কথাঃআবোলতাবোলঃ তালগাছ

কথাঃআবোলতাবোল তালগাছ               চাষের জমির মাঝে তালগাছ। লাঙল দিয়ে চষতে গেলে আশপাশ মিলিয়ে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। ভাগচাষী গজগজ করে।.গজগজ করে বাবাও,-‘আর জায়গা পাইলি না,এক্কেরে আমার জমির মইধ্যে  খাড়াইয়া পড়লি!’ প্রথমে আগাছার মত উপড়ে ফেললেই হত। কিন্তু কেন কে জানে তা হয়নি।  এখন বড় হবার পর গজগজ ছাড়া আর উপায় কী! এই অবস্থায় কেটে ফেলার কথা তো বাবার কল্পনাতেও আসবে  না। এক বৈশাখে তাল গজাল গাছটায়। আমরা তালশাঁস খেলাম। সে  ভাদ্রে তালও পাকল। আমরা তাল কুড়োলাম। পাকা তালের রস দিয়ে বড়া হল বাড়িতে। তারপর রস নিংড়ানো তালাআঁটি ফেলা হল দূরে। দূরে,কিন্তু অজানা নিরুদ্দেশে ভাসিয়ে দেওয়া নয়। কারণ ভাদ্র গেলেই আসবে আশ্বিন। তখন এই তালআঁটি গুলোই মাটি থেকে তোলা হবে। কাটা হবে। ভিতর থেকে বেরোবে তালকুসুম। যার ডাক নাম, তালফোঁপরা। সে তালফোঁপরা কোজাগরির সামনে দেওয়া ফলের মধ্যে মিশে যাবে আর একটা ফল হয়েই। একদিন তালপাটালি নিয়ে এল আমাদের বহুদূরের এক ভাগচাষী। খেলাম। চুরিও করলাম। সে কী অপূর্ব স্বাদ! কোথায় লাগে খেজুর গুড়ের পাটালি! দিদি বলল, ‘আমাদের তালগাছের রস দিয়ে  করা যায় না  এমন?’ দাদা বলল, ‘যাবে না কেন?করলেই যাবে,কিন্তু তালগাছ কাটানো, ঠিলি পাতা,রস নামানো,জ্বাল দেওয়া  অনেক হ্যাপা। আর তাছাড়া, একটা গাছের রস আর কতটুকু হবে?’ তালপাটালি করার ভাবনা  তাই শেষ হয়ে গেল আলোচনাতেই । দেখতে দেখতে আমরা ভাইবোনেরা বড় হলাম। তালগাছের বুড়ো হবার কথা নয়,কিন্তু তবু দেখে ওকে বুড়োই মনে হতে লাগল। কেমন একটা শুকনো শুকনো ভাব। তালের কাঁদিও সেভাবে হয় না। পরিচিতরা পরামর্শ দিল,বেচে দিন। বাবা গত। বেঁচে থাকলে একথা ভাবাও যেত না। এখনও বাড়ির অভিভাবকদের মধ্যে একটু দোনামনা যে হল না তা নয়। তবে শেষ অব্দি বেচে দেবার সিদ্ধান্তই নেওয়া হল। খবর পাঠানো হল তালগাছ যারা বেচাকেনা করে তাঁদের কাছে। গ্রামের দিকে তালগাছের তখন বিরাট  চাহিদা। মাটির বাড়ির জুৎসই কড়িবরগার জন্য তখন বাছা হয় ,তালকাঠই। কিন্তু তালগাছ বিক্রি অত সহজ নয়। প্রথমে একদিন এলেন এক সুবেশ ভদ্রলোক। আমরা ভাবলাম,আসল ক্রেতা বোধহয় তিনি। কিন্তু শুনলাম উনি কাঠব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আসছেন গাছ পরীক্ষা করতে। ওঁর কাজ হল তালগাছে কতটা সার আছে দেখা। দেখে,ব্যবসায়ীদের  রিপোর্ট দেওয়া। সেই রিপোর্ট দেখে এবার দরদাম করতে এগিয়ে আসবেন ওঁরা। এমন পেশার লোকও তাহলে আছেন! আমরা তালগাছের সার-টেস্টারের পিছু পিছু চললাম গাছের কাছে। উনি একটা লোহার সরু শলাকা তালগাছে কিছুটা ঢুকিয়ে আবার টেনে নিলেন। বললেন-‘আমার কাজ শেষ।’আমরা তো অবাক। এরপর একদিন এলেন ব্যবসায়ীরা। বললেন, ‘গাছের সার ভালো নেই।’  তবু দাম একটা স্থির হল। কিন্তু কাটা পড়ার আগেই জ্যৈষ্ঠমাসের এক বিকেলে ঝড়ে ভেঙে পড়ল তালগাছটা। সব হিসেব উল্টে গেল আমাদের। আমাদের কারও কারও অবশ্য এও মনে হল যে এতদিনের পুরোনো পিতৃসম গাছ ঝড়ের আশ্রয়ে বিক্রির অপমান থেকে নিজেকে বাঁচাল। এবং আমাদেরও বাঁচাল অপরাধের হাত থেকে।   তালগাছটা থেকেও নেই হয়েছিল বহুদিন। এখন একেবারে নেই হয়ে বোঝা গেল আমার কাছে সে কতটা ছিল। মনে পড়ল, ছোটবেলায় ওই তালগাছের দিকে তাকিয়েই পড়েছি,‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে…।’ উদ্বুদ্ধও  হয়েছি। ভেবেছি,একপায়ে ও যদি পারে আকাশ ছুঁতে,দুপায়ে আমি পারবনা কেন! ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস পড়ে আমার। আর এখন? গ্রামে গিয়ে দেখি কাঁচাবাড়ির চিহ্নও আর নেই। তালগাছের একটা ব্যবহার তার মানে বিলুপ্ত। আমাদের জমিটা অবশ্য আছে। ওদিকে তাকালে কিন্তু মনে পড়ে যায় তালগাছটার কথা। শুধু কি তাই? গ্রীষ্মের দুপুরে গ্রামের বাড়ির বারান্দায় বসে চোখ বুজলে আজও শুনতে পাই, সেই একপায়ে দাঁড়ানো,সব গাছ ছাড়ানো তালগাছটায় একটা কাঠঠোকরা আওয়াজ করে চলেছে-ঠক,ঠক,ঠক…  

পুরো পড়ুন »