প্রিয় লেখকঃ সব্যসাচী লেখক বুদ্ধদেব বসু

প্রিয় লেখকঃ সব্যসাচী লেখক বুদ্ধদেব বসু

Ami Mishuk | আমি মিশুক প্রিয় লেখকঃ সব্যসাচী লেখক বুদ্ধদেব বসু

প্রিয় লেখক

সব্যসাচী লেখক বুদ্ধদেব বসু

একটা নতুন ছেলে এসেছে স্কুলে। লাজুক। বেশি কথা বলে না। কেবল টিফিনের সময় বই পড়ে নানারকম। মাস্টারমশাইরা এর বেশি কিছু বুঝতে পারেননি প্রথমটায়। কয়েকমাস পরেই ছেলেটা এই স্কুলে দিল তার প্রথম পরীক্ষা। ছেলেটার পরীক্ষার খাতা দেখে তো মাস্টারমশাইদের চোখ চড়ক গাছ। বিশেষ করে ইংরেজি আর বাংলার খাতা দেখে মাস্টারমশাইরা যাকে বলে অভিভূত। প্রধান শিক্ষক মশাই সাহিত্যরসিক। তিনিও উত্তেজিত। এমন ছাত্রের দেখা তো ক্কচিৎ-কদাচিৎই পাওয়া যায়। ঢাকা কলেজি্যেট স্কুলে তখন একটাই আলোচনা,একটা প্রতিভাধর ছেলে এসেছে বিদ্যালয়ে।
স্কুলে শোরগোল ফেলা দেওয়া এই ছেলেটিই পরবর্তীকালের বুদ্ধদেব বসু।যিনি লেখক হিসেবে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যেও। রবীন্দ্রনাথের পর সাহিত্যের সব শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন অনায়াসে।
১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর কুমিল্লায় বুদ্ধদেব বসুর জন্ম। জন্মমূহূর্তেই তিনি দুর্ভাগ্যের শিকার। প্রসবকালীন ধনুষ্টঙ্কার রোগে মারা যান মা। তিনি মানুষ হন নোয়াখালিতে দিদিমা ও দাদামশাইয়ের কাছে। দিদিমাকেই মা বলতেন তিনি। শুধু বলতেন নয়,মানতেনও।
দাদামশাইয়ের কাছেই শিক্ষার, বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষার প্রথম পাঠ লাভ করেন। ভালোও বাসতে শেখেন ভাষাটিকে। ব্যাকরণের বালুডাঙায় ক্লিষ্ট না করে দাদামশাই তাঁর কাছে খুলে দেন বিদেশি ভাষাটির আনন্দের উৎসমুখ। তবু ইংরেজি তাঁর কাছে ছিল স্কুলকলেজের পড়ার ভাষা। জীবনের ভাষা ছিল বাংলাই। বাংলার জন্য তাঁর দাদামশাই লাগেনি। বাংলার শিক্ষক ,বাংলা সাহিত্যের যাদুকর লেখকেরাই। তাঁদের লেখা পড়েই শিখেছেন,উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। দাদামশাইয়ের প্রভাবে প্রথম বাল্যরচনা একটি ইংরেজি কবিতা হলেও ,অচিরেই তাঁর কলম সক্রিয় হয়েছে বাংলা কবিতা রচনাকর্মে।
দাদামশাই অবশ্য শুধু ভাষাশিক্ষার দিকেই জোর দেননি। সমস্ত বিষয় শিক্ষার দিকেই তাঁর নজর ছিল। যে জন্য চোদ্দ বছর বয়সে ঢাকা এসে  ক্লাস এইটে ভর্তি হয়ে বুদ্ধদেব শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন স্কুলে। ম্যাট্রিকে ঢাকা বোর্ডে তিনি পেয়েছিলেন পঞ্চম স্থান।বুদ্ধদেব অবশ্য ভেবেছিলেন প্রথম বা দ্বিতীয় হবেন। কিন্তু অঙ্কে নিরানব্বই পেলেও, আশ্চর্যজনকভাবে কম পেয়েছিলেন ইংরেজিতে। যে ভাষায় তাঁর আবাল্য দক্ষতা ও বিচরণ,সেই ভাষায় কম পেয়ে স্বভাবতই মন খারাপ হয়েছিল তাঁর।
