Blog

প্রিয় লেখকঃ প্রকাশক সজনীকান্ত


প্রিয় লেখক
প্রকাশক সজনীকান্ত
স্ত্রী আসন্নপ্রসবা। তিনি নিশ্চিত, সংসারে যুক্ত হতে চলেছে যে নতুন অতিথি,সে হবে পুত্র। অনাগত সন্তানকে পুত্র ধরে নামও ঠিক করে ফেললেন তার। রঞ্জন। এসব এত তাড়াতাড়ি করার কারণ আছে। নীরদচন্দ্রকে তিনি কথা দিয়েছেন, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’র তিনিই হবেন প্রকাশক। কিন্তু প্রকাশক হলেই তো হল না। একটা প্রকাশালয় তো দরকার। দরকার তার একটা জুৎসই নামও। কী নাম দেবেন? যে আসছে,তার নামটা ছাড়া! প্রকাশালয়ের নাম দিলেন-রঞ্জন প্রকাশালয়।
নীরদচন্দ্র সজনীকান্তের মুখে কথাটা শুনে প্রথটায় কিন্তু একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলেন। বই প্রকাশ করা সহজ কাজ নয়। অনেক টাকাকড়ির ব্যাপার। সজনীকান্তের মাস মাইনে তখন দেড়শো। ভাড়া বাড়িতে নতুন সংসার। অন্য কোনও জায়গা থেকে হঠাৎ টাকা এসে হাজির হবে তাও নয়। কিন্তু তিনি সজনীকান্ত। প্রবল আত্মবিশ্বাস তাঁর চরিত্রে। তাই অবাক হয়েও নীরদচন্দ্র তাঁর কথায় ভরসা রাখলেন। ছুটলেন তাঁদের মির্জাপুর স্ট্রিটের মেসে, বিভূতিভূষণকে আনতে।
এ দিনের ঘটনার আগে একটু অন্য ইতিহাস আছে। ‘বিচিত্রা’য় ধারাবাহিক বের হচ্ছিল ‘পথের পাঁচালী’। সজনীকান্ত ‘বিচিত্রা’র এক আধটা সংখ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ ধারাবাহিকে চোখ বোলালেও মন দিয়ে পড়েননি,পড়ার তাগিদও অনুভব করেননি। আগের দিন ‘শনিবারের চিঠি’র আড্ডায় নীরদচন্দ্র,বিভূতিভূষণ দুজনেই ছিলেন। তখন নীরদচন্দ্র কথা প্রসঙ্গে আক্ষেপ করেন, ‘পথের পাঁচালী’র মত উপম্যাসের একজন ভদ্র প্রকাশক জুটল না বলে। নীরদচন্দ্রের ভাষায়,এটা বাংলা সাহিত্যের দুর্ভাগ্য।
নীরদচন্দ্রের কথায় নড়েচড়ে বসলেন সজনীকান্ত। কী এমন বিশেষত্ব আছে উপন্যাসটার যে এভাবে বলছেন নীরদবাবু! একটু পড়ে দেখতে হয়! ’বিচিত্রা’র সব ফাইল জোগাড় করে রাত জেগে পড়ে ফেললেন উপন্যাসের প্রকাশিত সবটুকু অংশ। সজনীকান্ত বিষ্ময়-বিমুগ্ধ। লেখকের প্রতি শ্রদ্ধাবনত। আর ঘুম এল না বাকি রাত। পরদিন অফিসে এসেই নীরদবাবুকে শুধোলেন,আগের দিন তাঁর বলা কথার অর্থ কী। নীরদচন্দ্র জানালেন,এক প্রখ্যাত প্রকাশক ‘পথের পাঁচালী’র কপিরাইট কিনতে চেয়েছেন পঞ্চাশ টাকায়,আর এক সম মাপের প্রকাশক বলেছেন,বই ছেপে বিক্রি হলে কিছু রয়ালিটি দিতে পারেন।
