Blog



প্রিয় লেখক
কিরীটী ও নীহাররঞ্জন
‘প্রীতিভোজ উৎসব সুব্রতর বাড়িতে। আমহার্স্ট স্ট্রিটে প্রকান্ড বাড়ি কিনেছে সুব্রতরা। সে বাড়িতেই গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে এই প্রীতিভোজের অনুষ্ঠান। অনেক আমন্ত্রিতরাই এসেছেন। তাঁদের মধ্যে এসেছেন বিশেষ একজন। কিরীটী রায়।’
এভাবেই রহস্যভেদী কিরীটী রায়ের আবির্ভাব। মোবাইল-কম্পিউটার পূর্ব যুগে যাঁর কার্যকলাপ পড়বার জন্য বাঙালির আগ্রহের অন্ত ছিল না।
সে সময় শহর-গ্রামবাংলার লাইব্রেরিগুলো এখনকার মত নিষ্প্রাণ হয়ে যায়নি। প্রচুর পাঠক সমাগম হত। এইসব পাঠকদের একটা বিরাট অংশই ছিলেন ডিটেকটিভ উপন্যাসের পোকা। আর পছন্দের ডিটেকটিভ উপন্যাসের মধ্যে নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী অমনিবাস ছিল এক নম্বরে।
গোয়েন্দা কিরীটীর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণ, সমসাময়িক গোয়েন্দাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনেকটাই আলাদা। কিরীটী বাঙালি।,কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপের বাইরে তাঁর অবস্থান। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বর্ণনা অনুযায়ী-‘কিরীটী রায় প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা,গৌরবর্ণ,বলিষ্ঠ চেহারা,মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল ব্যাকব্রাশ করা,দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে,সদানন্দ,আমুদে।’
এর উপর কিরীটী গান জানেন। সেই সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য গুণ যা প্রমথনাথ বিশীর ভাষায়-‘ব্যক্তিত্ব, তীব্রতীক্ষ্ণ যুক্তিবোধ,পরিমিতিবোধ,ক্ষুরধার বুদ্ধি।’
এমন গোয়েন্দার কদর কে না করবে! বাঙালি পাঠিকারাও কিরীটীর প্রেমে পড়েছিল।
কিরীটী কাহিনির যখন সূচনা হয়েছিল,তখন টালিগঞ্জে তাঁর সাজানো সবুজ দোতালা বাড়িতে ভৃত্য জংলি আর ড্রাইভার হীরা সিংকে নিয়ে একার সংসার। এরপর ‘হলুদ শয়তান’ এ কৃষ্ণার সঙ্গে আলাপ এবং ‘ডাইনির বাঁশী’তে কৃষ্ণার সঙ্গে বিবাহ। কিরীটীর এই বিয়ে বাংলাদেশের পাঠিকারা অনেকেই নাকি মেনে নিতে পারেননি। চিঠি লিখেছিলেন লেখককে।
গোয়েন্দাকাহিনি লেখার অনুপ্রেরণা হিসাবে দুটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন নীহাররঞ্জন। যৌবনকালে ঘটা দ্বিতীয় ঘটনাটির অভিঘাত ছিল বেশি। পাড়ার এক পোড়ো জমিদার বাড়িতে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত দেবর খুন করেছিল তার অন্তঃসত্ত্বা বিধবা বৌদিকে। এটি লেখক অকুস্থলে গিয়ে দেখে প্রচন্ড আলোড়িত হন।
আর প্রথম ঘটনাটি বাল্যকালের। সেটি গোপন ভালোবাসার জন্য একটি মেয়ের গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা।
এইসব ঘটনার পিছনের আসল সত্যিটা বেশিরভাগ সময় অজ্ঞাতই থেকে যায়। একজন সত্যান্বেষীই পারেন আসল সত্যিকে জনসমক্ষে হাজির করতে। নীহাররঞ্জন তখন ডাক্তারির ফিফথ ইয়ারের ছাত্র। গোয়েন্দা গল্প লেখার তাগিদ অনুভব করলেন এই দুই ঘটনা মনে মনে বিশ্লেষণ করে।
তবে অনেক চিন্তাভাবনা করেই নীহাররঞ্জন এগিয়ে ছিলেন। পাঁচকড়ি দে-র গোয়েন্দাকাহিনির তিনি মুগ্ধ পাঠক। দেবেন্দ্রবিজয় তাঁর প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র। কিন্তু সেই ছাঁচে তিনি তাঁর গোয়েন্দাকে গড়লেন না। বাঙালি হলেও একটা ওয়েস্টার্ন ইমেজ খাড়া করলেন তাঁর গোয়েন্দার মধ্যে। এই গোয়েন্দার নিজস্ব গাড়ি,বাড়ি আছে। অর্থের অভাব নেই। সহকারী সুব্রতর স্ট্যাটাসও প্রায় অনুরূপ।
