সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ছেলেবেলাতেই। তাঁর কাছেই প্রথম জেনেছিলাম,যে-দেশের তরুলতা সকল দেশের চেয়ে শ্যামল সেই দেশটার নাম বাংলাদেশ। মানে, ‘আমাদেরই বাংলা রে!’ তারপর কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হবার নানা বাঁকে পড়ে ফেলেছিলাম কখনও তাঁর ‘মেথর’ কখনও ‘ঝর্ণা’ কখনও ‘আমরা’ কখনওবা ‘পালকির গান।’
সেদিন তো বটেই আজও মনে হয় এই গদ্যময় পৃথিবীতে তিনি অর্থাৎ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মানেই এক স্বচ্ছ পদ্যপুকুর যেখানে অবগাহন করলে শান্ত ও স্নিগ্ধ হয়ে যায় মন।
কথিত আছে, তাঁর জন্মের (১২ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২, ৩০ মাঘ ১২৮৮, শনিবার, সূত্রঃ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,সাহিত্যসাধক চরিতমালা) পরে পরেই নাকি ঝড় হয়েছিল খুব। সেজন্যই তাঁর ডাকনাম ছিল ঝড়ু। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের স্বভাবে ও সৃষ্টিতে ঝড় নয় বরাবর ছিল এই শান্ত ভাবেরই প্রাধান্য।
পিতামহ অক্ষয় কুমার দত্ত যখন মারা যান তখন সত্যেন্দ্রনাথের বয়স মাত্র চার। পিতামহকে বোঝার বয়স তখন তাঁর নয়। কিন্তু পিতামহের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির কিছুটা। যেজন্য ছাত্রজীবনে পদার্থবিদ্যার প্রতি দেখা গিয়েছিল বিশেষ অনুরাগ। এই অনুরাগ পরে তাঁর কবিতাতেও প্রভাব ফেলেছিল।
পদার্থবিদ্যা ভাল লাগলেও কৃতী ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন না কোনওদিনই। হবেনই বা কী করে? পাঠ্য বিষয়ের বাইরেই তো ছিল তাঁর পাঠ-জগৎ।
ঠাকুর্দার বিরাট লাইব্রেরিতে বই ছিল নানা ধরনের। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সেসবের নিবিড় পাঠক।অমল হোম লিখছেন, ‘দর্শনে তাঁর অভিরুচি খুব ছিল না বটে,কিন্তু তা-ও যে তাঁর পড়া ছিল না এমন নয়। ইতিহাস, দেশের ও বিদেশের তাঁর মত পড়া খুব অল্প লোকেরই দেখেছি। তারপর কাব্য সাহিত্যের তো কথাই নেই। পুরাণই কি তাঁর কম পড়া ছিল? যখনই কোথাও পৌরাণিক কিছুর উল্লেখ নির্ণয় করতে না পেরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছি,তখনই তা কোথায় আছে বলে দিয়েছেন।’ ইংরেজির পাশাপাশি ভাল ফরাসি ভাষা জানতেন। ফলে ইউরোপীয় সাহিত্যের সকল মহলের চাবিই ছিল তাঁর মুঠোর ভিতরে।
বাবা রজনীনাথ কিন্তু চেয়েছিলেন তাঁর মত হোমিওপ্যাথিতে নাম করুক সত্যেন্দ্র। কিন্তু বিয়ে ক্লাসে পড়তে পড়তে যখন তাঁর বিয়ের পাত্রী দেখাশোনা হয়ে গেছে, বৈশাখে দিনক্ষণও সব ঠিক ,তখন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত বাবা মারা গেলেন চৈত্র সংক্রান্তির দিনে। বিয়ে পিছিয়ে গেল একবছর। ঘরে এলেন সহধর্মিনী কনকলতা। বাবা নেই, বিয়ে করেছেন,ওদিকে বিএ পরীক্ষাতেও অসফল, মামার আমদানি রপ্তানির ব্যবসায় লাগিয়ে দেওয়া হল তাঁকে।
কিন্তু মন টিকবে কেন ওখানে? সেই ক্লাস টু তে পড়ার সময় শেলির কবিতার অনুবাদ দিয়ে কবিতায় হাতেখড়ি হয়ে গেছে। তারপর এতটা বয়স অব্দি তাতে মেতেও তো কম থাকেননি! বিএ পড়াকালীন,১৯০০ সালে উকিল বন্ধু সৌরীন্দ্রনাথ মিত্রের ব্যয়ে ছাব্বিশ পৃষ্ঠার তাঁর একটি কবিতার বইও(‘সবিতা’) বেরিয়েছে গোপনে।
মামার ব্যবসা থেকে অচিরেই নিজেকে মুক্ত করে সত্যেন্দ্রনাথ পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন।
শুধু পিতামহ অক্ষয়কুমার নন,বাবা রজনীনাথও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। মাতুল কালীচরণ মিত্রের তো লেখক হিসাবে তখন সুখ্যাতিও ছিল বেশ। সুতরাং পাঠতৃষ্ণা,কাব্যোৎসাহ সবকিছুরই অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিলেন গড়ে ওঠার সময়টাতে। ‘সবিতা’কে ধরা হয় তাঁর প্রস্তুতির পর্ব। এরপরের পর্ব ছিল,বিকাশ ও পরিণতির এবং প্রতিষ্ঠারও।
সেসময়ে বাংলা কবিতার একচ্ছত্র সম্রাট ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তিনি মহৎভাবের কবি। মহৎভাবের আড়ালে জীবনের সুখদুঃখ অনেকটাই তুচ্ছ হয়ে যেত। সত্যেন্দ্রনাথের কবিতার সরলতায়,ছন্দের দোলায় মানুষের নানা সমস্যা এল প্রত্যক্ষভাবে। ফলে তাঁর কবিতা জনমানসে দাগ কাটতে সময় লাগল না।
