন্যরকমের সাহিত্যকর্মে। তিনি হয়ে উঠলেন পরাক্রমী সাহিত্য সমালোচক। লিখেছেন ‘প্রবাসী’,’কল্লোল’,’শনিবারের চিঠি’,’ভারতী’ ইত্যাদি পত্রিকায়।’শনিবারের চিঠি’র সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন নজরুলের সঙ্গে বিরোধিতার সূত্রে। ‘বিদ্রোহী’র প্যারডি লিখেছিলেন সজনীকান্ত। নজরুল ভেবেছিলেন,এ কাজ তাঁর একদা গুরু মোহিতলালের।’কল্লোলে’ তিনি লিখলেন ‘সর্বনাশের ঘন্টা’। মোহিতলাল ছুটে এলেন ‘শনিবারের চিঠি’র দপ্তরে। হাতে কবিতা,’দ্রোণগুরু’। ‘শনিবারের চিঠি’ সে কবিতা বিশেষ ক্রোড়পত্র করে ছেপে আসর জমিয়ে তুলল।
‘আত্মস্মৃতি’তে সজনীকান্ত লিখে গিয়েছেন সেই উত্তপ্ত দিনের ইতিহাস। এরপরে নানান ছদ্মনামে ‘শনিবারের চিঠি’তে মোহিতলাল লেখেন অনেক লেখা।
উত্তরবঙ্গে থাকার সময়ে মোহিতলাল একটি তেজি দুরন্ত ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে সারারাত ছুটেছিলেন বনজঙ্গল,মাঠ প্রান্তর দিয়ে। ঘোড়া অনিচ্ছুক ছিল সওয়ারিকে নিতে। সে ফেলতে,আহত করতে চেয়েছিল তাঁকে।কিন্তু সারারাতের চেষ্টাতেও সে তা পারেনি। প্রাণচঞ্চল যুবক মোহিতলালের পৌরুষের কাছে সে হার মেনেছিল,সারারাতের শেষে ক্লান্ত,বিধ্বস্ত হয়ে।
এই ঘোড়ায় চড়ার কাহিনি যেন অনেকটা তাঁর নিজের জীবনেরই রূপক। শুধু রবীন্দ্রনাথ কথিত বাঙ্গলা কবিতায় নবত্ব আনা পৌরুষ নয়,কোনও অবস্থাতেই জীবনের কাছে হার না মানা এক পৌরুষের নামই যেন মোহিতলাল।