তবে পরবর্তীকালে পড়াশোনা ইংরেজি নিয়েই। এবং সব জায়গাতেই নজরকাড়া রেজাল্ট। ইন্টারমিডিয়েটে দ্বিতীয় হয়ে  লাভ করেছিলেন কুড়িটাকার বৃত্তি। এরপর বিএ এমএ দু জায়গাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হন। শোনা যায়,তাঁর বিএ এবং এমএ পরীক্ষার মার্কশিটের কপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর সংরক্ষিত ছিল,রেকর্ড মার্কস হিসাবে।
বুদ্ধদেবের লেখালেখি শুরু হয়েছিল বাল্যকালেই। আর ঢাকায় পড়াকালীন তো তিনি রীতিমত লেখক। তাঁকে নিয়ে আলোচনা সর্বত্র। পাশাপাশি বিতর্কও চলছে তাঁর এক-একটি লেখা নিয়ে।বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু তখন ঢাকায়।বুদ্ধদেবের লেখার তিনি গুণগ্রাহী। তখন থেকেই তিনি বুদ্ধদেবের সত্যেনদা।
 অজিত দত্তের সঙ্গে বুদ্ধদেব যখন ‘প্রগতি’ বের করছিলেন,তখন তিনি বিএ ক্লাসেরও ছাত্র নন। আর এই ‘প্রগতি’র মাধ্যমেই অজিতদত্ত,জীবনানন্দ প্রমুখকে নিয়ে বাংলা কবিতায় তিনি নিয়ে এলেন নতুন স্বর।
আইএ’র বার্ষিক  পরীক্ষা দিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। পরিচিত হয়েছিলেন, কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের সঙ্গে। সেই সময় ওখানে  দিয়ে গিয়েছিলেন ‘রজনী হল উতলা’ নামের একটি গল্প। গল্পটা ছাপা হতেই শুরু হয়ে গেল কোলাহল। ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় বীনাপাণি দেবী লিখলেন-‘এমন লেখককে আঁতুরেই নুন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল।’ সবচেয়ে সোচ্চার হলেন সজনীকান্ত দাস ‘শনিবারের চিঠি’তে। এমনকী,রবীন্দ্রনাথকেও তিনি অনুরোধ করলেন,এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে।
সারাজীবনে লেখা নিয়ে এরকম  অভিযোগের সম্মুখীন বুদ্ধদেবকে হতে হয়েছে বহুবারই। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা শুনতে হয়েছে তাঁর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’কে কেন্দ্র করে। আদালত অব্দিও গড়িয়েছিল ‘রাত ভরে বৃষ্টি’র  অভিযোগ।
বাংলা সাহিত্যে তিনি আধুনিকতার পথিকৃৎ। স্বভাবতই রক্ষণশীলদের তিনি চক্ষশূল। সমালোচনা হয়েছে,হয়েছে ব্যক্তি আক্রমণও। এই ব্যাপারে তাঁকে এবং জীবনানন্দকে সবচেয়ে বেশি ক্ষত-বিক্ষত করেছেন ‘শনিবারের চিঠি’ খ্যাত সজনীকান্ত। তাঁর বাড়িতে নিয়ম করে পাঠানো হত ‘শনিবারের চিঠি’।তিনি পত্রিকার মোড়ক পর্যন্ত খুলতেন না। সজনীকান্ত মৃত্যুকালে শিবনারায়ণ রায়কে পাঠিয়েছিলেন, তাঁকে ক্ষমা করার অনুরোধ জানিয়ে। বুদ্ধদেব জানিয়েছিলেন-‘সম্ভব নয়।’