গোয়েন্দার নাম নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। নানা নাম মাথায় আসছে,কিন্তু কোনওটাই পছন্দ হচ্ছে না। শেষে দার্জিলিংয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে মনে হল পাহাড় যেন সোনার কিরীট পরে রয়েছে। এই মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল দেহে। কিরীটী,কিরীটীই হবে তাঁর গোয়েন্দার নাম। পদবিও নামের সঙ্গে সঙ্গে চলে এল। জন্ম হল কিরীটী রায়ের।
তবে ব্যোমকেশের মতো ‘সত্যান্বেষী’ কিংবা ফেলুদার মত ‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর’ নয়। কিরীটীর বাড়ির নেমপ্লেটে কিরীটী রায় নামের তলায় দেখা গেল তাঁর পরিচয় হিসাবে রয়েছে ‘রহস্যভেদী’। এই নামে কিরীটীকে নিয়ে নীহাররঞ্জনের একটি কাহিনিও রয়েছে,যেখানে কিরীটী কলেজের ছাত্র। এই হিসাবে এটি কিরীটীর সবচেয়ে কম বয়সের রহস্য উন্মোচন।
বেশিরভাগ গোয়েন্দা গল্পই ফুরিয়ে যায় অপরাধী ধরা পরার পর। কিন্তু নীহাররঞ্জন ছিলেন দক্ষ ঔপন্যাসিক। কিরীটী-কাহিনির বাইরেও তিনি অজস্র উপন্যাস লিখেছেন। ফলে কাহিনি বয়নের স্বাভাবিক একটা দক্ষতা তাঁর করায়ত্ত ছিল। কিরীটী কাহিনিও তাই অপরাধীকে খুঁজে বার করার মধ্যেই শেষ হয় না। উপন্যাস পাঠের একটা আমেজও এখানে পাওয়া যায়।
যৌনতাড়না,রিবংসা,সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব নীহাররঞ্জনের গোয়েন্দা গল্পকে অনেক ক্ষেত্রে ‘এ’ মার্কা করে তুলেছে, বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে নিজে যেহেতু ছিলেন চিকিৎসক, কিরীটী-কাহিনিতে তিনি নিজের চিকিৎসা জ্ঞানকেও অনেক জায়গায় কাজে লাগিয়েছেন।
‘কালো ভ্রমর’ দিয়ে যাত্রা শুরু। তারপর অজস্র উপন্যাস। ‘চক্রী’,’বৌরাণীর বিল’,হাড়ের পাশা’,বিষকুম্ভ’,’ মৃত্যুবাণ’, ‘সুভদ্রাহরণ’,’তাতল সৈকতে’ ইত্যাদি অসংখ্য কিরীটী কাহিনি গ্রন্থিত হয়েছে বারো-তেরোটি অমনিবাসে।
কিরীটীতে সমকালে শুধু সাধারণ পাঠক নয়, মজেছিলেন বাংলাসাহিত্যের বিখ্যাত লেখক-লেখিকারাও। এই দলে প্রমথনাথ বিশী,গজেন্দ্রকুমার মিত্র,লীলা মজুমদার,বিজনবিহারী ভট্টাচার্য প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। এঁরা প্রত্যেকেই কিরীটী অমনিবাসের বেশ বড়সড় ভূমিকা লিখেছিলেন।
চার কন্যার জনক ছিলেন নীহাররঞ্জন। আর কিরীটী ছিল তাঁর মানসপুত্র। নীহাররঞ্জনের জন্ম ১৯১১ সালের ৬ জুন। আর ডাক্তারির ফিফথ ইয়ারে পড়াকালীনই তিনি এই মানসপুত্রের জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন ভিন্ন ধরনের এক পিতৃত্বের স্বাদ। নিজের উচ্চতা পাঁচফুট আট ইঞ্চি,রঙেও মিল নেই মানসপুত্রের সঙ্গে। মিল বলতে শুধু ব্যাকব্রাশ করা চুল।
তবু ফেলুদার মধ্যে যেমন তাঁর স্রষ্টা রয়ে যান,তেমনই কিরীটীর মধ্যেও রয়েছেন লেখক নীহাররঞ্জন। বিজনবিহারী ভট্টাচার্য লিখেছেন-‘কিরীটীর রংটা দিয়ে তাঁকে ঠিক চেনা যাবে না। কিন্তু কিরীটীর মুখে এবং চরিত্রে ডাক্তার গুপ্তের আদলটা তাঁদের চোখে সহজেই ধরা পড়বে,যারা উভয়কে অন্তরঙ্গভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন।’
এমন চরিত্র সেলুলয়েডে আসুক কোন স্রষ্টা না চাইবেন? কিন্তু কে কিরীটী করবেন সেটাও তো দেখে নিতে হবে স্রষ্টাকে! কিরীটীর গ্ল্যামারে মুগ্ধ উত্তমকুমার কিরীটী করার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন নীহাররঞ্জনের কাছে। নীহাররঞ্জন নাকি রাজি হননি। সম্ভবত সমস্যাটা ছিল উচ্চতার।
নিকটজনের স্মৃতিচারণে জানা যায়,নীহাররঞ্জন কিরীটী হিসেবে ভেবেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অজিতেশ অবশ্য লেখকের এই ইচ্ছের কথা জানতে পারেননি।
সুখের কথা,সাম্প্রতিককালে ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শবরের সঙ্গে কিরীটীকেও সেলুলয়েডে নিয়ে আসা হয়েছে। আবার কিরীটী ফিরে পড়া হচ্ছে। এককালের কিরীটী-কাহিনির মুগ্ধ পাঠকেরা এতে স্বভাবতই খুশি।