কথাঃআবোলতাবোল

লিপইয়ারের গল্প,গল্প গ্রহণেরও

১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাই যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন  তখন আমার ক্লাস এইট। রাজনৈতিক কাজকর্ম  বোঝার তখন  বয়স নয়। খবরের কাগজ পড়াতেও অভ্যস্থ ছিলাম না। নানাজনের মুখবাহিত হয়ে চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে দুটো খবর তখন মনে বেশ দাগ কেটেছিল। একটা ঘুম থেকে উঠে স্ব-মূত্র পান। আর একটা তাঁর জন্মদিন। কুইজে জেনেছিলাম সুপারম্যান চরিত্রটির জন্মদিন উনত্রিশে ফেব্রুয়ারি,এবার শুনলাম মোরারজি দেশাইয়েরও নাকি তাই।

পরে মোরারাজি দেশাই এর জন্মদিন নিয়ে আরও মজার তথ্য জানা গেল। এমনিতে উনত্রিশে ফেব্রুয়ারি জন্মদিন হবার কারণে জীবনে জন্মদিন পালন দীর্ঘজীবনের সুবাদেও সীমিত,তার উপর জন্মসালটি ১৮৯৬ হওয়াতে প্রথম জন্মদিনটিই তিনি পান চার নয়,আটবছর বাদে।

কারণটা জানতে গেলে লিপইয়ারের গল্পটা একবার ফিরে দেখা যেতে পারে। এই লিপইয়ারে দাঁড়িয়ে সে গল্প হয়ত অপ্রাসঙ্গিকও হবে না ।

ফিরে যাওয়া যাক জুলিয়াস সিজারের কালে। সেসময় জানুয়ারি মোটেই প্রথম মাস ছিল না, জানুয়ারি ছিল এগারোতম মাস আর শেষ মাস ছিল ফেব্রুয়ারি।  তখন সাতটা মাস ছিল তিরিশদিনের,পাঁচটা ছিল একত্রিশ দিনের। ফেব্রুয়ারি মাস ছিল তিরিশ দিনের। কিন্তু জুলিয়াস সিজার আর তাঁর পুত্র অগাস্টাস যথাক্রমে পঞ্চম আর ষষ্ঠ মাস কুইন্টালিস ও  সেক্সটিলিসের নাম পালটে নিজেদের নামে রাখলেন। মাস দুটির নতুন নাম হল জুলাই আর আগস্ট। আর এরই সঙ্গে কপাল পুড়ল ফেব্রুয়ারির। তিরিশ দিন থেকে কমে কমে সে হল আঠাশে। 

কিন্তু পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে ৩৬৫ দিনের কিছু বেশি সময় লাগে। সেটা ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের মত। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে সময়টাকে ৬ ঘন্টা ধরে চল হল ফেব্রুয়রির সঙ্গে প্রতি   চারবছর অন্তর একটা করে দিন যোগ করার। সোজা হিসেব দাঁড়াল, যে সাল ৪ দ্বারা বিভাজ্য সে পাবে ওই অতিরিক্ত দিনটা। এই নিয়মে কিছুটা কপাল খুলল ফেব্রুয়ারির।

কিন্তু ভাগ্য তবু পিছু ছাড়ে না। দেখা গেল ৩৬৫ এর উপর যে ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড সময়টা পৃথিবীর সূর্যকে ঘুরতে লাগে সেটা ৬ ঘন্টা হিসেব করার জন্য একটু বেশি গোনা হয়ে গেছে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংশোধন করতে গিয়ে পোপ গ্রেগোরির তো মাথায় হাত। ১৫৮২ সালের অক্টোবর  মাস থেকে ১০টা দিনই তিনি বাদ দিয়ে দিলেন। আর নিয়ম করলেন শেষে দুটো শূন্য থাকলে সালটাকে ৪  নয় ভাগ করতে হবে ৪০০ দিয়ে।

এই নিয়ম মেনে ১৯০০ সাল লিপইয়ার হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল। মোরারজি দেশাইও প্রথম জন্মদিনটি  পেলেন আট বছর পরে,১৯০৪ এ গিয়ে।

অতিরিক্ত যে দিনখানা সাধারনত চারবছর অন্তর ফেব্রুয়ারির প্রাপ্য হল সেটার কদর হবারই কথা। হলও   দেশে দেশে। এর মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ, ১২৮৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি স্কটিশ পার্লামেন্টে যে লিপ ইয়ার অ্যাক্ট পেশ হল,তাতে বলা হল এবার মেয়েরাও ছেলেদেরকে ‘প্রপোজ’ করতে পারবে। 