একথা শুনেই ক্রুদ্ধ হয়ে সজনীকান্তের ওই ঘোষণা,বিভূতিভূষণ রাজি থাকলে তিনিই হতে পারেন ‘পথের পাঁচালী’র প্রকাশক। নীরদবাবু আনতে চলে গেছেন বিভূতিভূষণকে। ইত্যবসরে সজনীকান্ত বসলেন বন্ধু গোপাল হালদারের সঙ্গে আলোচনায়। ঠিক হল দুজন মিলে নামবেন পুস্তক ব্যবসায়। গোপাল হালদারের সুউপায়ী বাবা তখন নোয়াখালিতে থাকেন। গোপাল হালদার কথা দিলেন,বাবার কাছ থেকে তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ ধার করে আনবেন। দুজনে মিলে ঠিক করলেন, প্রথম সংস্করণের জন্য বিভূতিভূষণকে দেবেন তিনশত টাকা।
নীরদচন্দ্র বিভূতিভূষণকে নিয়ে ঢুকলেন অফিসে। সজনীকান্ত পেশ করলেন তাঁর প্রস্তাব। অরাজি হবার প্রশ্ন নেই। কিন্তু সরল মানুষ বিভূতিভূষণ বললেন,একটু দরাদরি না করলে ব্যবসা হয় না। তিনি তিনশত টাকার পরিবর্তে তিনশত পঁচিশ টাকা দাবি করলেন। সানন্দে রাজি হলেন প্রকাশক সজনীকান্ত। ঠিক হল লেখাপড়া হবে সজনীকান্ত ও বিভূতিভূষণের মধ্যে। সাক্ষী থাকবেন নীরদচন্দ্র ও গোপাল হালদার। রঞ্জন প্রকাশালয়ের পক্ষে দলিলে সই করলেন সজনীকান্ত। বিভূতিভূষণকে বায়না দেওয়া হল পঁচিশ টাকা।
মতিবাবুর দোকান থেকে ডিম মাংস পাঁউরুটি পুডিং আনানো হল। এল কয়েক প্যাকেট ট্যাটলার সিগারেট। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’র প্রকাশকে কেন্দ্র করে এভাবেই গোড়াপত্তন হল রঞ্জন প্রকাশালয়ের।
প্রায় ৬২ বছরের (২৫ আগস্ট ১৯০০ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২) জীবনে নিন্দা-বিশারদ হিসাবে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলেন সজনীকান্ত। কিন্তু কাছের মানুষেরা জানতেন,নিন্দা ব্যঙ্গ অনেকটাই ছিল সজনীকান্তের সাহিত্যসাধনার বাইরের পোশাক। আসলে মানুষটি ছিলেন দরাজদিল। তাঁর জীবনের অনেক মহৎ কীর্তি রয়েছে,যার মধ্যে একটি হল ‘পথের পাঁচালী’কে প্রথম বইয়ে রূপদান।
শোনা যায়, ‘পথের পাঁচালী’র জন্য গোপাল হালদার দিয়েছিলেন দুশো পঞ্চাশ টাকা। সে টাকার সংস্থান গোপাল হালদার কীভাবে করেছিলেন তা আজও রহস্যাবৃত। ধারাবাহিক শেষের দিক থেকে ‘বিচিত্রা’য় বিজ্ঞাপন বের হতে লাগল ‘পথের পাঁচালী’বইয়ের। জানানো হল ‘আশ্বিনের মাঝামাঝি বাহির হইবে’। ‘শনিবারের চিঠি’তে রঞ্জন প্রকাশালয়ের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনেও দেখা গেল ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশের খবর। ‘পথের পাঁচালী’ বের হল ২রা অক্টোবর,১৯২৯। মহালয়ার দিন।‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশকে কেন্দ্র করে রঞ্জন প্রকাশালয় তৈরি হলেও ছোট বই হবার সুবাদে প্রথম বের হল সজনীকান্তের’অজয়’। সজনীকান্তকে দেওয়া ‘পথের পাঁচালী’তে বিভূতিভূষণ স্বাক্ষর করলেন ‘অপু’ লিখে। আর সজনীকান্ত বিভূতিভূষণকে দেওয়া ‘অজয়’এর কপিতে লিখলেন ‘অপুকে অজয়’।