প্রিয় লেখকঃ পাঁচনম্বর বাড়ির সেই গুণী মানুষটি

 

Ami Mishuk | আমি মিশুক প্রিয় লেখকঃ পাঁচনম্বর বাড়ির সেই গুণী মানুষটি

প্রিয় লেখক

পাঁচনম্বর বাড়ির সেই গুণী  মানুষটি

পাঁচনম্বর বাড়ির উত্তরের বারান্দায় ঠায় বসে আছেন তিনি। দৃষ্টি ছ’নম্বর বাড়ির দিকে নিবদ্ধ। পাঁচনম্বর আর ছ’নম্বর বাড়ির মাঝখানে সেদিন অগণিত লোক। এক মহাবিপদের আশঙ্কায় তারা প্রহর গুনছে। একসময় কে একজন এসে বলল-‘স্নান করে নিন,খেয়ে নিন।’
ফিরে তাকালেন তার দিকে। বললেন-‘এই বাড়িতে বসে অনেক মৃত্যু দেখেছি,অনেক শোক পেয়েছি। আমার জন্য ভাবিস না,তোরা যা। আমি ঠিক সময়ে নাইব,খাব।’
মুখে যতই বলুন,তবু বসে রইলেন অনেকক্ষণ। একসময় উঠলেন। স্নান-খাওয়াও সারলেন। কিন্তু এরপর আবার বেতের চেয়ারটায় বসে যেই পান মুখে দিতে যাবেন,ভেসে এল খবর। সব শেষ,রবি অস্তমিত। পান খাওয়া আর হল না।
তাঁর প্রিয় রবিকা আর নেই! একটুকরো কাগজ আর রঙ নিয়ে রবিকার প্রিয় অবন ওরফে অবনীন্দ্রনাথ এঁকে ফেললেন,অগণিত জনসমুদ্রের মাথায় রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রার ছবি।
দিনটা ১৯৪১ এর ৭ আগস্ট।
সেদিন আবার রবিকার প্রিয় অবনের জন্মদিনও। আর তাঁর জন্মসালটা ছিল ১৮৭১। অর্থাৎ অবনীন্দ্রনাথের সপ্ততিতম জন্মদিনটিতেই ঘটে গেল এমন এক বিপর্যয়।
এদিকে মৃত্যুর কয়েকদিন আগে,তাঁর অন্তিম ইচ্ছায় রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে গিয়েছেন,বাংলার জনগণ যেন অবনীন্দ্রনাথের  সপ্ততিতম জন্মদিনটি পালন করে সাড়ম্বরে। রবীন্দ্রনাথের কথায়-‘সমস্ত  দেশ তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাদান গ্রহণ করেছে।’
এই ভাইপোকে নিয়ে সব সময়েই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উচ্ছ্বসিত। হবেন নাই বা কেন? বিশ্বখ্যাত শিল্পী, দিগবিজয়ী সাহিত্যিক। তাঁর ছবিতে মুগ্ধ ভারতলাট,মুগ্ধ ভারতসচিব।’শাজাহানের মৃত্যু’ ছবিখানা তো ভারতসচিব মন্টেগুর এমনই ভালো লেগে যায় যে স্বভাবের বাইরে গিয়ে  অবনীন্দ্রনাথকে সে ছবির কপি পর্যন্ত করে দিতে হয়।
আর সাহিত্য? এমনভাবে গল্প লেখেন যে তাতে কলমের কোনও দাগ  থাকে না। মনে হয় যেন তুলির আঁচড়। রবিকার কথাতেই প্রথম প্রবৃত্ত হন সাহিত্য রচনায়। রবিকার কথায় প্রথমটায় চমকে উঠেছিলেন।-‘বলছ কী,আমি আবার লিখব কী? কেমন করে লিখতে হয় তাই জানি না।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-‘যেমন করে গল্প বলছ,ছবি আঁকছ,তেমন করেই লিখবে।’
সেই শুরু হল। কিন্তু, ভিতরে ভিতরে যে তিনি চিরশিশু। তাই শিল্পসংক্রান্ত লেখাগুলো বাদ দিয়ে যা লিখলেন, তার বেশিরভাগই হল শিশু-কিশোরদের জন্য। বঙ্গদেশের শিশু-কিশোরদের এ এক সৌভাগ্যই বটে!
জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়িতেই ছিল তাঁর অধিষ্টান। এই বাড়ির বিখ্যাত দক্ষিণের বারান্দার তিন মহারথী ছিলেন তিন ভাই। গগনেন্দ্রনাথ,সমরেন্দ্রনাথ আর তিনি মানে অবনীন্দ্রনাথ। বাড়ির বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একেবারে উল্টো। বলা যায়,একেবারে গৃহগত প্রাণ। অন্য দু’ভাইয়েরও অবশ্য তাই। এই বাড়ি,এই দক্ষিণের বারান্দা ছেড়ে অবনীন্দ্রনাথ বাইরে যেতে চাইতেন না। খুব বেশি হলে গিয়েছেন দার্জিলিং,রাঁচি,দেওঘর আর পুরী।