স্কটল্যান্ডে আইন  হলেও আদতে এটা কিন্তু নতুন কোনও প্রথা  ছিল না। অনেক আগে পঞ্চম শতাব্দীতে আয়ারল্যান্ডে খ্রিস্টীয় মিশনারি সেন্ট  প্যাট্রিক সেখানে চালু করেছিলেন এই প্রথা।  পরে ত্রয়োদশ শতকে আয়ারল্যান্ডে  এই নিয়ে নিয়ম চালু হয় যে,যে-সমস্ত পুরুষেরা  এদিন মেয়েদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবেন তাঁদের ফাইন দিতে হবে। অর্থাৎ আংটি দিয়ে ছেলেদের বিয়ের প্রস্তাব দেবার চলতি রীতির উলটো পথ দেখাল উনত্রিশে ফেব্রুয়ারির দিনটি।

ইতিহাসের পাতায় উনত্রিশে ফেব্রুয়ারির মজাদার গল্প রয়েছে অনেক। আজ সূর্যগ্রহণ। তাই কলম্বাসের গল্পটাই বলা যাক। কিছুদিন আগে  ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত ঘুরে গেলেন আর কয়েক শতাব্দী আগে ক্রিস্টোফার কলম্বাস স্পেন থেকে ভারতে আসতে  চেয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ট্রাম্পেরই দেশে। 

সালটা ১৪৯২। এরপর আরও তিনবার তিনি আমেরিকা অভিযান করেন। চতুর্থ এবং শেষবার তিনি মধ্য আমেরিকার উপকূল ঘুরে দেখার সময় জামাইকা দ্বীপের উত্তর উপকূলে আটকে পড়েন। খুব খারাপ অবস্থা তখন কলম্বাসের। জাহজে পোকাদের মহামারীতে খাবারদাবার সব নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এখানকার আদিবাসীরা খারাপ নয়। তাঁরা উপঢৌকনের বিনিময়ে খাবার দিয়ে প্রাণ বাঁচাল সবার। 

কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বিরুদ্ধে গেল। ছমাসেও ফেরার ব্যাপারে সুরাহা করতে পারলেন না কলম্বাস। একে তো দীর্ঘদিন খাবার সরবরাহ করা,তার উপর কলম্বাসের সঙ্গীদের আদিবাসীদের উপর অত্যাচার। খাবার দিতে অস্বীকার করলেন সেখানকার  আদিবাসীদের প্রধান। এই সময়  জোহানেস মূলারের একটা জ্যোতির্বিদ্যার সারণি সম্বলিত ক্যালেন্ডার বাঁচিয়ে দিল কলম্বাসকে।

তিনি ক্যালেন্ডারে দেখলেন সামনেই রয়েছে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। তিনি চন্দ্রগ্রহণের  তিনদিন আগে আদিবাসী-প্রধানকে ডেকে বললেন-‘ খাবার না দেবার জন্য আমাদের দেবতা তোমাদের উপর কূপিত। তিনদিন পরেই  তিনি তাঁর অসন্তুষ্টি জানিয়ে দেবেন চাঁদকে আকাশ থেকে সরিয়ে নিয়ে।’ তিনদিন পর,সাল ১৫০৪,তারিখ এবছরের মতই এক লিপ ডে ২৯ ফেব্রুয়ারি,সন্ধের পর শুরু হল চন্দ্রগ্রহণ। আদিবাসীরা কলম্বাসের কথা মিলে যাচ্ছে দেখে ভয় পেয়ে গেল। 

এরপর দেবতাকে খুশি করার জন্য আদিবাসীদের আর খাবার সরবরাহ না করে উপায় কী! স্পেন থেকে ত্রাণ জাহাজ না আসা অব্দি আর ছেদ পড়ল না খাবার সরবরাহে।   

চন্দ্রগ্রহণের সেই স্মরণীয় ২৯ ফেব্রুয়ারি পড়েছিল তখনকার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বৃহস্পতিবার। আর এবার তা পড়েছিল শনিবার। একবিংশ শতাব্দীর পঞ্চম লিপ-ডে ছিল এবার। করোনা আতঙ্ক তখনও এদেশে আসেনি। তবে চিনের দৃশ্য দেখে আমরা স্বস্তিতে ছিলাম না মোটেই। আর তারপর মাসখানেকের মধ্যেই আমরা নাম উঠিয়ে ফেললাম করোনা-আক্রান্ত দেশের তালিকায়। শুধু এবারের লিপ ডের দিনটি নয়,এমন লিপ ইয়ারের কথা কে ভুলবে!