শুধু সাহিত্যের সব শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেননি। ‘প্রগতি’,’কবিতা’ পত্রিকার মাধ্যমে নতুন কবিদের আবিষ্কার করেছেন,তুলে ধরেছেন। জীবনানন্দ যখন দাশগুপ্ত থেকে দাশ হননি,তখন থেকেই তিনি জীবনান্দের প্রচারক ও পরিবেশক। পরবর্তীকালে,বহু সফল লেখকেরই তিনি পৃষ্ঠপোষক। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ নিয়ে মামলা হয়েছিল। ‘প্রজাপতি’র পক্ষ নিয়ে তিনি আদালতে গিয়েছিলেন সাক্ষী দিতে।
একসময় রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। একথা ঠিক,রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখার তিনি সমালোচনা করতেন,কিন্তু তিনি মনে-প্রাণে ছিলেন রবীন্দ্রপ্রেমী। বাল্যে রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’ পড়ে আবিষ্ট হয়েছিলেন। অজস্রবার পড়েছিলেন ‘ছিন্নপত্র’। সেই ভালোবাসা,মুগ্ধতা সারাজীবনে ভুলতে পারেননি। বারে বারেই ফিরে গিয়েছেন রবীন্দ্ররচনার কাছে। ব্যাখ্যা করেছেন নতুন ভাবে। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় দুবার গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। তাই নিয়ে লিখে গিয়েছেন ‘সব পেয়েছির দেশে’র মত একটি অসামান্য বই। অন্যদিকে,রবীন্দ্রনাথও তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। বাংলাসাহিত্যে তাঁর পরবর্তী একজন শক্তিধর লেখক হিসেবে তাঁকে স্বীকারও করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে বুদ্ধদেব ছিলেন শৌখিন স্বভাবের। সিগারেট ও চায়ের প্রতি ছিল বিশেষ দুর্বলতা। ছিলেন ভোজনরসিকও। পরপর দুদিন এক রান্না খেতে চাইতেন না। না-চাওয়ার তালিকায় আরও অনেক কিছু ছিল। যে বাড়ির ঠিকানা ‘লেন’,সে বাড়িতে তিনি ভাড়া নেবেন না।বাড়ির ঠিকানা হওয়া চাই ‘রোড’। কারণ ‘লেন’ মানেই গলি-ঘুপচি,যা বুদ্ধদেবের না-পসন্দ।
মনের দিক দিয়েও তিনি ছিলেন ‘রোডে’র মতই  প্রসারিত। সমর সেন লিখেছেন-‘বুদ্ধদেববাবু ছোটখাট মানুষ ছিলেন। কিন্তু কোনও কারণে যখন হেসে উঠতেন,তখন ঘরে যেন বাজ পড়ত। ওঁর অট্টহাসি থেকে বোঝা যেত যে মনে কোনও মালিন্য নেই।’
ঢাকায় যখন ছিলেন তখন তরুণ কবিদের আড্ডা-আলোচনার কেন্দ্র ছিল তাঁর দিদিমার বাড়ি-৪৭ নং পুরানা পল্টন। আর কলকাতায় তাঁর বাসা ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ঘিরে জমজমাট  আড্ডার বিবরণ তো আজ বহুল চর্চিত।
প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও ,সাংসারিক ব্যাপারে বুদ্ধদেব ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ।ছোটবেলায় নির্ভরশীল ছিলেন দিদিমার উপর। আর বিবাহের পর স্ত্রী প্রতিভা বসুর উপর। তিনি থাকতেন লেখাপড়া নিয়েই। ভালবাসতেন নাটক করতেও।ছোটবেলা থেকেই তিনি  ছিলেন সুঅভিনেতা।
১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ বাংলা সাহিত্যের এই মহীরূহ সদৃশ মানুষটি প্রয়াত হন। সেসময়  তাঁর বয়স মাত্র ছেষট্টি বছর।