আর একবার গিয়েছিলেন নিজেদের জমিদারি সাজাদপুরে। অন্য ভ্রমণের মত এখানেও তিন ভাই মিলে। কিন্তু সেসব আর কটা দিন? দ্বারকানাথের তৈরি এই বৈঠকখানা বাড়িতেই থেকে গিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগটা। আর এই বাড়ির দক্ষিণের বারান্দাই ছিল তিন শিল্পী ভাইয়ের একাধারে স্টুডিয়ো এবং বৈঠকখানা। 
এখানে বসেই অবনীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছেন,সাহিত্য রচনা করে গিয়েছেন দিনের পর দিন। তাঁর ছবির টানে এই দক্ষিণের বারান্দায় কত দেশি-বিদেশি জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা যে ভিড় করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।
পাঁচনম্বরের এই গুণী বাসিন্দাটি শুধু আঁকা আর লেখা নিয়েই কিন্তু থাকতেন না। তুলি,কলম ফেলে তিনি অনেকসময়েই মিশে যেতেন ছোটদের সঙ্গে। দ্বিতীয় কন্যা করুণার অকালপ্রয়াণের পর তাঁর তিনটি শিশু সন্তান একেবারে হৃদয় জুড়ে বসেছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মোহনলাল ছিল দাদামশাইয়ের একেবারে নয়নের মণি। এই মোহনলালেরই (মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়) কৈশোর স্মৃতিকথা ‘দক্ষিণের বারান্দা’য় রয়েছে কীভাবে বাড়ির ছোটদের দলে মিশে বাড়িটাকে আনন্দনিকেতন করে তুলতেন অবনীন্দ্রনাথ।
ছোটদের নিয়ে তিনি কত কিছুই না করেছেন। তাদের সঙ্গে বাগানে আত্মগোপন করে বুলবুলি ধরেছেন। বাড়ির ছোটদের লেখক হওয়ার বাসনাকে পূরণ করতে তাদের দিয়ে স্বপ্ন লেখার কাগজ ‘স্বপ্নের মোড়ক’ বের  করিয়েছেন। এমনকী,’দোয়ালা’ নামের এক হাতে লেখা মাসিক কাগজও বের করেছেন। ডান্ডিতে গান্ধিজির নুন তৈরির সময় ছোটদের নিয়ে নারকেল পাতা পুড়িয়ে লবণ বানিয়েছেন। ছোটদের জন্য রান্নার ক্লাস খুলেছেন, লিখেছেন যাত্রাপালা। বাড়ির খুদেদের শিখিয়েছেন দেশি রং প্রস্তুত করার কৌশল।
অবনীন্দ্রনাথের প্রিয় এক নেশা ছিল পাথর সংগ্রহ। কলকাতার বাইরে দেওঘর বা রাঁচি গেলেই তিনি রোজ পাথর কুড়োতে বেরোতেন। নানা সাইজের রকমারি পাথর জলে ধুয়ে ছেনি দিয়ে একটু এদিক-ওদিক করে তৈরি করতেন শিল্পদ্রব্য। তারপর সবাইকে তা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন। আবার কখনও পাথর ফাটিয়ে দেখতেন ভিতরে কী রয়েছে। স্বপ্ন দেখতেন একদিন নিশ্চিত পাথরের ভিতরে পেয়ে যাবেন হিরে।  কোনও জিনিসই তাঁর কাছে অবহেলার ছিল না। ভেঙে যাওয়া রেকাবির টুকরো,বেলোয়ারি কাচ,হেলাফেলা জিনিস সবকিছুরই তাঁর কাছে ছিল সমাদর। একটু ছেনি-হাতুড়ি লাগিয়েই তৈরি করে ফেলতেন দর্শনীয় কোনও জিনিস। মোহনলাল লিখেছেন,শেষজীবন নয়,অবনীন্দ্রনাথের ‘কুটুম-কাটুম’ এর গোড়াপত্তন হয়েছিল অনেক আগেই।
ছেলেবেলা থেকেই গানবাজনার শখ ছিল অবনীন্দ্রনাথের।  এসরাজ,ম্যান্ডোলিন বাজাতে পারতেন। ছিলেন কুশলী অভিনেতাও। এছাড়া,রসিয়ে গল্প বলায় তাঁর জুড়ি ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর আচার্যের পদ নিয়ে শান্তিনিকেতনে সাময়িকভাবে যখন বাস করতে এলেন,তখন কার্যভার শুরু করেছিলেন এক সন্ধ্যার আসরে ছেলেমেয়েদের ভূতের গল্প বলে। বাইরের দুনিয়া তাঁকে চিনেছিল শিল্পী,লেখক পরিচয়ে। কিন্তু তুলি ও কলমের বাইরেও বিভিন্ন দিকে ছিল তাঁর উৎসাহ। রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি ছিলেন জীবনশিল্পী।