সত্যেন্দ্রনাথের জীবনে আরাধ্য ছিলেন দুজন। একজন রবীন্দ্রনাথ,অন্যজন গান্ধীজি। তাঁর প্রথমদিকের কবিতার বই ‘বেণু ও বীণা’ উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের ধ্যানধারণার দিকে প্রথম থেকেই ছিল তাঁর মনোযোগ এবং ভালবাসা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের যে প্রকাশ্য রবীন্দ্রবিরোধিতা ১৯০৬ এ শুরু হয়ে ১৯১২তে ‘আনন্দবিদায়’ অভিনয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে চরম রূপ লাভ করেছিল সত্যেন্দ্রনাথের নজর সেদিকেও যথেষ্ট ছিল। হয়ত সেজন্যই, ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কলকাতার টাউন হলে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবর্ধনা সভার তিনিই ছিলেন মূল কান্ডারী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চম্পা’ কবিতা ইংরাজিতে অনুবাদ করায় সত্যেন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন যে তিনি তাঁর সাহিত্যসাধনার চরমমূল্য লাভ করেছেন।
আর গান্ধীজি সম্পর্কে কোনও সমালোচনা তিনি গ্রহণ করতে পারতেন না। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে ঈষৎ বিচলিত সজনীকান্ত সত্যেন্দ্রনাথের মত জানতে তাই আশ্রয় নিয়েছিলেন গাব্ধীজিরই। নিজের লেখা ‘গান্ধী-বন্দনা’ কবিতাটা পকেটে নিয়ে ভয়ে ও সঙ্কোচে হাজির হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে। সজনীকান্তের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। সরাসরি উত্তর না দিলেও তিনি ‘বিদ্রোহী’ নিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘কবিতার ছন্দের দোলা পাঠকের মনকে নাড়া দিয়া যদি কোনও ভাবের ঈঙ্গিত দেয় তাহা হইলেই কবিতা সার্থক।’
মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে তাঁর অকাল মৃত্যু (২৫ জুন,১৯২২)। এই সামান্য সময়ে কম লেখেননি সত্যেন্দ্রনাথ। জীবদ্দশায় বারোটি (মৃত্যুর পরে আরও দুটি)কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথের স্নেহ লাভ করেছিলেন এই কবিতা-সূত্রেই। ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথের কাশ্মীরভ্রমণের তিনি সহযাত্রীও হয়েছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথেরই প্ররোচনায় ‘নবকুমার কবিরত্ন’ ছদ্মনামে শুরু করেছিলেন গদ্য রচনাও।
নিজের কবিতার নিন্দা বা প্রশংসায় উচ্ছ্বাস্ প্রকাশ তাঁর স্বভাব্ বিরুদ্ধ ছিল। কিন্তু তাবলে অন্যের রচনা সম্পর্কে উচ্ছ্বাসহীন ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছাড়াও সমকালীন অনেকের কবিতা সম্পর্কেই তিনি নিজের অকপট উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করতেন। মোহিতলালের ‘শেষ শয্যায় নূরজাহান’ পড়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কবর-ই নূরজাহান’ ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’
মাতৃভক্তি ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম গুণ। রাত্রি ন’টার পরে বাড়ির বাইরে থাকা মা পছন্দ করতেন না। সেজন্য ন’টার আগে বাড়িতে ঢুকে যেতেন নিয়মিত। তবে এই ন’টা অব্দিও তো নেহাৎ কম সময় নয়। এই সময়টায় বন্ধু চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেড়াতেন চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, বোটানিক্যাল গার্ডেন এইসব জায়গায়। আর যেতেন নানান মেলায়। মেলা দেখতে খুব ভাল বাসতেন সত্যেন্দ্রনাথ। কলকাতায় কবে কোন মেলা হবে খবর রাখতেন তিনি। চরিত্রের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন বালকের মত কৌতূহলী,সরল ও অকপট। মোহিতলাল লিখেছেন, ‘বিশ্বাসের সাহস,অবিশ্বাসের অসহিষ্ণুতা এবং পক্ষপাতের উগ্রতা এই তিন দোষই তাঁহার মানস প্রকৃতিতে কিছু অধিক পরিমাণে ছিল।’
সমকালীন অনেক কবির কাব্যেই সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাব পড়েছিল। এঁদের মধ্যে জীবনানন্দ,নজরুল,মোহিতলাল প্রমুখের নাম করা যায়। তবু সত্যেন্দ্রনাথের কবিতা সমালোচকদের তেমন আনুকূল্য পায়নি। বলা হয়েছে,তাঁর কবিতা যত তথ্যবহুল,তত ভাবগভীর নয়।এছাড়া সাম্প্রতিক বিষয়ের বাহুল্য,ছন্দের দিকে অতি মনোযোগ তাঁর কবিতার ক্ষতি করেছিল বলে তাঁদের অভিমত।
তবু আজ যখন ‘পালকির গান’ বা ‘দূরের পাল্লা’ পড়ি,টের পাই কবিতার পটভূমিতে ছায়া ফেলেছে পরাধীন ভারতের অবক্ষয়িত গ্রামবাংলার বেদনাবিধুর মূর্তিটিও।‘পালকির গান’এ ‘কুকুরগুলো শুঁকছে ধুলো’র মত আরও অনেক চিত্রকল্প শুধু বহিরঙ্গের বর্ণনা বলে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় না।

Leave a Reply