কথা:বকুল কথা (Bokul Katha)

কথা

Ami Mishuk | আমি মিশুক কথা:বকুল কথা (Bokul Katha)

বকুলকথা

বসন্ত বন্দনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-‘নব শ্যামল শোভন রথে,এসো বকুল বিছানো পথে।’  ঋতুরাজ বসন্তের যথার্থ আবাহনই বটে! কেননা শিউলি না এলে যেমন শরতের চলে না,তেমনি বকুল ছাড়াও বসন্ত অপূর্ণ। শীত শেষে প্রকৃতির এই আশ্চর্য উপহার মানুষকে শিউলির মতোই উন্মনা করে দেয়।   

একসময় পাতানো সম্পর্কে ‘গঙ্গাজল’ ‘মহাপ্রসাদ’ এর সঙ্গে ‘বকুলফুল’ ছিল বন্ধুত্বের স্মারকচিহ্ন। এছাড়া, যে সময় ফুল দিয়ে পুত্রকন্যাদের নামকরণ করা হত অহরহ,সে সময় শিউলি,জবা ইত্যাদির পাশে বকুলেরও ছিল যথেষ্ট সমাদর। জবা,শিউলির পাশে বকুলের কিছু বাড়তি সুবিধাও ছিল। জবা,শিউলি মানেই তো মেয়েদের নাম। বকুলের ক্ষেত্রে তা নয়। আশাপূর্ণা দেবীর ‘বকুল কথা’ যেমন বকুল নামের একটি মেয়ের গল্প,তেমনি নজরুল ইসলামের ‘বকুল’ এক পুরুষ পুলিশ অফিসার।

এমনিতে দেড় সেন্টিমিটারের ফুলটি দেখতে যে আহামরি সুন্দর তা নয়। কিন্তু এর গন্ধ আকুলকরা। ছেলেবেলায় আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল বিশাল এক বকুল গাছ। বসন্ত এলেই বকুলের সুবাস পেতাম। আর পঁচিশে বৈশাখে খুব ভোরে উঠে বকুলগাছের তলায় বসে মালাও গেঁথেছি অনেকবার।

অন্যান্য ফুলের সঙ্গে বকুলের একটা পার্থক্য আছে। বকুল কিন্তু অন্য ফুলের মত তাড়াতাড়ি শুকোয় না। তাই ভোরে গাঁথা বকুলমালা বিকেলে দিব্যি রবিঠাকুরের ফটোতে দেওয়া যেত।

বকুলের সঙ্গে বাঙালির অবশ্য রোমান্টিসিজমের সম্পর্ক। এর শুরু সুপ্রাচীনকাল থেকে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর ‘রাধাবিরহ’তে রাধার বচনে রয়েছে-‘চাহা চাহা বড়ায়ি যমুনার ভীতে।/বকুলতলাও চাহা চাহা একটীতে।।’ অর্থাৎ বড়াই যমুনার দিকে তাঁর খোঁজ করো,বকুলতলাও ভালো করে দেখো। বোঝাই যাচ্ছে,শুধু কদম  নয়,বকুলগাছটিও কৃষ্ণের বড় প্রিয় ছিল। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের গানে বকুল ফিরে ফিরেই এসেছে। দ্বিজেন্দ্রলালের গানে রয়েছে,বকুলের তলায় ‘সারা সকালটি বসে বসে সাধের মালাটি’ গাঁথার কথা।

যিনি বসন্ত বন্দনায় বকুল এনেছেন,তিনি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে অন্যান্য গাছের মধ্যে বকুলকে মহাসমাদরে স্থান দিয়েছিলেন। শালবীথির মত বকুলবীথিও গড়ে উঠেছিল সেখানে। এই বকুলবীথির তলায় মাটির বেদিও তৈরি হয়েছিল। শিক্ষকের বেদি ঘিরে ছাত্রদের বেদি,যেখানে ক্লাস নেওয়ারও প্রচলন হয়। বকুলতলায় মাটি ফেলে বেদি তৈরির বর্ণনা রানী চন্দের ‘সব হাতে আপন’ স্মৃতিকথায় রয়েছে। রানী চন্দ লিখছেন-‘মাটি কাটা হচ্ছে,মাটি ফেলা হচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে গান  চলছে,’আমাদের শান্তিনিকেতন,সে যে সব হতে আপন।’

‘পথের পাঁচালী’তে রয়েছে-‘রানু জিজ্ঞাসা করিল-দুগগা? না তাকে তো দেখিনি। বকুলতলায় নেই তো?’ এই ‘পথের পাঁচালী’তেই একটু পরে বিভূতিভূষণ লিখেছেন-‘বকুলগাছটা অনেকদূর পর্যন্ত জুড়িয়া ডালপালা ছড়াইয়া ঝুপসি হইয়া দাঁড়াইয়া আছে-তলাটা অন্ধকার।’

‘পথের পাঁচালী’র এই বকুলগাছ কিন্তু মোটেই বানানো নয়। বাস্তবেও এর অস্তিত্ব ছিল। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য লিখেছেন,এই বকুলগাছ ছিল বিভূতিভূষণের গ্রাম বারাকপুরেই। এই বকুলগাছ দেখাবার জন্য তিনি  কলকাতা থেকে বহু বিদগ্ধজনকে বারাকপুর গ্রামে নিয়ে গিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। গৌরীশঙ্কর লিখেছেন-‘আমরাও সেই গাছতলায় তাঁর পাশে বসেছি। এতে  তিনি যেন শৈশবের স্বাদ উপভোগ করতেন।’

বিভূতিভূষণ ছিলেন প্রকৃতির রূপদ্রষ্টা দার্শনিক,নিজের হাতে বাগান করা বা বৃক্ষরোপণ করার সময় তাঁর ছিল না। জীবিকার তাড়না তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে নানা জায়গায়। তাছাড়া একেকজনের স্বভাবের সঙ্গে একেকটা বিষয় যায়। বিভূতিভূষণের সঙ্গে দেখাটা।

অন্যদিকে এ ব্যাপারে তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁর বিপরীত। তাঁর টালা পার্কের বাড়িতে ছিল স্বহস্ত নির্মিত এক বাগান। গৌরীশঙ্কর,লেখকপুত্র সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জেনেছিলেন যে এখানে তারাশঙ্কর স্বহস্তে রোপণ করেছিলেন একটি বকুলগাছও।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘আরণ্যক’। কিন্তু এই উপন্যাসের যুগলপ্রসাদের মতো দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তারাশঙ্করের । বকুলগাছটির ব্যাপারে তিনি মনে করতেন,যখন পৃথিবী থেকে চলে যাবেন,এই গাছ তখন  পথিককে ছায়া দেবে,বাতাসে ফুলের সৌরভ ছড়াবে আর সুন্দরের পূজারি মানবমানবীর দল এর ফুলের মাধ্য্যমেই জানাবে তাদের মনের কথা।  

Product